রায় সুহৃদ

তুই বেঁচে যাবি

অনুগল্প, গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

রায় সুহৃদ।।

 

ভি আই বর্মন নামে নতুন একটি রাস্তার নাম ঠিক হয়েছে। জেলা মেজিস্ট্রেট অফিসের কর্মচারী এবং ঠিকাদার নিয়মিত কর্মীদের দেখভাল করছেন। চুরুট, পান, সাদা জর্দা-রঙা জিনিসপত্র নিয়মিতই প্রদান করছে সরকার মহল। এই রাস্তা চার লেনের হয়ে উপরে হবে ফুটওভার ব্রিজ। কনস্ট্রাকশনের ইট, বালি, সিমেন্ট আর রড ভাঙ্গাচোরা রাস্তার অর্ধেকটা দখল করেছে। এতে সারি সারি প্যান্ডেল বেঁধে জট তৈরি হয়েছে। যানজটের পাশাপাশি জনদুর্ভোগ।

 

অন্য সবার মতোই আমিও বসে আছি সিএনজির পেছনে শূন্য মগজে নিয়ে। একদিকে অসহ্য বিকেল, অন্যদিকে পরিবহনের বিকট শব্দ। দুটো মিলে কানের কম্পাঙ্ক কত মেগাহার্জ কমালো বা বাড়ালো তা ভাবারও ইচ্ছে নাই। কোনকিছুতেই আর আগ্রহ জাগছে না। কাঁধে ছোট্ট ব্যাগে একটা বই আছে, তা খুলতেও ইচ্ছে করছে না। নিরাভরণ একটা অবস্থা। রঙ নেই, কালি নেই, আনন্দ নেই। আদ্রতা আর বিষণ্ণতার জেট। চোঁখটা বামে ঘুরাতেই রেললাইন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রেললাইন কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে একগাদা বস্তি। পাশেই ফুটপাথ। সভ্যসমাজের লোকজন বস্তির উৎকট গন্ধ আর চিৎকার-চেঁচামেচি উপেক্ষা করে নাকে-মুখে রুমাল পেঁচিয়ে পার হচ্ছে।

 

হঠাৎ মনে পড়লো, এই বস্তিতে মাসদেড়েক আগে একটা পাঁচবছর বয়সী মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। রোগা চেহারা, গড়ন পাতলা, ছিমছাম নাক, ঈষৎ লালচে রঙ ছেয়ে গেছে সারা মুখে। একবার দেখলেই মনে হবে যেন অপরিসীম উল্লাস আর বাঁচার ইচ্ছে মেয়েটির চোঁখে। পেট খালি রেখেও মেয়েগুলো নির্বিঘ্নে কীভাবে উড়ে তা এই এলিট শ্রেণীর লোকেরা বুঝবে না। ব্যাংক লুটপাট আর মানি লন্ডারিংয়ের ব্যবসা যারা করে, তারা বস্তির মেয়ের সৌন্দর্য বুঝবে কীভাবে?

 

মেয়েটিকে সেবার একটি ছোট্ট হোটেলে খেতে দিয়েছিলাম। না খাওয়ার ইচ্ছে সত্ত্বেও আমি অনেকটা জোরাজোরি করেই এনেছিলাম। ওর চঞ্চল প্রকৃতি আর উদাসীনতার ঘোর আমার এখনও মনে আছে। ছোট এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উদাস হাওয়ায় কীভাবে নাচে তা কল্পনা করলে ক্লান্তি মিটে যায়। মনখুলে সে আমাকে তার সব ইচ্ছে জানিয়েছিল। একটা স্কুলে যাওয়ার দুইমাসের মাথায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়। সংসারে টানাপোড়েন, ছোট একটা ভাই। আরো অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। একদিন বস্তির কিছু ষণ্ডা ঝাপিয়ে পড়েছিল তার মায়ের উপর। লালসা, উন্মত্ত কামুক ষন্ডার মাথায় সজোরে আঘাত করে পালিয়েছিল এই মেয়েটি। পরে জানতে পারে, মা চলে গেছে ওপারে।

 

ছোট্ট মেয়েটির জীবন একটা সংগ্রাম।
এসব মনে পড়লে খারাপ লাগে। আকাশে কালো মেঘের ফণা তোলা ঢেউয়ের মতো শিলাবৃষ্টি নামে হৃদয়ে। এতটুকুন মেয়ের এত কষ্ট, সংগ্রাম কেন? এরাও তো পাঁচতলা ডুপ্লেক্স বাড়িতে আরামে খেতে পারত! এসি গাড়িতে উঠে হিন্দি গান শুনে একটু ঝিমিয়ে নিতে পারত। এরাও নামি-দামি স্কুলে পড়ে ছড়া লিখতো, চাকরী করত, ইংরেজিতে কথা বলত, হাফ শার্ট,প্যান্টের মতো আধুনিক পোষাক পড়ত। এখন তাদের ছড়ার পঙক্তিগুলো অর্থকষ্টে আটকে যায় কেন?

