এক নারী ও রাজার কাহিনী: পঞ্চম পর্ব
সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।
অনুপমা ছোটো থেকেই বিভিন্ন ফুল ওফলের গাছের ভক্ত। তাছাড়া যে কোনো গাছের কাছে গেলেই সেই গাছের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পরে। গাছটার সঙ্গে কথা বলে,আদর করে, গোড়ায় হাত বুলিয়ে দেয়। সে বলে বাড়ির উঠোনের আমগাছটাকে,কি রে আমি আগের জন্মে তোর বোন ছিলাম? বুঝলি আমি আগের জন্মে আবার গাছ হবো। তোর ডালে ডালে আমার সোহাগ উথলে ওঠে। আমি তোর বোন হবোই। সুন্দর সহজ সরল জীবন নিয়ে আমি সুস্থ রাখবো জগতের সমস্ত জীব কুলকে। আমি গাছ হবো।
উঠোনের আমগাছটার ইতিহাস আছে। অনুপমার দাদু বি,ডি,ও অফিস থেকে চারা এনেছিলেন। তিনি উঠোনে ছায়া হবে, আর সিজনে কিছু আম পাওয়া যাবে বলে গাছটা লাগালেন। গর্ত খুঁড়তে গিয়ে হাতটার আঙুলে কোদালের চোট পরে কেটে গেছিলো সেদিন। অনুপমার ঠাকুমা রেগে বললেন,উঠোনের মাঝে আমগাছ লাগালে। তারপর আবার বাধা। অপয়া গাছ। পাতা পরে জঙ্গল হবে।দাদু কোনো কথা বলে নি। শুধু বলেছিলো,খবর্দার এই গাছে কেউ যেনো হাত না দেয়। কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়বো।
তখন অনুপমা ছোটো। অনুপমা বললো থাক,ঠাকমা আমি পাতা পরিষ্কার করবো। তারপর ঠাকুমা, নাতনির মুখ চেয়ে আর কিছু বলেন নি। দাদু এবার দুবছর পরে বাড়ি এসেছে।থাকে অনেকদূরে। অনুপমা ভাবে,কেন,এতদূরে থাকে দাদু। একদিন ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবে। কিন্তু বলতে সাহস হয় না। ঠাকমা যদি বকাবকি করে।
তারপর অনেক বৈশাখ কেটে গেলো। শেষে অনুপমার আঠারো বছর বয়সে আমগাছের মুকুল এলো। এতদিন গাছে জল দেওয়া, পাতা কুড়িয়ে পরিষ্কার করা সবকাজ সে নিজেই করেছে। তার ভালো লাগে তাই করে। আমের শুকনো পাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিতো। পরিষ্কার হতো তাড়াতাড়ি।
বাবা, মা কে অনুপমার মনে পরে না। দাদুর কাছে শুনেছে, সে যখন এক বছরের মেয়ে তখন তার বাবা রোড আ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। মা তার এক বছর পরেই বাবার বাড়ি চলে যায়। মা তাকে নিয়ে যেতে চাইছিলো কিন্তু দাদু দেন নি। দাদু বলেছেন,ছেলের স্মৃতিটুকু তুমি নিয়ে যেও না বৌ মা। তাহলে আমি বাঁচবো না। আমার আর কেউ নেই ও ছাড়া। মা তারপর আর জোর করেন নি। একা চলে গিয়েছিলেন কাঁদতে কাঁদতে কোনো প্রতিবাদ না করে। তার মা নাকি এখন বিয়ে করেছে অনেক দূরে। মায়ের মুখ অনুপমার মনে পরে না। তাই মায়ের মায়া তাকে কাবু করতে পারে না। অনুপমা দেখতো,দাদু থাকে না বাড়িতে। তবু একটা ফর্সা, কটাপারা লোক ঠাকুমার ঘরে যায় প্রায়। তাকেও চকলেট দেয়। কিন্তু জানে না লোকটা কে? পাড়ার লোকেরা ওকে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু ও বলে,আমি জানি না। তখন সবাই মুখ টিপে হাসে। ভালো লাগে না তার। মনে মনে বলে,একদিন ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে। কিন্তু ঠাকুমা যদি রেগে যায়।
