ইন্দুবালার ভাতের হোটেল

বুক রিভিউ
লেখাটি শেয়ার করুন

সোনিয়া আক্তার
ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

বই: ইন্দুবালার ভাতের হোটেল
লেখক: কল্লোল লাহিড়ী
হাজার হাজার শহীদের রক্তে যে দেশটা গড়ে উঠেছে নতুন করে, সেখানে আজ গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর বাড়িটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ইন্দুবালা নিশ্চিত জানেন। এবার যদি গিয়ে গ্রামটাকেই না খুঁজে পান? যদি বোস পুকুরটাই আর না থাকে? কপোতাক্ষের ঘাট? মনিরুলের বাড়ির উঠোন? বড় মাঠের ফলসা গাছ? তাহলে কার কাছে ফিরে যাবেন ইন্দুবালা?  কার আঁচলে মুখ লুকোতে?যারা ছিল অথচ আজ নেই? নাকি যারা মরেও বেঁচে আছেন  ইন্দুবালার মধ্যে? নীরবে কাঁদেন ইন্দুবালা। কোনো সদুত্তর পান না অন্তর থেকে।শুধু এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া মানুষদের ভিড় বাড়ে।পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে ইমিগ্রেশন ওার করে মানুষ। এক সময় যে দেশটা নিজের দেশ ছিল সেটারই বেড়া টপকায়।প্রত্যেক বছর বৃষ্টি আসে নিয়ম  করে দু দেশেই। তবুও সীমান্তের দাগ মুছে যা না সেই জলে।
কপোতাক্ষের তীর ঘেঁষে  কলাপোতা গ্রামের দুরন্ত মেয়ে ইন্দুবালা। সন্ধ্যা হলে বোসদের  পুকুরপাড়ে বসে জোনাকি আলোর ঝলকানিতে হারিয়ে যাওয়ার বায়না।এদিকে  ঠাম্মা আর মায়ের চিৎকার চেঁচামেচির কারণে  বাধ্য হয়ে ঘরে ফেরার তাড়া। কিশোরী  জীবনের সমস্ত বেখেয়ালি,আদিখ্যেতার  ইতি টেনে কলকাতার মাস্টার রতনলাল মল্লিক এর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, পাড়ি জমাতে  হয়েছিল ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িতে। পিতা সামর্থ্য না থাকা সত্বেও গা ভর্তি সোনার গহনা দিয়ে মুড়িয়ে সেদিন  যেতে হয়েছিল ইন্দুবালাকে। নতুন শহর, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ কে আপন করার চেষ্টা। কিন্তু নতুন  বউকে বরণ করার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কাকপক্ষীও সেদিন আসেনি। কিশোরী ইন্দুবালার স্বপ্ন ছিল ঢাকঢোল পিটিয়ে, শঙ্খ বাজিয়ে  তাকে বরণ করে নিবে শশুর বাড়ির লোকজন । বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, মন ভেঙ্গে গিয়েছিল ইন্দুর। ভাঙ্গা মন, ভাঙ্গা হৃদয় আর কোনদিন জোড়া লাগেনি তার।সেই যে গা ভর্তি গহনা নিয়ে  কপোতাক্ষকে বিদায় জানিয়ে ছিল, আর কোনদিন ঘরে ফেরা হয়নি ইন্দুবালার।মাঝে মাঝে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করে খবরা-খবর নেওয়া হতো পিতা মাতার। ঠাম্মা, ছোট ভাই, পিতা -মাতা, শৈশবের প্রিয় বন্ধু মনিরুল কারো সাথেই শেষ দেখা হয়নি।