 

এই ভাবনাচিন্তায় সিএনজি দুই, তিন ইঞ্চি এগিয়েছে। আমার ভ্রম কাটল। এখন আর বামে রেললাইন দেখা যাচ্ছে না। পাশে আরেকটা স্কুটার নিয়ে দাঁড়িয়েছে এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের হেলমেট আরেকটু ছোট হলে বস্তির ফুটপাত পেরিয়ে ঘরগুলো দেখা যেত। এইবার আর বসে থাকার ইচ্ছে নাই। অনেক হলো! সিএনজিওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে কেটে পড়লাম। সিএনজিতে বসে থাকার চেয়ে কার্বন আর মিথেনের বিকট গন্ধে ফুটপাতে হাঁটাও ভালো। সন্ধ্যে নেমে পড়েছে। আস্তে আস্তে ট্রাফিক বাতি নিয়নের আলোর সাথে নাচতে শুরু করলো। বস্তির লোকগুলো এবার আমাকে স্পষ্ট দেখছে।

 

একবার ভাবলাম, মেয়েটির খোঁজ নেই। আবার ভাবলাম, নাম তো জানি না, কীভাবে পাব? কতগুলো সারি সারি ঘর। কারও ছোট্ট দুইটা টিন মোড়ানো ছাউনি, কারও বা প্লাস্টিক কাগজের ডেরা।

 

না ভেবে কিছুটা হুটহাট করেই বস্তিতে ঢুকে পড়লাম। আমার জীবনে সবকিছু হুটহাটই হয়েছে। পত্রিকা অফিসের চাকরি, মিথিলার সাথে পরিচয়,বাবার অল্পবয়সে পরলোকগমন-সব হুটহাটই হয়েছে।

 

মেয়েটিকে খুঁজে পেতে আমার বেগ পেতে হলো না। হাঁটতেই আচমকা একটা শব্দ আমার কানে এসে বাজলো-সাহেব!
-কই যান? আমারে চিনছেন? ঐদিন হোটেলে আমারে খাওয়াইলেন?

 

আমি অবাক হয়েছি। মেয়েটির শরীরে আগের চঞ্চলতা, প্রখর কন্ঠ নেই। তবে, ট্রাফিকর বড় বাতির লালচে আলোয় চকচকে নিখুঁত প্রাণশক্তির একজন বসে আছে। মুখে সাজানো হাসি, ময়লা জামা। আমাকে ছোঁয়ার অদম্য উচ্ছাসে সে হাসছে। ভাগাড়ের এই বস্তি আর ষণ্ডামার্কা ছেলেপেলের এই পাড়ায় এই মেয়েটিকে মানায় না।

 

মেয়েটির কাছে গিয়ে বসতেই হাসি মিলিয়ে গেলো। ম্লান আলো চোঁখের কোটরে জ্বলজ্বল করছিল।
মনে হলো, মেয়েটি আমাকে বুকে আগলে কাঁদতে চাইছে। কতদিন মনেহয় কোন স্নেহাতুর আলিঙ্গন সে পায়নি। সে আমার বুকে অঝরে অশ্রু ফেলছে। আমার শার্ট ভিজে যাচ্ছে। কেন জানি আমারও অশ্রু নেমে আসলো!

 

অনেকক্ষণ কাঁদলো। মনেহলো, একটু কাঁদার মতো জায়গাও এদের নেই। কত অসহায় মেয়েটি। কোনমতেই থামতে চাইছে না কান্না। সে যেন অনেকদিন পর প্রিয়জনের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। আমিও নিষেধ না করে কাঁদলে দিলাম।

 

তারপর যা বুঝতে পারলাম, তাঁর জন্য যেকোন মানুষ এই মহাবিশ্বে অপ্রস্তুত। ছোট্ট শিশুর অশ্রুপাত আর পা বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্ত আমার বেদনার ক্ষতে আরও একপশলা আঘাত করলো। বুঝতে বাকী রইলো না, ছোট্ট শরীরটাকে দুমড়েমুচড়ে ভক্ষণ করেছে কোন নরখাদক হায়েনা। নিথর দেহ তখনও গুমরে কাঁদছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ার স্রোত মনে যে প্রতিশোধের বিদ্যুৎ জাগালো, যে ভয়ংকর পুঁজিবাদী শক্তি মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে ছুঁটতে লাগলো তা যেন পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তিরস্কার করতে লাগলো!

 

যানজট পেরিয়ে, ফুটপাত মাড়িয়ে চলতে লাগলো আমার ক্লান্ত শরীর। মেয়েটির অশ্রু যেন পিচঢালা কংক্রিটের পথে গোলাপ ফুলের খাদ্য যোগাচ্ছিল। নষ্ট সংসার, হতাশাগ্রস্ত পৃথিবীকে পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম একজন অসহায়কে বাঁচানোর তাগিদে।

 

আত্মার অস্তিত্বে তখন একটি বিভৎস শব্দ বারবার ধ্বনিত হচ্ছিলো- তোর কিছু হবে না। তুই বেঁচে যাবি।

লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply