নড়িয়ার পথে পথে
মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন।।
পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো, আইসো। কপালকুণ্ডলার মত কেউ এসে বলেনি অমন করে। কিন্তু আমরা ছয়জন শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার সীমানা দিয়ে ঢোকার পর থেকেই পথের পাশে ইতিহাসের সূত্র ও স্মারকগুলোকে খুঁজে পাচ্ছিলাম, একে একে। বাংলাদেশের মধ্যে নড়িয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি উপজেলা। ভেদরগঞ্জ থেকে খানিকটা উত্তরে যেতেই চোখে পড়লো পঞ্চপল্লী গুরুধাম উচ্চ বিদ্যালয়। বিঝারী ইউনিয়নের মগর গ্রামে পার্শ্ববর্তী পাঁচটি গ্রামের অংশগ্রহণে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন অতুল প্রসাদ সেন। “মোদের গরব মোদের আশা/ আ’মরি বাংলা ভাষা” গানের রচয়িতা, পঞ্চকবির অন্যতম, কবি ও গীতিকার, বাঙালির ভক্তি ও প্রেমের কবি ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেন। বিদ্যালয়ের নামফলকে বড় করে প্রতিষ্ঠাতার নামটি লেখা রয়েছে। স্কুল প্রাঙ্গনে কবির একটি বড় ম্যুরালও স্থাপন করা হয়েছে দেখলাম। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি কালের সাক্ষী হয়ে আমাদের চোখের তারায় বিস্ময়ের ঢেউ তোলে। আমরা মোটরসাইকেল থেকে নেমে স্কুলটি ঘুরে দেখে তারপর স্থানীয় মগর বাজারে চা খেতে বসলাম। আমি, মশিউল, আনিস, নাজমুল, আসাদ ও জাকির ভাই– এই ছয়জন মিলে আমাদের বহর। চা খেতে খেতে জানলাম, পঞ্চপল্লী নামে কোনো গ্রাম নেই এখানে। মগর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এই হাইস্কুলের নামকরণে পঞ্চপল্লী কথাটা এসেছে পাঁচ গ্রামের অংশগ্রহণ বোঝাতে। কবির প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠের নাম তো কাব্যিক হবেই। গুরুধাম। হাইস্কুল কথাটা পরে যুক্ত হয়েছে। শুরুতে এর নাম পঞ্চপল্লী গুরুধাম পর্যন্তই ছিল বোঝা যায়। পরবর্তীতে মাধ্যমিক স্কুলকে উচ্চবিদ্যালয় বলা শুরু হওয়ায় স্কুলটির নামের সাথে উচ্চবিদ্যালয় শব্দটি যুক্ত হয়। পঞ্চপল্লী গুরুধাম উচ্চবিদ্যালয়। কাছেই রয়েছে কবির পৈত্রিক ভিটা।
মগর বাজার থেকে চা-পর্ব শেষ করে আমরা ছুটলাম ফতেজঙ্গপুরের দিকে, যেখানে রাজা মানসিংহ নির্মিত একটি দুর্গের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। এই দুর্গে পৌছুনোর আগে একটি বিরাট বিল পাড়ি দিতে হয়। বিলের নাম ধামারনের বিল। এই বিল সম্পর্কে একটি মজার প্রবচন রয়েছে। খাইছি খাইছি কিল/ দেইখা আইছি ধামারনের বিল। বিল দেখে বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় স্বামী কিল মেরেছে। কিন্তু কিল খেয়েও বউয়ের কোনো দুঃখ নাই। কারন ধামারনের বিল দেখার আনন্দ স্বামীর কিল খাবার দুঃখের চেয়ে অনেক বেশি। প্রবচনটি স্থানীয় মানুষের কাছে সুপরিচিত মনে হল। বিলের সেই মনোহর রূপ এখন নেই। অনুমান করা যায়, বিশেষ রূপ-সৌন্দর্যের আকর হয়ে বিলটি স্থানীয় মানুষের কাছে আকর্ষণীয় এবং মনোরম ছিল। হয়তো এর ভেতর লুকিয়ে ছিল বহুরকমের সম্পদও।
