উপসংহার
মো. মুয়াজ্জাজুর রহমান মুয়াজ ।।
(Grasshopper’s Tale)
“তুমি এখন আর গল্প লিখো না?’
নোরার প্রশ্নে মুহিব মুচকি হাসলো। মাথা উপর নিচ ঝাঁকিয়ে বলল,
“লিখি। কম।”
“কেন?”
“সময় পাইনা, আর ভালোও লাগে না।”
“সময় পাওনা কেন? পড়াশোনাও তো করো না, বাইরে ঘুরতে যাও না, খেলাধুলাও বাদ। কি করো সারাদিন?”
“সারাদিন কিছু করি না। চিন্তা করি কি করবো। শেষে আর কিছু করা হয় না। দিন শেষ হয়ে যায়।”
মুহিবের কথায় নোরা হাসলো। আজকে তার চোখেমুখে কোনো মেকআপ নেই। চুল থেকে মিষ্টি শ্যাম্পুর গন্ধও আসছে না। চেহারায় রোদের ছাপ বসে গেছে।মুহিব রিকশার হুড নামিয়ে দিয়েছে। রাস্তার দুপাশের গাছের পাতা গলে ঝকঝকে রোদ তাদের দুজনের মুখে পড়ছে। নোরা নিজের কপালের ঘাম মুছে মুহিবের দিকে তাকালো। মুহিবের চুল অনেক লম্বা হয়েছে। মাথাটা বড় লাগছে। চোখ গর্তে বসে গেছে, দেখলে মনে হয় অনেক রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। নোরা কিছুক্ষণ থেকে নীরব থেকে আবার কথা শুরু করলো।
“তোমাকে সব সময় এতো হতাশ, বিষণ্ন মনে হয় কেন মুহিব?”
“আমি যেমন তেমনই তো মনে হবে।”
“তোমার কিসের এতো দুঃখ? এই বয়সে তোমার এতো চিন্তা কেন?”
মুহিব আবার হাসলো।তারপর বলল,
“চিন্তার কি কোনো বয়স আছে বোকা? তুমি যখন ক্লাস ওয়ানের বার্ষিক পরীক্ষায় বসেছো, তখন তোমার চিন্তা হয়নি? এখন যখন প্রফের টেবিলে বসো, তখন চিন্তা হয় না?”
“হয়।”
“তবে? বয়সের সাথে আমাদের চিন্তার ধরণ পাল্টে হয়তো,কিছু না কিছু চিন্তা থেকেই যায়। ছোটবেলায় ছিলো পড়ার চিন্তা,এখন হয়েছে ক্যারিয়ার, প্রেয়সী, টাকা পয়সা এসবের চিন্তা।”
“তোমার এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না মুহিব। একটা কবিতা শুনাও। অনেক দিন শোনাও নি।”
মুহিব হো হো করে হাসলো।
“আমার কবিতা বা গল্প তো তুমি পড়ো না। জোর করে দেই দেখে না করতে পারো না।”
নোরা বিব্রত হলো। সে একটু দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“পড়িনা এমন না। মাঝে মাঝে মিস হয়ে যায়। ”
“সমস্যা নেই। না পড়লে নাই।”
“কেন?”
“কেন তো জানি না। তুমি না পড়লে আমার কি করার আছে বলো?”
নোরা কিছু বললো না। বিকেল গড়ানোর সাথে রোদের তেজ কমতে শুরু করেছে। নোরা আবার রুমাল দিয়ে নিজের মুখ মুছলো। মুহিব রিকশা থামিয়ে লাফ দিয়ে নামলো। অন্যদিন সে হাত ধরে নোরাকে রিকশা থেকে নামায়। আজকে সে নেমেই হাঁটা শুরু করেছে। একটা ছোট আইসক্রিমের দোকানে কয়েকটা বাচ্চার ভিড়। মুহিব সেদিকে হাঁটছে দেখে নোরাও হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো,
“আজকে তুমি একা একা নেমে গেলে কেন?”
“এমনিই।”
“সবকিছুতে এমনিই বলবে না।আমার রাগ হয়।”
“কেন?”
“কেন মানে? আমাদের ডিল কি ছিলো? রিকশায় ওঠার সময় আমি আগে উঠবো, আমি ঠিকঠাক বসার পরে তুমি উঠবে।নামার সময় তুমি আগে নেমে আমাকে হাত ধরে নামাবে। মনে নেই?”
“মনে আছে সব।”
“তাহলে?”
“তাহলে আর কি? নোরা, আমি এসব মনে রাখতে চাই না। মানুষের কাছে সবশেষ যে জিনিসটা থেকে যায় সেটা হলো স্মৃতি। আমি সেই জিনিসটা থেকে মুক্তি পেতে চাই।”
নোরা চুপ হয়ে গেল। মুহিব দুটো লাল আইসক্রিম কিনে একটা নিজের হাতে রেখে অন্যটা নোরার দিকে বাড়িয়ে দিল। আইসক্রিমের দোকান পেরিয়ে রাস্তার পাশে বাঁশের বেঞ্চি বানানো। সেখানে তারা বসলো। বিকেলের সূর্যটা ক্রমে আলো হারিয়ে নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে। নোরা অনুভব করলো তার কান্না আসছে। বুকের ভেতরে এক সাগর চিন্তা উথাল পাথাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। সে আইসক্রিমটা মুখে দিতে ভুলে গেছে। আইসক্রিম গলে হাত ভিজে গেছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে কান্না চেপে বলল,
“তোমার ফ্লাইট কবে?”
