সুদীপ ঘোষাল

এক নারী ও রাজার কাহিনী: প্রথম পর্ব

উপন্যাস
লেখাটি শেয়ার করুন

সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।

 

ঈশানী নদীর পাড়ে জনপতি গ্রাম।হারুদাদু বলেন,এই গ্রামে পাঁচশো বছর আগে এক রাজা এসে বড় অট্টালিকা করেছিলেন এক সুন্দরীকে ভালোবেসে।সেইসব আর নাই।কালের প্রবাহে ভেসে গেছে।গ্রামে দুইশত পরিবারের বাস।বেশিরভাগই মাটির বাড়ি।সন্তুদেরও মাটির বাড়ি।

সন্তু ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা। মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না,চেনে না। ফলে মায়ের স্নেহছায়া একটু বেশি পেতো সে। মা জানতেন এই ছেলে আমার অবর্তমানে অন্য ছেলেমেয়েদের দেখবে। সন্তুর বাবা ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে সমস্ত ব্যবস্থা করেচেন। খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা নেই। বেশ চলছিলো বটগাছের ছায়ায় সাতটি জীবন। কিন্তু মহাকালের বিচার মানতেই হবে। হঠাৎ মারা গেলেন সন্তুর বাবা।
তখন সন্তুর বয়স একুশ। মেট্রিক পাশ করে আই,টি,আই এ ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু অর্ধপথে পড়া থেমে গেলো। সংসারের সমস্ত দায়ীত্ব কাঁধে তুলে নিলো সন্তু। বাবার চাকরীটা সরকার বাহাদুর দিলেন সন্তুকে। এবার ভাই, বোনদের পড়াশোনা, মাকে যত্ন করা সব অই সন্তুর সামান্য মাইনের টাকায়। নতুন চাকরী তাই মাইনে কম। ট্রান্সফারেবল্ জব। আজ হাওড়া তো কাল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থাকাকালীন ছুটির দিনে ঘুরতো সন্তু একা। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলো। পাহাড় তাকে ডাকতো। ভালোবাসা
ধরে রাখতো সবুজ প্রকৃতি। সে সমতলের ছেলে। আর পাহাড়ি ছবি তার মনে শান্তি আনতো। মন খারাপ হলেই পাহাড়ের ডাকে বেরিয়ে পরতো বারে বারে।
একরাতে বাসা বাড়িতে খাবার নেই। মাইনের টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সন্তু জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। একগ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পরলো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সন্তু। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ।  তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো,কে?



—-আমি, দরজাটা খুলুন।
—–জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।
—–আমি পাপিয়া,
——এত রাতে
——আরে খুলুন না ছাই।
দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা থালা। বললো,আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়।
সেই প্রসাদ খেয়ে সন্তু ঘুমিয়েছিলো।

বাড়িওয়ালার মেয়ে পাপিয়া দেখতো, সন্তু সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঢোকে। তার মানে হোটেলে খায়। কোনোদিন বেশি কথা বলে না। শুধু বলে,ভালো আছেন। আর ভাড়া দিতে এলে বলে,বাবা আছে। পাপিয়া মা আর বাবাকে বললো,আমি সন্তুদার কাছে ইংরাজীটা দেখিয়ে নেবো। বাবা খুব কিপটে। বিনা পয়সায় পড়ানোতে আপত্তি নেই। মা বললেন,ছেলেটা ভালো।যাবি প্রয়োজন হলে।

রাতে সন্তু এলে পাপিয়া বই নিয়ে ওর ঘরে গেলো। লুঙ্গি পরে তক্তায় সন্তু বসেছিলো। সন্তু বললো,কিছু বলবে।

——-হূঁ,একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দেবেন?

—–কই দেখি, আমি পড়তে ভালোবাসি।

——আর পড়াতে
——দুজনে আলোচনা করবো। ইংলিশ আ মার বেস্ট সাবজেক্ট ছিলো।

—–তাই,তাহলে ভালোই হলো।

সন্তু দেখছে পাপিয়ার পড়াশোনায় মন নাই। শুধু কথা বলছে। বলছে,আপনি এত অগোছালো কেন?
তারপর সন্তু দেখলো পাপিয়া সব কিছু গোছাতে শুরু করেছে।
সন্তু বললো,তুমি বড়লোকের একমাত্র কন্যা
আমার কাজ করবে কেন?
—–আমি এসব দেখতে পারি না। আপনি চুপ করে বসুন। আর আমি একবার করে আপনার কাছে গল্প করতে আসবো। তাড়িয়ে দেবেন না তো?
—–না,না আমিও তো একাই থাকি। কথা বলার সঙ্গি পাবো।
—–বাবাকে বলবেন,আমি খুব পড়ি।
—–মিথ্যা বলতে নেই। যা বলার তুমি বলবে। আমি কিছু বলবো না।


—–ঠিক আছে, আপনি ক্যাবলার মতো এসব বলবেন না।

——আমি এসব ভালোবাসি না।

সন্তু ভাবে মেয়েটা কি চায়? আমার মাথার ওপর বড়ো সংসারের দায়ীত্ব। আমাকে সাবধানে চলতে হবে।

পুজোর ছুটিতে সন্তু বাড়ি এসেছে। মায়ের জন্য সাদা তাঁতের শাড়ি। দুই ভায়ের জন্য জামা,প্যান্ট একই কালারের। বোনেদের চুড়িদার এনেছে। বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা। আগের দিন রাত থেকে সব্জি বনানো,কুটনো কাটা শুরু হলো। অনেক লোকজন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। বড়ো বড়ো গামলায় রেখে সব্জি সব উঠোনে নামানো হলো। কাল সকালবেলা রান্না হবে। সন্তু কে ওর মা বলে,এবার বিয়ে করে নিবি। আমি দোনাগ্রামে মেয়ে দেখে রেখেছি। কথাও বলেছি। মায়ের কথা ফেলতে পারে না সন্তু। সে সম্মতি দিলো। তা না হলে মা দুঃখ পাবেন।

পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলে সন্তু ফিরে এলো শিলিগুড়ি। এসেই দেখলো,পাপিয়া হাতে একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু বললো,কি এটা।
—-পুজোতে তোমার জন্য লিখেছি।
—থাক,তোমার কাছে থাক। আমার আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। কাল মোবাইলে মেসেজ পেয়েছি। আজকে নোটিশ পাবো অফিসে।
—-কিন্তু আমি যে অনেক কিছু দিয়েছি তোমাকে। আমার মন,প্রাণ সবকিছু।
সন্তু দরজা খোলামাত্র পাপিয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখের জলে তার জামা ভিজিয়ে দিলো। আর সন্তু তো কাঁদতে পারছে না। পাপিয়ার জন্য তার মন পাপিয়া কতবার যে ডাক দিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। সন্তুর বাসা বাড়ির টালির চাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদ আজ ঢেকে গেছে অন্ধকারে।

এক নারী ও রাজার কাহিনী: দ্বিতীয় পর্ব




লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply