এক নারী ও রাজার কাহিনী: ষষ্ঠ পর্ব
সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।
অনুপমা তার দাদুকে দেখেছে। অনুপমা ভাবে,দাদু তার জীবনের আদর্শ। মনমতো দাদু আমার খুব প্রিয় ছিলো। দাদু আমাদের জন্য নিরামিষ রান্না করতেন। কখনও সখনও দেখেছি নিজে ডেঙা পাড়া, থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। ব্রয়লার মুরগির ডিম ভালোবাসতো না দাদু। দেশি মুরগির ডিম আনতেন কিনে। নগদ টাকার টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন ঠাকুমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা। আমি পূর্ব মেদিনীপুরের মেয়ে। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
তখন ভূতের গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ভূত আসতে পারে। জানিস তো ছড়াটা,ভর্তি দুকুরবেলা, ভূতে মারে তালা। থাপ্পরকে দাদু বলতো তালা। রেগে গেলেই বলতো,এক তালাতে ভুবন ঘুরিয়ে দোবে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার বন্ধুরা সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি।
পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ভূত আসবে। দিনে ভূত দেখা যাবে । ছেলে, মেয়ে সবাইকে ধরবে। বস্তায় ভরে নিয়ে যাবে অন্য দেশে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। আমের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে কালো টিনের হাতে ভূত হাজির।টিনের হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গেলাম। আমরা তাড়িয়ে নিয়ে গেছিলাম লোকটাকে।
ভূত তখন ভয়ে পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু মিথ্যা কথা বলে ভয় দেখাতেন। দাদু খুব ভালো লোক ছিলেন। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে রাতে উঠে,সড়কি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠি,সড়কি,বগি ছিলো প্রধান অস্ত্র। সড়কিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই।
বারোজন মরদ সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার গিন্নি দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। তা বলে কোনো ডাকাত কি কোনোদিন ভালো হয়? মনে মনে প্রশ্ন করে নিজেকে। ভালো আর মন্দ মিলেমিশে মানুষের গঠন।
আজ আর দাদু নেই। এতবড় সাহসী লোক হয়েও দাদুর ঘরে শান্তি ছিলো না। দাদু বলতো,বাঘের ঘরে ঘোগার বাসা। দাদু আপশোষ করতো, নিজের বৌ যদি বেইমানি করে জগতে কারও সাধ্য নাই তাকে বাঁচায়। সে মরবেই। শান্তি তো কোনোদিন পাবেই না। দাদুর ক্ষেত্রে এই কথাগুলো সত্য হয়ে উঠেছিলো অভিশাপের মতো।
দাদুর মৃত্যু খুব মর্মান্তিক,ভয়ংকর। লোকে বলে,একহাত জিভ বেরিয়ে গেছিলো গলায় দড়ি দেবার পরে। সেই ঘটনা অনুপমার মনে পরছে।
আমি আর ঠাকুমা দুজনের সংসার। ঠাকুমা অসুস্থ। ঠাকুমা বলেন,তুই যাকে ভালোবাসিস, তাকে বিয়ে কর। আমি হঠাৎ মরে গেলে তোর কি হবে বলতো?
আমি বলতাম ,কিছু হবে না ঠাকুমা। আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। আমি তোমার কাছেই থাকবো। ঠাকুমা বলেন এ আবার কেমন কথা? মেয়েরা বিয়ে না করলে হয় না কি?
