নীতিবানের দুর্নীতি
হাফিজ রহমান
শিক্ষার্থী,
ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১.
“সুন্দরপুর বাঁধ প্রকল্প’র ব্যাপক দুর্নীতিতে প্রকল্প কর্মকর্তাসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে আজ। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মোট ছয়জনকে আটক করা হলো… এদিকে এবছর বৃষ্টিতে এলাকার অনেকাংশ তলিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। বিক্ষুদ্ধ জনতা উপজেলা পরিষদ ঘেরাও করেন এবং এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান। পরবর্তী সংবাদ দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে এখনকার মতো শেষ করছি….” নিউজটা দেখে বিরক্ত শফিক রাগে-ক্ষোভে টিভিরুম ছেড়ে নিজকক্ষে যেতে যেতে আপনমনে বলল, নীতি-নৈতিকতা কি পৃথিবী থাইক্যা উইঠ্যা গ্যাছে? পরিবারের শিক্ষা বইল্যা কিচ্ছু নাই হ্যাগোর? দেশটারে আজ কই নিয়া গ্যাছে হ্যারা……। রাগে গরগর করছে শফিক।
ইদানিং অনেক দুর্নীতি-অনিয়মের খবর আসছে টিভি, পত্র-পত্রিকা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যা শফিকের জন্য হজম করা রীতিমতো কষ্টকর। কিন্ত শুধু শোনাটা শফিকের কাজ নয়। মাঝে-মধ্যে ফেসবুকে লিখে মানুষজনকে সচেতন করে এবং প্রতিবাদ জানায়।
আজও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি, টিভি রুম থেকে সোজা চলে গেল রুমে। তারপর ফেসবুকে লিখল, “মাঝে মাঝে মনে হয় দেশ ছেড়ে চলে যাই, এত এত দুর্নীতির সাথে একজন সুস্থ্য মানুষ বসবাস করতে পারে না কি? খোলা ময়দানে এজলাস বসিয়ে জনসম্মুখে দুর্নীতিবাজদের বিচার করা হোক।”
দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র শফিক। মেধাবী এবং ছেলে হিসেবেও ভালো। অনেকগুলো গুণের মধ্যে শফিকের অন্যতম গুণ হল- জুনিয়র দেখলেই নীতি কথা বলা। তার ধারণা জুনিয়র এবং আশেপাশের মানুষগুলোকে এখন থেকেই সঠিক পথ দেখানো আবশ্যক। দূর্নীতিবাজ বিরোধী একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। শফিকের দৃঢ় বিশ্বাস একদিন তার স্বপ্ন অবশ্যই সত্যি হবে।
২.
আরে শফিক যে! কি ব্যাপার, তোকে তো আজকাল দেখাই যায়না! ক্যান্টিনে বন্ধু নাসিরের সাথে দেখা।
-একটু পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত আছি বন্ধু। বুঝিসতো দেশের চাকুরির বাজারে বেহাল দশা, পড়ালেখাও শেষের দিকে। এদিকে আবার চাকুরীজীবীদের দুর্নীতির খবর প্রতিদিন শুনতে শুনতে কান খসে পড়ার মতো অবস্থা হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম বিসিএসের প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই উত্তম সময়। আমরা এইসব সেক্টরে না যাওয়া পর্যন্ত দুর্নীতি কমবেনা। তাই চেষ্টা করি লাইব্রেরীর দিকে সবসময় থাকার।
-আসলেই, ঠিক বলেছিস বন্ধু। এইসব দুর্নীতিবাজদের হটাতে তোর মত মানুষেরই প্রয়োজন দেশের। শুভকামনা রইলো তোর জন্য। শফিককে ভরসা দেয় নাসির।
৩.