একদিন দুপুর বেলা ঘুঙুর পরা হাঁসটা কেমন হেলেদুলে চলেছে। অনুপমার পিছনে পিছনে চলেছে হাঁসটা। তাকে এখন সরস্বতী ঠাকুরের মতো লাগছে। বাহন তার চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। ঘাটে শান বাঁধানো সিঁড়িতে সে বসে পরলো। আর হাঁসটা উড়ে গিয়ে পরলো জলে। ডুব দিয়ে তাকে খেলা দেখিয়ে চলেছে। সে জলে ঝুঁকে পরা গাছটার ডাল ধরে তুলে আনলো পানিফল। ছাড়িয়ে খেতে গিয়ে পানিফলের কাঁটা ফুটে গেলো। লাল এক ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পরলো মাটিতে। পাশে চাঁদু এসে বললো,দে দে আঙুলটা দে। অনুপমার আঙুলটা মুখে নিয়ে চুষতে লাগলো। তার খুব সুড়সুড়ি পেলো। সে হাসতে লাগলো। রাজু বললো,জানিস না,মুখের লালায় ঘা পর্যন্ত ভালো হয়ে যায়। রাজু আঙুল ছাড়ছে না, খুব ভালো লাগছে। সেও জোর করছে না।
একটা ভালো লাগা শিরশিরে ভাবে সে বিহ্বল। সে আঁচল থেকে কটা পাকা কুল দিলো রাজুকে, হাত ছাড়িয়ে। রাজু বললো,তোর সব সময় কাঁটা নিয়ে কাজ। কুলগাছেও কাঁটা থাকে। সে হাসতে হাসতে বললো,তুই তো আমার মিষ্টি কুল। তাইতো কাঁটা ভালোবাসি। রাজু পাশের পাড়ায় থাকে। কিন্তু তার সঙ্গেই তার ভাব বেশি। রাজু বলে অপরূপাকে,আমার মাকে আমার বাবা রোজ মারধোর করে। মাথা ফাটিয়ে দেয়। বড়ো হয়ে আমি এর শোধ নেবো। অনুপমা বলে,ওসব বলতে নেই। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজু বলে,কিচ্ছু ঠিক হবে না। একটা রাক্ষস আমার ভেতরে আছে। তবু আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি। তুই আমার থেকে সাবধানে থাকিস। রাক্ষসটা কখন জেগে উঠবে আমিও জানি না।
অনুপমার ভয় হয়। তার মনে পরে, রাজু আর চাঁদু তার দশজন বন্ধু, পুজো বাড়ির শ্যাওলা পড়া দেয়াল ঘেঁষে বসতো। পিঠে সবুজ ছাপ পরে যেতো। পুরোনো কারুকার্যের মুগ্ধতা ছাড়িয়ে ভালোবাসার গান বিরাট বাড়িতে প্রতিধ্বনি শোনাতো। বন্ধুদের মধ্যে চারজন মেয়ে ছিলো। দেবীকা বলতো, বন্ধু শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ করিস না। ভালো শোনায় না। কোনোদিন রাজু তাদের মেয়ে মনে করেনি। বন্ধু তো বন্ধুই। তার আবার ছেলে আর মেয়ে কি?বলতো রাজু। একই কাপে তারা কফি খেতো পুজো বাড়ির পাশের কফি হাউসে । ভাগে কম হলে রূপসী বলে বন্ধুটা রাস্তায় লোকের মাঝে দীনেশকে ফেলে মারতো খুব।তাদের বন্ধুদল বিপদে,আপদে কাজ করতো গ্রামে। তাই তাদের অনেকেই সম্মান দিতো। আর আদরের এই মার খেতেই দুষ্টুমি করে তার ভাগেরটা কম রাখতো। অভিভাবকরা কোনোদিন ছেলে মেয়েদের মেলামেশায় বাধা দিতেন না। দরজা ঘাটের বাঁধানো ঘাটে পানকৌড়ি আর মাছরাঙার কলা কৌশল দেখে পার হয়ে যেতো অবাধ্য সময়।
অন্ধকারে ফুটে উঠতো কালীতলার সার দেওয়া প্রদীপ। ঘরে ঘরে বেজে উঠতো শঙ্খধ্বনি। হাতগুলো অজান্তে চলে যেতো কপালে। তারপর হাত পা ধুয়ে ভাইবোন একসাথে বসে সরব পাঠের প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেতো পাড়া জুড়ে। কিন্তু অনুপমার ভাইবোন ছিলো না। সে চুপচাপ পড়তো। নীরব পাঠ। আর তার ফলে তার মনে ভেসে উঠতো রাজুর মুখ। বইয়ের পাতা জুড়ে প্রেমের খেলা।
