“বিবাহ-বিভ্রাট”
মো. মুয়াজ্জাজুর রহমান মুয়াজ ।।
(Grasshopper’s Tale)
সারা রাত জার্নি করে ভোর সাড়ে চারটার দিকে সুনামগঞ্জ এসে নামলাম। বাস স্ট্যান্ড থেকে আমাদের বাসা বেশি দূরে নয়। বাসায় এসে গোসল করে ভাত খেতেই দুচোখ জড়িয়ে ঘুম এলো। নিজের বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে শুনি আজ আমার বিয়ে! বাড়ির পাশের কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হয়েছে। এক লাখ দশ হাজার টাকায় দুটো বিশাল গরু কেনা হয়েছিল। আমার ধারণা ছিলো গরু কেনার পিছনে বাবার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেগুলো যে আমার বিয়ের জন্য তা দেখে রীতিমত পিলে চমকানো ছাড়া আমার আর কোনো গতি ছিলো না। মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, আমার মনে হলো মাথায় পুরো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ভেঙে পড়েছে।
বেলা একটার দিকে আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে বিয়ের সেন্টারে নেয়া হলো। সিংহাসনের মতো চেয়ারে আমি পায়ের উপর পা তুলে বসলাম। একটু পরে লাল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে এসে হাসি মুখে আমার পাশে দাঁড়ালো। আমাকে খয়েরি রঙের একটা জমকালো পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পড়ানো হয়েছে। লাল রঙের শাড়ি পড়া মেয়েটি নাকি আমার বউ! গোলাকার মুখ, টকটকে ফরসা রং, লাল ঠোঁট, নিচের ঠোঁটের শেষ মাথায় একটা কালো তিল। আমি বুঝতে পারছি না তিলটা সত্যি নাকি আঁকানো। আমার মাথা ঘুরছে। আমি যখন কলেজে পড়তাম, একটা সুন্দরী মেয়ে ছিলো। নাম পাপড়ি। তাকে দেখে আমি বলেছিলাম,
“পরিরা কি তার চেয়ে বেশি সুন্দর হয়?”
সবাই বলেছিলো, “না হয় না।” আজকে আমি সেই কথা ফিরিয়ে নিলাম। পরিরা নিঃসন্দেহে পাপড়ির চেয়ে সুন্দর হয়। আমার হবু বউয়ের পাশে পাপড়ির সকল রূপ ম্লান হয়ে যাবে। তাহলে কি আমি কোনো পরিকে বিয়ে করছি? সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটাকে আমার জন্য সযত্নে তুলে রেখে দিয়েছেন! আমি জানতামই না! আমি চুপি চুপি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনার নাম কি?”
“নীরা।”
“আমাদের কি সত্যি বিয়ে হচ্ছে? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?”
নীরা কুট করে আমার হাতে একটা চিমটি কাটলো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মাত্র কৈশোর পার করেছে সে। কিশোরিদের মতো কথায় কথায় ফিক করে হেসে দেয়ার স্বভাবটা এখনো তার মাঝে রয়ে গেছে। আমি একটা গভীর ঘোরের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। এতো বড় আয়োজন, অথচ কোনো কিছুই আমি টের পেলাম না! কোনো মানে হয়? আমাদের বিশাল বংশ। বাবা সেই বংশলতিকা ধরে সবাইকে ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছেন। এই আত্মীয়, সেই আত্মীয় এসে আমার সাথে কথা বলছেন। হাসিমুখে ছবি তুলছেন। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। পাশে দাঁড়িয়ে ছোটবোন ইশারায় বলছে, “সালাম কর, হাত বাড়া, জড়িয়ে ধর”। আমি বোকার মতো তার কথা পালন করে যাচ্ছি। রূপবতী বৌ পাশে নিয়েও রাগ হচ্ছে। আত্মীয় স্বজনের ঢল শেষই হচ্ছে না। বড় চাচার মেঝো শ্যালকের আপন চাচাতো ভাই এসেছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবভঙ্গি করছেন যেন আমি তার বহুদিনের পেয়ারা দোস্ত। আমার বিয়েতে তাঁর চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। আমি মনে মনে উনার সাথে নিজের সম্পর্ক মিলানোর চেষ্টা করলাম।কি ডাকবো, মামা, চাচা, ভাই নাকি অন্যকিছু! মনে হলো, বিয়ের আগে প্রত্যেক পুরুষের একবার করে বিয়ের রিহার্সাল হওয়া উচিত। তাকে শিখিয়ে দেয়া উচিত কি কি করতে হবে, না করতে হবে।
আমার পাশে নীরা খুব হাসিখুশি। যেই আসছে সে খিলখিল করে হেসে ছবি তুলছে।যেন সবাই তার প্রাণের বন্ধু। আমার বড় বোনের বিয়েতে দেখেছিলাম একটু পরপর কেঁদে ফেলছেন। এদিকে নীরা একটু পরপর হাসছে।তাও খিলখিল করে হাসছে! আপুর বিয়ের বছর পাঁচেক হয়েছে। যুগ কতো তাড়াতাড়ি বদলে গেছে।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বৌ নিয়ে বাড়ি এলাম মাগরিবের আজানের সময়। বাড়িতে ঢোকার সময় দেখি সারা বাড়ি ঝলমল করে সাজানো! আমি তো অবাক। মেয়ের বাড়ি থেকে মেয়ের সাথে দশ বারোজন এসেছে।আমাদের বাড়ির সদস্যবৃন্দ সেই দশ বারোজনকে নিয়েই মেতে আছেন। বারবার হাসির হল্লা ছুটছে, কে কাকে কথায় হারাতে পারে সেই প্রতিযোগিতা চলছে। পাশের বাড়ির আন্টিরা এসেছেন বৌ দেখার জন্য। আমার পরির মতো বৌ দেখে তারা হিংসায় চোখ বাঁকা করছেন। তাঁদের বাঁকা চোখ আমার চোখে পড়ছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন মেয়ের কোনো একটা খুঁত বের করে সেটা সারা পাড়ায় মাইকিং করতে। পারছেন না। নীরা এতোটা নিখুঁত যে তার সবচেয়ে বড় সমালোচকও তার রূপের দিকে আঙুল তুলতে পারবে না। চারদিকে ব্যস্ততার মাঝে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একেবারে অচ্ছুত হিসেবে। কেউ বউ দেখছে, কেউ গল্প করছে। আমার দিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। বিশ পঁচিশ কাপ চা বানানো হলো।একটা কম ছিলো। তাই আমাকে দেয়া হলো না। আমি বিরস মুখে বসে রইলাম।
নীরার সাথে প্রথম রাত শুরু হলো একটা অঘটনের মধ্য দিয়ে। ছোট বোন আমার জন্য এক গ্লাস দুধ রেখে গিয়েছিল। আমি সেটা খেয়াল করিনি। পোষা বিড়ালটা এসে সেই দুধটা মেঝেতে ফেলে দিলো । বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভাঙা গ্লাসে পা কাটলাম, বাসর ঘরে বউয়ের সাথে গল্প করার বদলে ঘর পরিষ্কার করা শুরু করলাম। আমি কাজ করছি, নীরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।আমি বুঝতে পারলাম, আমার ভবিষ্যতের আকাশে কালো মেঘ ছাড়া কিচ্ছু নেই।
“আপনার নাম কি?”
নীরার প্রশ্নে আমি চমকে উঠলাম।আমি নাহয় বিয়ে নিয়ে কিছু জানি না। নীরাও কি জানে না? একটু অপ্রস্তুত ভাবে জবাব দিলাম,
“মুহিব।”
“সুন্দর নাম।”
“ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নাই। এতো আহামরি কিছুও না।”
নীরা চ্যাটাং করে উঠলো। আমি রাগ হলেও কিছু বললাম না। একে তো প্রথম বিয়ে, প্রথম বৌ, তার উপরে প্রথম রাত। ঝগড়া করা শোভন হবে না।
“আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?”
“আমার ইচ্ছা হয়েছে রেগেছি, আপনার কি?”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এই মেয়ে বলে কি?
“দেখো, তোমার ভালো মন্দ তো আমাকে দেখতে হবে।”
“আমাকে তুমি করে বললেন কেন? সরি বলুন।”
নীরা খ্যাক করে উঠলো। আমি নিজের কপালে আমি একটা বাতি জ্বলে উঠতে দেখলাম।রংটা কি আপনাদেরকে বলতে পারবেন ?
নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে বললাম,
“সরি।”
“ইটস ওকে।”
নীরা আদুরে গলায় জবাব দিলো।তারপর নিজে থেকে গল্প শুরু করলো। মেকআপ ছাড়া তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। ঠোঁটের পাশের তিলটাকে নকল বলে সন্দেহ করেছিলাম।আসলে সেটা প্রাকৃতিক। এই ছোট্ট কালো বিন্দুটা নীরাকে নয়নমোহিনী করে তুলেছে।
“শুনুন, আমার ভাইকে চেনেন?”
“কে?”
“আরে পিস্তল মিজান।”
আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। পিস্তল মিজান আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসীদের একজন। তার হাত নাকি কখনো পিস্তল ছাড়া থাকে না। লোকে বলে, ভাত খাওয়ার সময়ও তার হাতে একটি লোডেড পিস্তল থাকে। তাই নাম পড়েছে পিস্তল মিজান। সে ছোটখাটো মিচকা শয়তান নয়, শয়তানদের
শিরোমনি।
“কি?” আমার মুখে তোতলামি চলে এসেছে।
“আরে হ্যাঁ। কি ঘটনা বলি?”
“ব ব্ ব্বলুন।”
“ভাইয়াকে তো চেনেন। দুই মাস আগে আপনার হাসপাতালে গিয়েছিলাম ভাইয়াকে নিয়ে। পায়ে গুলি লেগেছিলো। ভাইয়ের মাফলার ছিলো মুখে, আমার বোরখা ছিলো। তাই আপনি চেনেননি।”
“তারপর?”
“তারপর আর কি?”
“আপনাকে দেখে আমার ভালো লাগলো।ভাইয়াকে বায়না ধরলাম এনে দাও, এনে দাও।”
“প্ পরে?”
“ভাইয়া আপনার খোঁজ বের করলেন। আপনার বাবা তো রাজি ছিলেন না।”
“তারপর?”
আমার হাত পা ঘামতে শুরু করেছে।
“ভাইয়া আমার ছবি আর মেশিন উনাকে দেখালেন। রাতারাতি বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।”
“কি বলো?”
“জ্বি হ্যাঁ। ভাইয়া আগে থেকে জানতো আপনি কবে আসবেন। সে অনুযায়ী আপনার সব আত্মীয় স্বজনের তালিকা করে সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। তারপর আপনি আসার পরেই আপনার বাসায় বলা হয়েছে। সবাইকে সিস্টেমে রাজি করানো হয়েছে। ”
“কি সিস্টেম?”
নীরা শাড়ির ভেতর থেকে একটা ঝকঝকে পিস্তল বের করলো। দেখেই আমার জান শুকিয়ে অর্ধেক!পিস্তলটায় গুলি ভরে সে আমার দিকে তাক করে বলল,
“এভাবে।”
নীরা খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
আমি ভয়ে চিমশে গেলাম। সবটুকু সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
“এটা, এটা তো ঠিক না।”
“কি বললে? কি ঠিক না? কি ঠিক না?”
নীরা আবার বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলো। মহা মসিবতের উপরে কোনো মসিবত থাকলে সেটায় পড়া গেলো দেখছি!
“নীরা শান্ত হও, শান্ত হও।”
নীরা সাথে সাথে চোখের পানি মুছলো। তার এই রোদ, এই বৃষ্টি! পিস্তলের আমি ভয়ে সিঁধিয়ে গেছি। এই মেয়েকে সারা জীবন সামলানো আমার জন্য খবর আছে। আমি নিজের চিন্তাটা ওকে বুঝতে দিলাম না।ভাব দেখালাম আমার অনেক সাহস, তাকে আমি একটুও ভয় পাচ্ছি না।তাকে পেয়ে খুশিতে মরে যাচ্ছি। আসলে নীরাকে কিছু বুঝতে দেয়ার সাহস নেই । ওর হাতে পিস্তল। আমার এক জ্ঞানী বন্ধু একবার বলেছিলো, সুন্দরীদের নাকি হৃদয় বলে কিছু থাকে না…