ফলাফল প্রকাশিত হলো, শফিক প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত। আসলে এমনটি অনুমিতই ছিল। চেষ্টা তো এই ক’বছরে কম করেনি! নিজের এবং পরিবারের স্বপ্নকে সত্যি করে শফিক সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদান করল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এখনি সময়।
শফিক চেষ্টাও করে যাচ্ছে দুর্নীতি মুক্ত হয়ে কাজ করতে। যেমন- একদিন এক মোটরবাইকারকে একশত টাকা জরিমানা করল অতিরিক্ত গতিতে বাইক চালানোর কারণে। তাঁরাকান্দি বাজারে অভিজান চালিয়ে ভেজাল পণ্য রাখার দায়ে ভণ্ড ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিল। রেশনের চাল নিয়ে অনিয়ম করার কারণে মহিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে কষে ধমক দিল। আরও কত কি! শফিকের কাজের ফিরিস্তি অনেক। যদিও সহকর্মী এবং শক্তিমানদের চাপে সবসময় পেরে ওঠেনা সে।
এভাবে চলতে চলতে………. একদিন প্রমোশন পেয়ে শফিক হল সুধাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা! এই দিনটির জন্যই যত অপেক্ষা তার। শফিকও ইউএনও হল পৃথিবীবাসীও মুখোমুখি হল মরনঘাতী কোভিড-১৯ এর। বাংলাদেশে এই ক্ষুদ্র শক্তি সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। চাকুরী হারিয়ে বহু জন আজ বেকার। রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, ড্রাইভার বসেছে পথে, পেটের দায়ে মানুষের দিগ্বিদিক ছুটোছুটি! শফিক অবশ্য সাধ্যমত চেষ্টা করছে যাচ্ছে মানুষের পাশে থাকার।
৪.
এই মহাবিপর্যয়ে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শফিক সুধাপুর উপজেলার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য সরকারি সহযোগিতা পেল দশ কোটি টাকা। দ…..শশশ.. কোটি টাকা!! জীবনে এত টাকা একসাথে কোনদিন দেখেনি শফিক। শফিকের স্ত্রীর তো চক্ষু রীতিমতো চড়কগাছ! দু’জনে বসল পরামর্শ সভায়। এই সভার সভাপতি অবশ্য শফিক নিজেই এবং সঞ্চালনার দায়িত্বে আছে তার স্ত্রী জেবুন্নেসা। শফিক যাকে আদর করে জেবু বলে ডাকে।
-শোন শফিক, সব টাকা মানুষকে দেওয়ার কী প্রয়োজন? এত টাকা মানুষের তো দরকার না। এছাড়াও তোমার মাধ্যমে মানুষ টাকা পাবে সুতরাং আমাদেরও কিন্ত একটা ভাগ থাকা দরকার! আর মানুষের জন্য তুমি কম তো করলেনা। এবার নিজেদের জন্য কিছু করার সময়। চাকুরির বেতনে তো আর সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব নয়। সময় ও সুযোগ তো বারবার আসবেনা। কথা গুলো মনে ধরল শফিকের। আসলেই তো! মানুষের জন্য তো অনেক কিছু করলাম আমি! মনে মনে ভাবে শফিক।
পরামর্শ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিন ভাগের দু’ভাগ সে নিজের মনে করে রেখে দিল স্ত্রী, শ্যালক, শাশুড়ি আর নিজের নামে। সব কিছু ঠিক ঠাক চলছিল। রাতারাতি কোটিপতি শফিকের মনটা গর্বে ফুলে ফুলে উঠছে। সুধাপুরের দুর্দশাগ্রস্ত লোকজনও সহযোগিতা পেয়ে খুশি। বেশি হোক কম হোক তা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। দুর্দিনে সরকার জনগনের পাশে আছে সেটাই বড় পাওয়া তাদের। শফিকেরও প্রশংসা কিন্ত কম হচ্ছেনা।
কিন্ত এক বেয়াড়া সাংবাদিকের পাওয়া গোপন তথ্য ভণ্ডুল করে দিল তার সমস্ত পরিকল্পনা। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল শফিকের! পত্রিকার প্রথম পাতায় ছেপেছে ওর ছবি। সবগুলো টিভি চ্যানেল শফিকের নামের আগে “দুর্নীতিগ্রস্থ” বিশেষণ ব্যবহার করে সংবাদ প্রচার করছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে শফিকের মায়াবী কোমল মুখখানা। সবচেয়ে বেশি অবাক হল বাড়ির বাইরে সাংবাদিকদের হৈ চৈ শুনে। সারা দেশ করছে ছি! ছি!
শফিকের ক্যাম্পাসের এক জুনিয়র আরো এক কাঠি সরেস। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখা কয়েকবছর আগে শফিকের ফেসবুকের স্ট্যাটাসখানা স্ক্রিনশট দিয়ে প্রত্যেকের হাতে হাতে নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দিল। নীতিবান শফিক আজ “দুর্নীতিবাজ” হিসেবে পরিচিত দেসবাসীর কাছে।
One thought on “নীতিবানের দুর্নীতি”
মাসায়াল্লাহ অনেক ভালো লাগলো দোয়া রইল