কে কত জোরে পড়তে পারে,পাড়ায় প
রতিযোগীতা চলতো। একবার অতনুদের বাড়ি পড়তে গেছিলো অনুপমা মাটির দোতলা ঘরে। বুলু কাকা বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন অতনু পড়ছে, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়। ঘরে ঢুকে কাকা বললেন,ন্যাটিওনাল নয় ওটা ন্যাশনাল। ঠিক করে পড়। অতনু জোরে পড়ছে বলে উচ্চারণটা ঠিক হলো। এই অতনু সেদিন বুলুকাকা যাওয়ার পরে তার পাশে বসে পড়ছিলো। আর বারবার তার হাঁটুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো। তারপর একটা আঙুল তার প্যান্টের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যোনীপথে। খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো ভিতরে। পড়া হয়ে গেলে সে চলে এলো নীচে।
তারপর পড়া হয়ে গেলে একান্নবর্তী পরিবারের সবাই উঠোনে খেতে বসলো।অনুপমা দেখলো, কি সুন্দর পরিবেশে অতনু বড়ো হচ্ছে। রাজুর বাড়ি যদি এই পাড়ায় হতো, তাহলে বেশ হতো। আলাদা করে কোনো শিশুকে খাওয়া শিখতে হতো না,জোর করতে হতো না। সবার খাওয়া দেখে ধীরে শিখে যেতো নিজে খাওয়ার কায়দা।পরের দিন রাজুকে গল্প বললো। অতনুদের বাড়িতে পড়তে যাওয়ার গল্প। কিন্তু আঙুলের কথা বলতে পারে নি লজ্জায়।
রাজু শুনে বলতো, আমাদের কাকার মেয়ে, ছেলে সবাই পড়তে আসে আমাদের বাড়িতে। আমরা শুই সবাই একসাথে। কাকার মেয়ের সাথে মারামারি করি। শোওয়ার পালা আরও মজাদার। বড় লেপে তিন ভাই,বোনের ঢাকা। কেউ একটু বেশি টানলেই খেলা শুরু হয়ে যেতো রাতে। কোনো কোনো দিন ভোরে। মা আরও ভোরে উঠে শীতকালে নিয়ে রাখতেন জিরেন কাঠের খেজুর রস। সকালে উঠেই খেজুর রস। সেই দিনগুলো আর কি ফিরবে? বড় মন খারাপ হয় বড়ো হয়ে যেতো রাজুর।রাজুর গল্প শুনে অনুপমার অপরাধবোধ কমে যেতো। সে ভাবতো,তাহলে রাজুও কাকার মেয়ের সাথে এরকম করে। ওর তো নিজের কাকা নেই। পাড়ার কাকা হবে হয়তো। তাহলে রাজু তো সব কথাই বলে। ওগুলো বলে না কেন? ওসব বলতে নেই। সে ভাবে,চিরকাল ছেলে মেয়েরা গোপন করে যায় ভালোলাগার কিছু মূহুর্ত। এগুলো হয়তো বলতে নেই। আকাশ পাতাল চিন্তা করেও হিসেব মেলাতে পারে না অনুপমার মতো কিশোরী মেয়েরা।
তারা একসাথে ঘুরতো।অনুপমারা খেলতো নানারকমের খেলা। চু কিত-কিত,কবাডি,সাতগুটি,ঘুরি ওড়ানো,ক্রিকেট,ব্যাডমিন্টন ও আরও কত কি। বন্ধুরা জড়ো হলে,এলাটিং,বেলাটিং সই লো,যদু মাষ্টার কইলো…, তারপর আইশ,বাইশ কত কি। হাততালি দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খেলতাম,কাটুরিস,চায়না প্লিজ,মেম সাব, মেইন আপ… । তারপরের কথা, খেলা ডুব দিয়েছে কোন অতলে জানিনা, অনুপমা বলতো, সব কথা পুরো মনে পরে না। ছেঁড়া, ছেঁড়া স্মৃতিগুলো হৃদয়ের পদ্মপুকুরে ভেসে উঠেই ডুব দেয়, আর হারিয়ে যায় ব্যস্ত সময় সংসারে। সেখানে আবেগ মানে ছেলেখেলা পাগলামি। তবু তার মনে হয়, এরকম পাগলের সংখ্যা আরও বাড়ুক। বাড়লে পাওনাটা মন্দ হয় না। ভালো পরিবেশে মানুষ হয়েছে অনুপমা ও রাজু। সেই রাজুর মনে কি করে রাক্ষস ঢুকলো বুঝতে পারে না অপরূপা। সে ভাবে,মানুষ হয়তো পাল্টে যায় পরিস্থিতির চাপে । যে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে হয়ে যায় ডাকাত। আর যে সংসারী হয়ে সুখে থাকতে চায় সে হয়ে যায় খেলার পুতুল, রূপাগাছির অপরূপা বেশ্যা।
অনুপমা ভাবে, তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি পেয়েছি। পুরস্কার বলতে মানুষের আদর, ভালোবাসা। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই। আমার যোগ্যতার বেশি, তার পরিমাণ। ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু দিতে ভোলেন না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা। সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না বা পিছিয়ে যাবে না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অন্য মানুষকে সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর। মানুষের জন্যই মানুষ। শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম হচ্ছে অণুবিক্ষণের মতো। ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে। পোকা, মাকড়ও ঈশ্বরের করুণা থেকে বাদ পরে না। ভাবনা আমার ভালো কিন্তু ভাগ্যের চাকাটা যে বনবন করে ঘোরে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে।
অনুপমা কদিন ধরেই দেখছে রাজু কতগুলো ছেলের সঙ্গে মেশে। তাদের কোনোদিন দেখে নি সে। রাজুকে জিজ্ঞাসা করলল বলে,অনেক দূরে বাড়ি ওদের। এখানে এলে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়। অনুপমা বলে,তুই খারাপ হয়ে যাস না, ভালো হয়ে থাকিস। তুই আমার জীবনের ভরসা। আমার ভালোবাসার ধন।
রাজু ভাবে,অনুপমা আমাকে ভালোবাসে। সে আমাকে ভালো হতে বলে। আর তো আমরা ছোটো ছেলে নই। বড়ো হয়েছি। বুঝতে শিখেছি ভালোমন্দ। কি করে সে ভালো হয়ে থাকবে। বাড়িতে নিত্য নতুন অশান্তি। বাবা,মায়ের মারামারি। মা সন্দেহ করে বাবাকে। এখন আমিও সন্দেহ করি বাবাকে। বাবা রোজ রাতে কোথায় যায়?বারোটার পর বাড়ি ফেরে। এত জানাশোনা আছে তার। তবু সে জানতে পারে না। রাজু ভাবে,কোনোদিন যদি জানতে পারি, আমার বাবাকে কেড়ে নিচ্ছে কে? আমি তাকে খুন করবো। আমাদের বাড়িতে অশান্তি ঢোকানোর বদলা আমি নেবোই। অপরূপা বলে,তুমি পুলিশকে জানাও,আইনের সাহায্য নাও।
কিন্তু বাবার ভয়ে অতদূর এগোতে সাহস হয় না। তবে মনে মনে ভাবে সে,এর শেষ দেখে ছাড়বো। রাজু মা কে বলতে শুনেছে,তুমি অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করা ছেড়ে দাও। অন্য মেয়েছেলের সঙ্গ ছেড়ে দাও। অন্যায় করে রোজগার করা ছেড়ে দাও। তা না হলে আমি রোজ তোমার সঙ্গে অশান্তি করবো। রাজু ভাবে,কি করে একটা ভালো ছেলে বড়ো গুন্ডা হয়ে যায়,ডাকাত হয়ে যায়। খুনি হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় পাগল সেজে,মাতাল সেজে। পরিবারের পরিবেশ ভালো না হলেই এইসব হয়।
এক নারী ও রাজার কাহিনী: ষষ্ঠ পর্ব
২ comments