আমগাছটাকে বলছে অনুপমা,ছোটোবেলার বন্ধু রাজুকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। রাজুও ভালোবাসে। কিন্তু রাজুর বাড়ির লোকজন রাজী নয়। আমরা লুকিয়ে দেখা করি। ঠাকুমা জানে,কিন্তু ঠাকুমাকে একা রেখে আমি চলে গেলে, ঈশ্বর আমাকে মাপ করবে না। আমি কি করবো বলো?তবু হয়তো একদিন যেতেই হবে। বিয়ের ফুল ফুটলে কেউ অবিবাহিত থাকে না।
আমগাছটা তার ডাল দুলিয়ে, পাতা নাড়িয়ে হাওয়া দেয়। বুদ্ধি দিতে পারে না। অনুপমা ভাবে,গাছগুলো কথা বলতে জানলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। গাছের নিচু ডালে বসে সে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে আরম্ভ করলো।
মনে পরে দাদু যেদিন মারা যায় সেদিন ঠাকুমা খুব কাঁদছিলো। ঠাকুমার বিয়ের পর থেকে দাদুর সঙ্গে অশান্তি হতো। ঠাকুমার মুখে শুনেছে সে। ঠাকুমা বলেছিলেন,আমি আমাদের গ্রামের একটা ছেলেকে মানে…ভালোবাসতাম।
অনুপমা বলে,ঠাকুমা বলো না ঠিক করে। তুমি তো আমার বন্ধুর মতো। সব কথা বলা যায় বলো।
ঠাকুমা বলছেন,ছেলেটার সঙ্গে মিশতাম। ভালোবাসা হয়ে গেলো। আমার মা বাবা না থাকলে ছেলেটা সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে পরতো। রান্নায় সাহায্য করতো। আদর করতো। চুমু খেতো। কিন্তু আমাকে যে ভালোবাসতো না সেটা আমি জানতে পারলাম দুবছর পরে। আমার বন্ধু বিমলের কাছে শুনলাম আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে ও এরকম ব্যবহার করে। ওরা সাত ভাই। তাই কেউ ভয়ে কিছু বলে না তাকে। তারপর একদিন চুপি চুপি ও আমাদের বাড়ি এলো। আমি বলে দিলাম,বাবা,মা,না থাকলে আমাদের বাড়ি আসবে না। ও জোর করে আমাকে নগ্ন করলো। ও বললো,আর আমি আসার সুযোগ পাবো না
ও বললো,কেন?আসবো না কেন?
আমি বললাম,কেন, তুমি জানো না? সব জানো তুমি। হাজারটা মেয়ের সর্বনাশ করছো তুমি। নিজেকে খুব চালাক ভাবো তুমি না?
তারপর দেখলাম ওর মুখ পেঁচার মতো হয়ে গেলো। ও মরিয়া হয়ে গেলো। আমাকে চিত করে ফেলে চেপে বসলো। আমি হাত দুটো মাথার উপরে তুলতেই পেয়ে গেলাম কাটারি। অই কাটারির উল্টো পিঠে মারলাম এক ঘা। বাবারে বলে,ভয়ে পালিয়ে বাঁচলো শালা।
তারপর থেকে কোনো কথা ছিলো না। কিন্তু আমার বিয়ের পর অশান্তি ঢুকিয়ে দিলো আমাদের জীবনে। তোর দাদুকে সব কথা বলে দিলো। ও আমার অপমানের আমার কাছে মার খাওয়ার বদলা নিলো।
তোর দাদু তারপর থেকে আমাকে মারধোর করতো। সন্দেহ করতো। আমি বার ববার তোর দাদুকে বুঝিয়েছি। ওই খচ্চরটা আমার ইজ্জত নিতল পারে নি। তবু বিশ্বাস করতো না আমার কথা। আমাকে পেটাতো লাঠি দিয়ে। একবার মাথায় লেগে মরেই যেতাম। কোনো রকমে বাঁচলাম হাসপাতালে দেখিয়ে। সেখানেই পরিচয় হলো এক পুরুষের সঙ্গে। খড়কুটো ধরে ডোবার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম আমি। পুরুষটা ধান্দাবাজ, কামুক। আমার কথা শুনে বললো,কোনো চুতিয়া কিছু করতে পারবে না। আমি আছি তোমার সঙ্গে। টাকা পয়সার অভাব হবে না। শুধু চাই তোমার শরীর। একদম ষোলো আনা। আমি ষোলো আনাই দেবার প্রতিশ্রুতি দিলাম।