ধামারনের বিল পাড়ি দিয়ে পৌছে গেলাম ফতেজঙ্গপুর বাজার। মোটরসাইকেল থামিয়ে আমরা ছয়জন নেমে পড়লাম এখানে। ছয়শো বছরের প্রাচীন অথচ দগদগে স্মৃতি নিয়ে ফতেজঙ্গপুর নামটি সগৌরবে বর্তমান। রাজা মানসিংহের স্মৃতিচিহ্নের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আমরা সবাই। রাজা মানসিংহ নামটি বাংলার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঈশা খার সাথে যুদ্ধ, কেদার রায়ের সাথে যুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন কারনে মানসিংহের নামটি ইতিহাসে ঘুরেফিরে আসে। মুঘল শাসনের সামান্য দুর্বলতা টের পেলেই বিদ্রোহী বাংলা ফুঁসে উঠেছে বারবার। পূর্ববাংলার এ বৈশিষ্ট্য ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে স্বতন্ত্র। বিখ্যাত লেখক হুমায়ন কবির তার ‘বাংলার কাব্য’ গ্রন্থে এ কথার বিশেষ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। আমরা সেই টালমাটাল সময়ের স্মৃতিচিহ্ন দর্শন করতে চলেছি। স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে তারা এটাকে ঈশা খাঁর বাড়ি বলছিল। স্থানীয়রা অনেক কিছুই ধারনা থেকে বলে। এই ধারনা আবার তাদের নিজস্ব নয়। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া। মানসিংহের সাথে বিদ্রোহী বার ভূইয়ার অন্যতম কেদার রায়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয় এতদাঞ্চলে। যুদ্ধে কেদার রায় পরাজিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আর এই যুদ্ধে জিতে যাওয়ার স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ এখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করে রাজা মানসিংহ। সেই সাথে বিক্রমপুরের নামকরণ করা হয় ফতেজঙ্গপুর। উল্লেখ্য, বর্তমানের ফতেজঙ্গপুর ছিল তৎকালীন বিক্রমপুর পরগণার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ। অনুমান করা যায়, ফতেজঙ্গপুর দুর্গে রাজা মানসিংহ বেশ কিছু সময় থেকেছিলো। তাছাড়া মুঘল সেনাদের সাময়িক বসতি এবং যুদ্ধের রসদ রাখার জন্য এই দুর্গটি মাঝে মাঝেই ব্যবহৃত হতো।
বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি করা ইটের কিছু স্থাপত্য মিলে সুবিশাল সীমানা নিয়ে দুর্গটি প্রতিষ্ঠিত। দুর্গটির নির্মাণশৈলি দেখে খুব সহজেই বোঝা যায়, এখানে সারা বছর ধরে বসবাস করার পরিকল্পনা রাখা হয়নি। হয়তো দুই-চার মাস বা দুই-চার বছর। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি আর কেদার চাঁদ রায়ের পরাজয়ের গল্প পড়ছি। ইতিহাসে বিপুল পরাক্রমশালী রাজা মানসিংহের বিজয় মানে মুঘলদের কাছে বাংলার পরাস্ত হওয়া। কেদার রায়ের পরাজয়ের পর মুঘলদের আর এ অঞ্চলে যুদ্ধ করতে হয়নি। একটানা চারশো বছর বাংলা নামক সুবাহকে নির্বিঘ্নে শাসন করে গেছে। বৃটিশের পদানত হবার আগ পর্যন্ত বাংলা ধীরে ধীরে জাত্যাভিমান নিয়ে সুসংহত হচ্ছিল। কিন্তু ১৭৫৭ সালে সেই ধারা নষ্ট হয়ে যায়। বাধাগ্রস্ত হয় জাতি গঠনের প্রক্রিয়া। দুইশো বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল বাঙালির গলায় ও হাত-পায়ে অন্তর্গতভাবে লেগে থাকে। বাঙালির মননে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে যায় দাসত্বের মনোভাব। সেই দাসত্বের মনোভাব স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হবার পঞ্চাশ বছর পরেও টের পাওয়া যাচ্ছে।