ইন্দুবালার ভাতের হোটেল
রতনলাল মল্লিকের নামের আগে মাস্টার শব্দটার যুক্ত থাকলেও আদতে তিনি মাস্টার ছিলেন না। বলা চলে জুয়া, মদ,তাসের ঘরে ডুবে থাকা  মাস্টার ছিলেন তিনি।একসময় সমস্ত দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে তিন তিনটি সন্তান রেখে ওপারে পাড়ি জমালেন ইন্দুর স্বামী রতনলাল মল্লিক।মরে গিয়ে যেনো ইন্দুর বোঝাটা হালকা করেছিলেন, কারণ সংসারের প্রতি কোনো দায়িত্ব -কর্তব্য পালন করেনি।ইন্দুর গহনাগুলো একে একে খোয়া গিয়েছিল রতনলালের হাত ধরে।কাছের মানুষদের হারিয়ে, দিশেহারা ইন্দুবালা তিন সন্তান নিয়ে নেমে পড়ে জীবন যুদ্ধে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে এক শক্তিশালী হাতিয়ার  হয়ে ওঠে ইন্দুবালার ভাতের হোটেল। সহায়- সম্বলহীন পিতা-মাতা, ভাই, স্বামী, শাশুড়িহীন জগত কতটা নির্মম আর অন্ধকার ছিল তারচেয়ে হয়তো আর কেউ সেটা ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে না। সময়ের পরিক্রমায় ইন্দুবালার  সন্তান সন্তানাদি, নাতি-নাতনি সবাই সবার মত করে প্রতিষ্ঠিত হয়।  সন্তানেরা তাকে দিল্লি, ব্যাঙ্গালোরে নিজেদের কাছে নিতে চাইলেও সত্তরের বেশি বয়সের ইন্দু ভাতের হোটেল ছেড়ে  কোথাও যাবেনা,  এ যেনো ছিল তার পণ। শুধু টাকার জন্য নয় বরং মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতো ইন্দুবালা। তাকে সহযোগিতা করার জন্য এসেছিল রক্তের সম্পর্কহীন, স্বার্থহীন কিছু মানুষ যার মধ্যে ধনঞ্জয় অন্যতম।
দেহ থাকে ছেনু মিত্তির লেনের পুরোনো দু’তলা ভবনের মল্লিক বাড়িতে, কিন্তু মন ছুটে যায় সেই কলাপোতায় গ্রাম,বোসদের পুকুর,তেপান্তরের ধানক্ষেত, কতবেলের আচার,উঠোন ভরা আচারের বয়াম,ঠাম্মার হাতের কচুবাটা,মালপোয়া,কপোতাক্ষের ধার ধরে কাশ ফুলের মাঠ।
“ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ নামের এক নির্জন দ্বীপে ইন্দুবালা সেই ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে রাখেন। সবাই আসে তাদের ভালোবাসা ভাগ করে নেয়।কিন্তু ইন্দুবালার কিছু ভাগ করার থাকে না।তিনি শুধু অফুরন্ত বিলিয়ে চলেন তাঁর স্মৃতি রান্নার এক পদ থেকে অন্য পদে।যারা বুঝতে পারে তারা একটু বেশি আনন্দ পায়। আর যারা খাবারের সাথে মজে থাকে তারা শুধু রসনায় মজা পায়। ভেতরের মানুষটার নয়।”