আমি বাধ্য হয়ে এক শক্তিশালী যুবককে প্রেমের খেলায় ফাঁসালাম। সে আমার ঘরে বসতো। আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতো। তোর দাদুকে ও বলেছিলো, যদি শুনি মারধোর করেছিস, সেদিন তোর শেষ দিন। আমি গুন্ডা,বদমাশ লোক। মাথা গরম হলে খুন করে দেবো। এই কথা বলে কোমর থেকে বের করে একটা বড়ো নেপালা দেখিয়েছিলো। তারপর তোর দাদু সোনাপাড়ার জমি দেখাশোনা করতো। আমার কাছে আসতো না। আমিও খবর নিতাম না। তোর দাদু সড়কিখেলায়, লাঠিখেলায় ওস্তাদ ছিলো। কিন্তু নেপালা দেখে,মারমুখী মূর্তি দেখে তাকে বললো,ঠিক আছে আজ খালি হাতে আছি। তোর মৃত্যু আমার হাতে। মনে রাখিস,আমি ফালতু কথা বলি না।
অনেকবার চেষ্টা করেও পারে নি। তবে তোর দাদুর হাতে একটা নেপালার কোপ পরেছিলো। সেই দাগ আজও আছে। আমি জানি,তোর দাদু এই লোকটাকে খুন করবেই।
তারপর তোর বাবা বড়ো হলো। বিয়ে হলো। তুই হলি। ঘর ভরতি আলো। আমার নাঙ, তোর জন্মদিনে বিরাট আয়োজন করেছিলো। তারপর হঠাৎ একটা পথ দুর্ঘটনায় তোর বাবা মরে গেলো। তোর মা তার মাসখানেক পরে চলে গেলো। তোর দাদু তোকে রেখে দিলো। তোর মা কে আমি বাধা দি নি যাওয়ার সময়। কারণ আমার বাড়িতে যে ঢ্যামণ আসতো তার নজর পরেছিলো তোর মায়ের গতরে। তোর মতোই সুন্দরী ছিলো তোর মা।
ধীরে ধীরে,সময়ের পাকে,তুই বড় হয়ে গেলি। তারপর তুই তো সব ঘটনা জানিস। তোর দাদুর ক্যান্সার হয়েছিলো লিভারে, অতিরিক্ত মদ্যপানে। তোর দাদু তখন বুদ্ধি করে এক রাতেআমার ঘর থেকে বেরনোর পর লম্পট ললোকটাকে সিপাই দিঘির জঙ্গলে সড়কি পেটে ঢুকিয়ে খুন করে এলো। আমি দেখলাম হাতে রক্তমাখা সড়কি।
বললো,তোর প্রেমিককে খুন করে এলাম রে খানকি মাগী এই বুড়ো বয়সে। শালা আমার সঙ্গে টক্কর,শালা আমার সঙ্গে পাঙ্গা। এবার তোর কুটকুটানি মরবে। তোকে মারবো না। বেঁচে থেকে তু শাস্তি ভোগ করবি। আমি ভূত হয়ে দেকবো।
তারপর আমি কিছু বোঝার আগেই গলায় দড়ি নিয়ে ঝুলে পরলো, তারই হাতে লাগানো আমগাছে।
ওই আমগাছটা সব জানে। ও তো আর কথা বলতে পারে না। ওই প্রধান সাক্ষী। তারপর পুলিশের ঝামেলা পেরিয়ে আজ এই অবস্থা। হয়তো আমার পাপেই তোর দাদু,বাবা মারা গেলো। এবার আমি গেলেই বাঁচি। অনুপমা বললো,না,না,ঠাকুমা সব বিধির লিখন। তোমার কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে। দুঃখ কোরো না।
ঠাকুমা বলছে,তোরা দুজনে বিয়ে করে পালা। ওরা মানবে না ভালোবাসার বুলি। আজকেই পালিয়ে যা। অনুপমা কথাটা বলতে পারছিলো না। আজকে ঠাকুমা সব পথ সহজ করে দিলো।
এক নারী ও রাজার কাহিনী: সপ্তম পর্ব
One thought on “এক নারী ও রাজার কাহিনী: ষষ্ঠ পর্ব”