রাজা মানসিংহের দুর্গকে লোকে ঈশাখার বাড়ি কেন বলে তার কারন খুব বেশি স্পষ্ট নয়। তবে ঈশাখার নামটি ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে। হয়তো লোকে মানসিংহের প্রতিপক্ষ বলতে কেবল ঈশাখা-ই বোঝে। হয়তো তারা বারভূইয়ার সবাইকে ঈশাখা নামেই চিহ্নিত করে। আলাদা করে কেদার রায়, চাঁদ রায় বলার প্রয়োজন বোধ করে না। অথচ বিক্রমপুরের শাসক কেদার রায়, যার শেষ অংশ ছিল নড়িয়া এবং নড়িয়া থেকে চাঁদপুর হয়ে মাদারীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ইদিলপুর পরগণার শাসক ছিল কেদার রায়ের ভাই চাঁদ রায়। বর্তমান শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন জায়গায় চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। এক সময় শরীয়তপুর ছিল মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত। তারও আগে নড়িয়া তথা শরীয়তপুরের অংশবিশেষ ছিলো বিক্রমপুরের অন্তর্ভুক্ত। মাদারীপুর মহকুমার প্রাচীন নাম ছিল ইদিলপুর, যা ছিল মোটামুটি নড়িয়া থেকে বরিশাল পর্যন্ত, সাথে চাঁদপুর। যাই হোক, ইতিহাসের এই ভূগোলবিন্যাস আজকের সময়ে অনেক জটিল ব্যাপার। আমরা এখন ভিন্ন এক ঐতিহ্যের খোঁজ করতে চলেছি।
এরপর আমাদের ভোজেশ্বর যাবার পালা। যেখানে রয়েছে বহু শতাব্দী-প্রাচীন কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। এশিয়ার সর্ববৃহত এই শিবলিঙ্গটি বারবার চুরি হবার ঝুঁকিতে পড়েছে। লোকমুখে জানা গেল, এই বিগ্রহটি ময়মনসিংহ থেকে কয়েকশো বছর আগে এই এলাকায় কে বা কারা পূজা করার জন্য নিয়ে আসে। হিন্দুরা একে একে ভারতে দেশান্তরী হতে থাকায় এটি পাশের গ্রামে বর্তমানের বাড়িটিতে নিয়ে আসা হয়, তাও প্রায় চল্লিশ বছর আগে। শিবলিঙ্গের সাথে একটি গরুর মূর্তি রয়েছে। গরুটিও কষ্টিপাথরের। গরুর মূর্তিটি নাকি চোরে নিয়ে গেছিল একবার। পথেই চোর ধরা পড়ে যায়। তবে চোর লোভ সামলাতে পারেনি। পালানোর সময় গরুর কান দুটি ভেঙে নিয়ে যায়। সেই থেকে শিবলিঙ্গের পাশে পড়ে থাকা গরুটি অবস্থান করছে কানকাটা গরু হয়ে। ক্ষতচিহ্ন নিয়ে শিবের বাহন গরু তার প্রভুর পাশে নত হয়ে সেবাদাসের ন্যায় পড়ে আছে। আমাদের চোখে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আশ্চর্য এই শিবলিঙ্গ দেখে। বহু শতাব্দীর স্মৃতি নিয়ে প্রাচীন এই শিবলিঙ্গ ভোজেশ্বর বাজারের পুবপাশে নির্জন এক মন্দিরের প্রাঙ্গনে শোভা পাচ্ছে। পালং নদীর তীরে ভোজেশ্বর বাজার খুবই রমরমা। বাজারের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মিতালী নামক হোটেলে সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমরা ছয়জন গিয়ে চিকেন শর্মা দিয়ে নানরুটি খেলাম। অশেষ তৃপ্তির সাথে সন্ধ্যার নাস্তা করলাম।
তারপর ভেদরগঞ্জের দিকে যাত্রা। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। ঘরে ফিরে একটি সুন্দর বিকেলের স্মৃতি নিয়ে ঘুমুতে গেলাম বিছানায়। শীতের রাত। শীত আহা শীত। কপালকুণ্ডলা এসে বলছে, পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো, আইসো। কপালকুণ্ডলা আমাদের পথ দেখাবে বলে ডাকছে!