একটি পুঁটির আত্মকাহিনী

গল্প, ছোটগল্প, স্যাটায়ার
লেখাটি শেয়ার করুন

ফাইয়াজ ইফতি।। 

 

‘খেলি ছিনিমিনি ছিনিমিনি মন নিয়ে আমি ম্যজিক মামনী!’, বিকট শব্দে স্পীকারে গান বাজছে আর মুন্না উদ্ভটভাবে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছে। ওর দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্য নাচ বন্ধ হচ্ছে না। ট্যারা মজনু বত্রিশপাটি দাঁত বের করে ভিডিও করছে আর নাক চুলকাচ্ছে। ট্যারা মজনু হলো কালা শাকিলের বাম হাত। মুন্নার এই আজব কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছে একটা নির্দোষ ফেসবুক কমেন্ট থেকে। কোয়ারান্টাইন এর বিরক্তিকর দিনগুলো যেন কাটছিলো না মুন্নার। মজা করার জন্যই রাদিফের দশ বছরের পুরানো আজব একটা ছবিতে গিয়ে টাকলা ভাষায় কমেন্ট করে বসলো, ‘নায়েস লাগছা’। সাথে সাথে মুন্নাদের পুরো সার্কেল ছবিতে হাহা রিয়েক্ট আর কমেন্ট এর বন্যা বইয়ে দিতে লাগলো। কথায় আছে, ‘শেয়ালকে ভাঙ্গা বেড়া দেখাতে নেই’। রাদিফ তো তক্কে তক্কে ঘুরছে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, কিন্তু অতি চালাক মুন্না তার সকল পুরাতন আজগুবি ছবিগুলো অনলি মি করে রেখেছে। রাগে দুঃখে রাদিফ মুন্নার প্রোফাইল পিকে গিয়ে কমেন্ট করে বসলো, ‘মুন্না ভাইয়ের টিকটক ভিডিও চাই!’ আর যায় কোথায়? এই কমেন্ট এতো বেশী মার্কেট পেলো যে পুরো ১২৩ টা হাহা রিয়েক্ট পড়লো কমেন্টে। এদিকে মুন্নার গার্লফ্রেন্ড জান্নাত তো কমেন্ট দেখে রেগে কাঁই। তৎক্ষনাৎ মুন্নাকে মেসেজ করলো, ‘তোমাকে ওরা টিকটক করতে বলছে কেন।’ মুন্না বার বার ওকে বোঝায় যে এতে মুন্নার কোন দোষ নেই, পোলাপান ওর সাথে মজা করছে। কিন্তু জান্নাত কিছুতেই বুঝতে চায় না। ওর এক কথা, ‘নিশ্চয়ই তুমি সন্দেহজনক কিছু করেছ, নাহলে ওরা এতো কিছু থাকতে টিকটক ভিডিও চাইবে কেন? তোমার ব্যাপারে অনেক কানাঘুঁষা শুনসি আমি। যে করেই হোক কমেন্ট টা ডিলিট করাও, নাহয় সারাজীবনের জন্য টা টা বাই বাই।’ জান্নাতের মেসেজ যেন মুন্নার জীবনে জাহান্নাম নামিয়ে আনলো। কানাঘুঁষার ব্যাপারটা জান্নাত মিথ্যা বলেনি। আসল ব্যাপারটা হয়েছিলো এরকম, মুন্না কলেজে থাকতে একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলো যেটা তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার আদায়ে কাজ করে। কিন্তু কোন এক ফাজিল মুন্নার মায়ের কাছে এসে বলেছিলো, ‘আন্টি, আপনার ছেলে তো হিজড়াদের দলে যোগ দিসে’। মুন্নার মায়ের তো মাথায় হাত। মুন্না বাসায় ফেরার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে তুই নাকি হিজড়াদের…..’, মুন্না ভাবলো হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের ব্যাপারে উনি জেনেছেন, তাই উনার কথা শেষ না করতে দিয়েই তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঐ সংগঠনে যোগ দিয়েছি’। ব্যাস আর যায় কই? মুন্নার মার চিৎকার আর কান্নায় ঐদিন পাড়ায় কাক চিল বসেনি। ‘তোমরা কে কই আছো গো, আমায় বাঁচাও গো, আমার পোলায় তো হিজড়া হয়ে গেলো গো, আমার একটা মাত্র পোলা গো’ বলতে বলতে তিনি প্রায় মরাকান্না জুড়ে বসলেন। অনেক কষ্টে উনাকে মুন্না সবকিছু বুঝিয়ে ঠান্ডা করলো, কিন্তু পুরো পাড়ায় একটা কানাঘুঁষা রয়েই গেলো। মুন্না ঐ সংগঠনেও আর কাজ করেনি এইসব উড়োকথায় যন্ত্রণায়। এই কথাগুলোই শুনে থাকবে হয়তোবা জান্নাত। আর এদিকে এসব গুজবের আগুনে ঘি ঢাললো রাদিফের কমেন্ট। মুন্না অসহায় হয়ে রাদিফকে ফোন দিলো বারকয়েক। কিন্তু হারামীটা ফোন তুলছে না। শেষে করোনার ভয়কে পাশে সরিয়ে রেখে ও গেলো রাদিফের বাসায় সাথে নিয়ে গেলো এক প্যাকেট গোল্ডলীফ। ও জানে রাদিফ এমন টোপ না গিলে থাকতে পারবে না। এক প্যাকেট সিগারেট, অনেক অনেক তৈলমর্দন আর ফেরার পথে পাছায় পুলিশের দু’টো লাঠির বাড়ির বিনিময়ে মুন্না কমেন্টটা ডিলিট করাতে সক্ষম হলো। ভেবেছিলো এবার হয়তো ওর জীবনে শান্তি নেমে আসবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর ঘটে আরেক। কোয়ারান্টাইন এর দরুণ মুন্নার সার্কেলের সবাই ঘরবন্দী, সবার জীবনেই বিনোদনের তীব্র অভাব। ওরা বেশ মজা নিচ্ছিলো মুন্না-রাদিফের কমেন্ট যুদ্ধ। কিন্তু হঠাৎ পূর্ব পল্টন শান্ত হয়ে পড়ায় ওরা বেশ আশাহত হয়ে পড়লো। এমন অবস্থায় মুন্নার দুচোখের বিষ শুভ ভাবলো জাতিকে উদ্ধার করাটা এখন ওর ব্যাক্তিগত দায়বদ্ধতা। ও মুন্নার ওয়ালে গিয়ে লিখে দিলো, ‘মুন্না ভাইকে আলিফ লায়লায় দেখতে চাই’। ওর পোস্ট দেখে নাসিম ভাবলো, শালা শুভর থেকে আমার ট্যালেন্ট কি কম নাকি? ও মুন্নার টাইমলাইনে লিখলো, ‘মুন্না ভাইকে বদনা মার্কায় ভোট দিন’। তারপর মুন্নার ওয়ালে যেন আগুন লেগে গেলো। কেউ ওর কাছে চিকন পিণের চার্জার চায়, কেউ ওর বেলী ড্যান্স দেখতে চায়, কেউবা চায় ডেইজী আপার পুঁটীতে মুন্না ভাইয়ের ইলিশ দেখতে! এই ডেইজী আপা সেই বিখ্যাত ডেইজী আপা নয়, মুন্নার পাড়ার ত্রাস কালা শাকিলের বড়বোন ডেইজী আপা। অসহায় মুন্না বাধ্য হয়ে ফেসবুক আইডি ডিএক্টিভেট করলো। কিন্তু পোস্টের স্ক্রীনশট হয়ে গেলো ভাইরাল। সকল ট্রলপেজ মিমপেজে ঘুরছে একটাই স্ক্রীনশট, ‘ডেইজী আপার পুঁটীতে মুন্না ভাইয়ের ইলিশ দেখতে চাই’। রাগে দুঃখে কালা শাকিল রায় দিলো ‘ধইরা আন হমুন্দির পুতেরে’। মুন্নাকে ধরিয়ে এনে তলপেটে চাকু ঠেকিয়ে নরম গলায় বললো, ‘চুপচাপ নাচ না হলে ডিম ফুটায়া মামলেট বানায়া, ঐটা কুত্তারে খাওয়ামু’!
তারপর স্পীকারে ছেড়ে দিলো, ‘ খেলি ছিনিমিনি ছিনিমিনি মন নিয়ে আমি ম্যজিক মামনী! ’


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply