একবিন্দু উপহার
শুচিস্মিতার লেখনী।।
“অপা, কোথায় তুমি? এ্যাই অপা, অপা আ আ আ আ আ!” অফিস থেকে ফিরে এসে নওশাদের হাঁকডাক শুরু হয়ে গেলো। এই ছেলে যে এত জোরে জোরে ডাকাডাকি করে বিয়ে হবার আগে আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।
“আররে অস্থির হচ্ছো কেনো? এই রকম করে কেউ ডাকাডাকি করে, মানুষ কি বলবে?” আমি রীতিমতন বিরক্ত, অফিস থেকে এসে এই সময়টা আমি ব্যালকনিতেই থাকি, সেই যে উঁচু উঁচু অট্টালিকায় ছেয়ে যাওয়া ব্যালকনিটায়, কিছুদিন হলো সেখানে দোলনাও বসানো হয়েছে।
“ওহহো এইতো তুমি, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ছেড়ে দাও মানুষের কথা, আজ নিয়ে এসেছি তোমার জিনিষ” বেশ খুশি খুশি মনে সে বললো।
ভাবখানা এমন যেনো বিশ্বজয় করে ফেলেছে! “আচ্ছা, দাঁত কেলানো বন্ধ করে দেখাও দেখি, জীবনেও তো ঠিকঠাক কিছু কিনে আনতে পারোনা, বিশেষত আমার জিনিষপত্র গতবারো ভুলভাল জিনিষ নিয়ে এসেছো, টাকা পয়সার গচ্ছা।”
“আহা! এই ক’টা টাকার জিনিষ, আচ্ছা আচ্ছা, টাকা মানে টাকা, এক টাকাও অনেক কিছু, আমি জানি। ইয়ে মানে হয়ে গেসিলো গতবার একটা ভুল কিন্তু এইবার ঠিক জিনিষ নিয়ে এসেছি, এই দেখো!” বলে মহারাণীর হাতে ছোট্ট জিনিষটা দিয়ে দিলাম। একটা গান এত্ত গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু অপার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে গাট্টা খাবো এটা নিশ্চিত, বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম।
জিনিষটা হাতে নিয়ে মিনিটখানেক উল্টে পাল্টে দেখার পর অপার পছন্দ হলো। আনন্দে গদগদ হয়ে সে আবদার বা আদেশ করলো, “এই পরিয়ে দাও তো, ঠিকঠাক মাঝখানেই যেনো হয়।”
“এই রে, সেরেছে, বড্ড কঠিন কাজ, তাও চেষ্টা করে দেখি।”
“হাত কাঁপছে কেনো, এক্কেবারে মাঝখানে পরাও”
“হুম, পরালাম, দেখো তো হয়েছে কিনা?”
দশ সেকেন্ড ধরে পর্যবেক্ষণ করে, “উমম, হয়েছে। যাক, এই জন্মে আর সতীনের ঘর করা লাগছে নাহ!” তোমাকে এত কিছু শিখিয়ে দেওয়া লাগবে জানলে বিয়ে করার আগে আরো দশ বার ভাবতাম। একটা টিপ পরাতে যার এত্ত সময় লাগে, তার সাথে ঘর করা যে কত্ত ঝামেলার যার ঘর সেই বোঝে, হুহ। মনে মনে কিন্তু আমি বেশ খুশি, যাক, ছেলেটা অন্তত আমার শখের জিনিষটা কিনতে পেরেছে, আমি তো এতটুকুনই চেয়েছিলাম।
“হা হা হা, আমার লাগলেও লাগতে পারে সতীনের ঘর! ইয়ে মানে তোমাকে কেউ ছিনতাই করে নিলে আমি কিন্তু তোমার সাথেই ছিনতাই হয়ে যাবো, বলে রাখলাম।”
“আহ মরণ, কথার ছিরি দেখো, তোমার সন্ধ্যার চা আজ বন্ধ, এসব ফালতু কথার জন্য”
“আচ্ছা রে আমার অর্ধাঙ্গিনী, আর বলবো নাহ। তবে শুধু টিপ দিলে আমার হবে নাহ, আরেকটা জিনিষ না পরলে এই টিপটা পূর্ণতা পাবে নাহ। সুতরাং…”
“উফ নওশাদ, এই ভর সন্ধ্যেয় আমি কাজল পরতে পারবো নাহ, প্লিজ”, আসলেই পাগলের সাথে সংসার করছি।
“নাহ ম্যাডাম, পরতেই হবে, প্লিইইইজ, অন্তত ঠিকঠাক টিপ (মানে এক ফোঁটা সমান কালো টিপ, ঠিকঠাক সাইজের আর কি! সাইজ উল্টাপাল্টা হওয়ায় গতবার দুদিন কথা বন্ধ ছিলো আমার সাথে) আনার জন্য এইটুকুন পুরস্কার আমি পেতেই পারি, তাই নাহ? আমি বুঝি নাহ, কাজল পড়তে তোমার এত্ত আপত্তিই বা কোথায়? পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র মেয়ে যে এই সুন্দর জিনিষটা পড়তে গরিমসী করে, যাও যাও পড়ে নাও।” ভরসন্ধ্যে কোথায়, সবে মাত্র সাড়ে ছ’টা বাজে! আভি তো রাত বাকি হ্যায়
“কথার বাহার দেখো, পড়ছি পড়ছি, জন্মের আদিখ্যেতা।” অতঃপর দুইচোখে পড়া হলো, মানে দু’চোখ ভর্তি করে পড়িনি, হালকা টান দিয়ে দিলাম আর কি। আমার পছন্দ এরকমই। দু’চোখ ভর্তি করে কাজল পড়বার দিন আজ নয়।
“তুমি একটু আমার সামনে দাড়াও, আমার মায়াবতীকে আমি দুচোখ ভরে দেখে নিই, উঁহু অপা এই মুহূর্তে তুমি একটাও কথা বলবে নাহ, স্ট্যাচু।” আর আপনারা এবার তবে আসুন। অনেক শুনলেন অপা নওশাদের আলাপ, অন্য কোনোদিন আবার কথা হবে, দাঁড়ান দাঁড়ান, গানটা শুনে যান, নতুবা আক্ষেপ থেকে যাবে, কি বলেন?
“এ রাতের আকাশে নেই কোথাও আজ কথা সান্ত্বনার আগামী ভোরে এ আমাকে দেখবেনা তুমি আর তবু কপালের এ কালো টিপ দেখবে চেয়ে যখন ভেবো যত দূরে থাকি করব স্মরণ ভালোবাসা রয়ে যাবে আগেরই মতন”
এই মুহূর্তের সাথে হয়তো বা গানের মিল নেই, তাও আমি তো এমনই আপনারা জানেন।