হাজার হাজার শহীদের রক্তে যে দেশটা গড়ে উঠেছে নতুন করে, সেখানে আজ গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর বাড়িটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না ইন্দুবালা নিশ্চিত জানেন। এবার যদি গিয়ে গ্রামটাকেই না খুঁজে পান?যদি বোস পুকুরটাই আর না থাকে?কপোতাক্ষের ঘাট? মনিরুলের বাড়ির উঠোন? বড় মাঠের ফলসা গাছ? তাহলে কার কাছে ফিরে যাবেন ইন্দুবালা? কার আঁচলে মুখ লুকোতে?যারা ছিল অথচ আজ নেই? নাকি যারা মরেও বেঁচে আছেন ইন্দুবালার মধ্যে? নীরবে কাঁদেন ইন্দুবালা। কোনো সদুত্তর পান না অন্তর থেকে।শুধু এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া মানুষদের ভিড় বাড়ে।পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে ইমিগ্রেশন ওার করে মানুষ। এক সময় যে দেশটা নিজের দেশ ছিল সেটারই বেড়া টপকায়।প্রত্যেক বছর বৃষ্টি আসে নিয়ম করে দু দেশেই। তবুও সীমান্তের দাগ মুছে যা না সেই জলে।”

কপোতাক্ষের তীর ঘেঁষে কলাপোতা গ্রামের দুরন্ত মেয়ে ইন্দুবালা। সন্ধ্যা হলে বোসদের পুকুরপাড়ে বসে জোনাকি আলোর ঝলকানিতে হারিয়ে যাওয়ার বায়না।এদিকে ঠাম্মা আর মায়ের চিৎকার চেঁচামেচির কারণে বাধ্য হয়ে ঘরে ফেরার তাড়া। কিশোরী জীবনের সমস্ত বেখেয়ালি,আদিখ্যেতার ইতি টেনে কলকাতার মাস্টার রতনলাল মল্লিক এর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, পাড়ি জমাতে হয়েছিল ছেনু মিত্তির লেনের বাড়িতে। পিতা সামর্থ্য না থাকা সত্বেও গা ভর্তি সোনার গহনা দিয়ে মুড়িয়ে সেদিন যেতে হয়েছিল ইন্দুবালাকে। নতুন শহর, নতুন জায়গা, নতুন মানুষ কে আপন করার চেষ্টা। কিন্তু নতুন বউকে বরণ করার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কাকপক্ষীও সেদিন আসেনি। কিশোরী ইন্দুবালার স্বপ্ন ছিল ঢাকঢোল পিটিয়ে, শঙ্খ বাজিয়ে তাকে বরণ করে নিবে শশুর বাড়ির লোকজন । বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, মন ভেঙ্গে গিয়েছিল ইন্দুর। ভাঙ্গা মন, ভাঙ্গা হৃদয় আর কোনদিন জোড়া লাগেনি তার।সেই যে গা ভর্তি গহনা নিয়ে কপোতাক্ষকে বিদায় জানিয়ে ছিল, আর কোনদিন ঘরে ফেরা হয়নি ইন্দুবালার।মাঝে মাঝে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করে খবরা-খবর নেওয়া হতো পিতা মাতার। ঠাম্মা, ছোট ভাই, পিতা -মাতা, শৈশবের প্রিয় বন্ধু মনিরুল কারো সাথেই শেষ দেখা হয়নি।
রতনলাল মল্লিকের নামের আগে মাস্টার শব্দটার যুক্ত থাকলেও আদতে তিনি মাস্টার ছিলেন না। বলা চলে জুয়া, মদ,তাসের ঘরে ডুবে থাকা মাস্টার ছিলেন তিনি।একসময় সমস্ত দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে তিন তিনটি সন্তান রেখে ওপারে পাড়ি জমালেন ইন্দুর স্বামী রতনলাল মল্লিক।মরে গিয়ে যেনো ইন্দুর বোঝাটা হালকা করেছিলেন, কারণ সংসারের প্রতি কোনো দায়িত্ব -কর্তব্য পালন করেনি।ইন্দুর গহনাগুলো একে একে খোয়া গিয়েছিল রতনলালের হাত ধরে।কাছের মানুষদের হারিয়ে, দিশেহারা ইন্দুবালা তিন সন্তান নিয়ে নেমে পড়ে জীবন যুদ্ধে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে ইন্দুবালার ভাতের হোটেল। সহায়- সম্বলহীন পিতা-মাতা, ভাই, স্বামী, শাশুড়িহীন জগত কতটা নির্মম আর অন্ধকার ছিল তারচেয়ে হয়তো আর কেউ সেটা ভালোভাবে অনুভব করতে পারবে না। সময়ের পরিক্রমায় ইন্দুবালার সন্তান সন্তানাদি, নাতি-নাতনি সবাই সবার মত করে প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্তানেরা তাকে দিল্লি, ব্যাঙ্গালোরে নিজেদের কাছে নিতে চাইলেও সত্তরের বেশি বয়সের ইন্দু ভাতের হোটেল ছেড়ে কোথাও যাবেনা, এ যেনো ছিল তার পণ। শুধু টাকার জন্য নয় বরং মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতো ইন্দুবালা। তাকে সহযোগিতা করার জন্য এসেছিল রক্তের সম্পর্কহীন, স্বার্থহীন কিছু মানুষ যার মধ্যে ধনঞ্জয় অন্যতম।
দেহ থাকে ছেনু মিত্তির লেনের পুরোনো দু’তলা ভবনের মল্লিক বাড়িতে, কিন্তু মন ছুটে যায় সেই কলাপোতায় গ্রাম,বোসদের পুকুর,তেপান্তরের ধানক্ষেত, কতবেলের আচার,উঠোন ভরা আচারের বয়াম,ঠাম্মার হাতের কচুবাটা,মালপোয়া,কপোতাক্ষের ধার ধরে কাশ ফুলের মাঠ।

“ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ নামের এক নির্জন দ্বীপে ইন্দুবালা সেই ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে রাখেন। সবাই আসে তাদের ভালোবাসা ভাগ করে নেয়।কিন্তু ইন্দুবালার কিছু ভাগ করার থাকে না।তিনি শুধু অফুরন্ত বিলিয়ে চলেন তাঁর স্মৃতি রান্নার এক পদ থেকে অন্য পদে।যারা বুঝতে পারে তারা একটু বেশি আনন্দ পায়। আর যারা খাবারের সাথে মজে থাকে তারা শুধু রসনায় মজা পায়। ভেতরের মানুষটার নয়।”




লেখাটি শেয়ার করুন

One thought on “ইন্দুবালার ভাতের হোটেল

Leave a Reply