“দুই তারিখ রাত একটায়।”
“আবার কবে আসবে?”
“কবে আসবো সেটা তো জানি না। এখনো তো গেলামই না।”
“তোমার আসার ইচ্ছা নেই?”
“আছে। নোরা, আমাদের জীবনের বেশির ভাগ ঘটনাই আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে পরোয়া করে হয় না।আমরা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বারবার হেরে যাই।”
“কিভাবে?”
” তোমাকে আমি ভালোবাসতে চাইনি। কেন বাসলাম জানি না। আমি যতো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েছি, ততো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। অবসেশনের মতো হয়ে গেছে।”
“তুমি আমার একটা কথা শুনবে?”
মুহিব উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“উহু। শুনবো না। ”
“কেন?”
” শোনার সময় শেষ। তোমাকে যে কবিতার বই দিয়েছিলাম সেটা পড়েছো?”
“নাহ। পড়বো সময় করে।”
মুহিব শুকনো করে হাসলো। বিকেলটা দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে আস্তে আস্তে অন্ধকার নামতে শুরু করেছে।
“চলো নোরা চলে যাই।”
নোরা উঠতে পারলো না। তার শরীর অবশের মতো হয়ে গেছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিছু বলার, নিজের কান্না আটকে রাখার। পারছে না। অন্ধকারে মুহিব সব সময় নোরাকে একপাশে রেখে হাঁটতো। আজকে মুহিব একাই হাঁটতে শুরু করেছে। নোরা বুঝতে পারলো, এতোদিন সে যাকে অবহেলা করে এসেছে, তার অবহেলা সে সইতে পারবে না!
মুহিব সচরাচর নোরাকে তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজের মেসে যায়। আজকে সে আগেই নেমে গেল। নোরা একা বাসায় গেল। যাওয়ার আগে চিরকুটে মুহিব প্রতিদিন এক দু লাইনের কবিতা লিখে দিতো। চার বছরের পরিচয়ে কখনো এটা ভুলে যায়নি। আজকে সে ভুলে গেল। নোরা রিকশা থেকে নেমে নিজের ঘরে ঢুকলো। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। সে কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না।
রাত দুটো বাজতে চার মিনিট বাকি। নোরার ঘরে রেডিয়াম ঘড়িটা জ্বলজ্বল করে সময় বলছে। বাইরে চমৎকার একটা চাঁদ উঠেছে। একটু আগে মুহিব চলে গেছে। ইংল্যান্ডে তার স্কলারশিপ হয়েছে। নোরা ভাবতে পারেনি মুহিব এতো নীরবে চলে যেতে পারে! সে ভেবেছিলো মুহিব কাঁদবে, বিমানে উঠার আগে নোরাকে ফোন দিয়ে বিদায় নেবে। মুহিব কিছুই করলো না। মাস তিনেক আগে যখন মুহিবের ভিসা হলো, তখন সে একটা বই দিয়েছিলো নোরাকে। অনেক মোটা বই। মুহিব বলেছে, বইটা এক কপিই করেছে সে। শুধু নোরাকে দেয়ার জন্য। পড়বো পড়বো করে নোরার আর পড়া হয়নি। আজকে নোরা বইটা খুলে বসলো। বইয়ের প্রথম আশি পৃষ্ঠা শুধু নোরাকে নিয়ে রচনা লেখা। মুহিব কি চায়, কি করবে ভবিষ্যতে সব। বেশ কয়েকটা ভবিষ্যতদ্বাণী লেখা।পড়ার পরে নোরা চমকে উঠলো। সবকিছু একেবারে মিলে গেছে। ছেলেটা এতো নিখুঁতভাবে জীবনকে কিভাবে পড়লো? নোরা কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না। একাশি পৃষ্ঠা থেকে কবিতা শুরু। মোট কবিতার সংখ্যার পাঁচশ একাত্তর! নোরা পড়তে পারলো না। বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখাটুকু তার চোখে পড়লো। কবীর সুমনের বিখ্যাত গানের দু লাইন সেখানে লেখা,
“ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করো,
প্রেমের পদ্যটাই,
বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি
শুধু তোমাকেই চাই!”
নোরা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে মুহিবকে ফোন দিতে চাইলো। শেষ মুহূর্তে আটকে গেল। এক অদৃশ্য পিছুটান তাকে আটকে দিলো। সে বইটা বন্ধ করে জহিরকে ফোন দিলো। জহিরের সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা।
মুহিব যখন এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালো, তখন সে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মোবাইলটা তার কাছে খুব ভারী মনে হচ্ছে। সে চলে যাওয়ার কথাটা কাউকে জানায়নি। সে আশা করেছিলো, নোরা নিজে থেকে ফোন দিয়ে এয়ারপোর্ট আসবে। এসে তাকে কিছু বলবে।
নোরা এলো না। বিমানটা যখন আকাশে ভেসে ভেসে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিচ্ছে, মুহিব তখন জানালায় মুখ রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে নিচের মিটমিট করা পৃথিবীতে হঠাৎ সে নোরাকে দেখতে পাবে। হাত বাড়িয়ে ডাকবে, তাকে ছুঁতে চাইবে!