সামিউল আলম খান রুমী

পাঠ পর্যালোচনা (ধ্বংসতত্ত্ব)

বুক রিভিউ
লেখাটি শেয়ার করুন

সামিউল আলম খান রুমী ।। 

 

ধ্বংসতত্ত্ব অথবা ইসরাফিলের শিঙা
ফাইয়াজ ইফতি
ভূমিপ্রকাশ
এই তরুণ লেখক তার বই সম্পর্কে কোন এক লেখায় দাবী করেছিলেন, “বইটা যদি অন্তত একজন পাঠকও পড়ে, তাহলে সেই একজনও যেন বইটা ধারণ করতে পারার যোগ্য হয়৷”
বেশ উদ্ভট কিন্তু ইন্টারেস্টিং দাবী!
সেই সূত্রে বইটার কাহিণী সংক্ষেপ পড়লাম; খুব একটা ব্যাতিক্রমী কিছু মনে হল না৷ এমনিতেই দেশীয় মৌলিক লেখকদের বেশ কিছু বই পড়ে টাকা গচ্চা যাওয়ার অনুভূতি হয়েছে৷ আর এই নতুন লেখককে প্রমোট করার দায়-ও নিশ্চয়ই আমার মানিব্যাগ নিজের কাঁধে নেয় নি৷ তারপরেও লেখকের আত্মবিশ্বাসী আর কিছুটা আত্মঅহংকার পূর্ণ লেখায় টলে গিয়ে বইটা অর্ডার করে ফেললাম বেশ কিছু ‘হেভিওয়েট’ বইয়ের সাথে৷ শেলফে দুনিয়ার না পড়া বই জমে থাকলেও নতুন আসা বইগুলোর মধ্য থেকে কেন জানি এই বইটা-ই হাতে তুলে নিলাম৷ আর পড়া শুরু করতেই – বইয়ের প্রথম লাইন থেকেই হুকড হয়ে গেলাম৷
গল্পটা মফস্বল থেকে ঢাবি তে পড়তে আসা তরুণ তুহিনের৷ মফস্বলীয় আড়ষ্টতা, নতুন সব বন্ধুত্ব, প্রথম প্রেম, সিগারেট, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, নিজেকে নতুন করে চেনা, মহানগরে নিজের জায়গা করে নেয়া, জীবনযুদ্ধে টিকিয়ে রাখতে ক্রমশঃ নিজেকে নষ্ট রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে আবিষ্কার করা – সহজ সরল তুহিনের এই মেটামরফোসিসের সাথে হয়ত আমার মত ভার্সিটি লাইফে প্রথম ঢাকায় পা দেয়া হাজারো যুবক নিজেকে রিলেট করতে পারবে৷
তুহিনের মত অতি সাধারন একটা ছেলের চোখ দিয়ে আমরা দেখি – আমরা যা দেখে এসেছি নিজের চোখে, প্রতিদিন আমরা যা অহরহ পড়ি পত্র-পত্রিকায় – ছাত্র রাজনীতির অন্ধকার স্বরূপ, অন্যায়, অবিচার, নোংরামি৷
আমরা আরো দেখি – যা আমরা সাদা চোখে কখনোই দেখি না, জানি না, কিন্তু অনুভব করতে পারি – মৌলবাদ, নষ্ট মাস্টারমাইন্ডদের হাতে ব্রেন ওয়াশড হয়ে যাওয়া, পেডোফাইলের শিকার হওয়া মানুষের দূর্বিষহ পরিণতি, এসপিওনাজ, দেশের মাটিতে ভিন্ন দেশের এজেন্টদের ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে সুচতুর বিচরণ, ষড়যন্ত্র আর রক্তের হোলি খেলার নীল নক্সা!
অসম্ভব অসম্ভব রকমের সাহসী লেখা৷ নির্দ্বিধায় তুলে এনেছেন এমন অনেক কিছুই; যা আমরা থ্রিলার বইয়ে ছাপার অক্ষরে আশা করতে পারিনি কোনদিনই৷

Dhonsototto

দুর্দান্ত সব পাঞ্চ লাইন৷ প্রেম, বন্ধুত্ব নিয়ে একদম জীবন থেকে নেয়া অসাধারন কিছু উক্তি, সংলাপ৷ প্রতিটা সিকোয়েন্সের চমৎকার এবং পরিমিত ডিটেইলিং৷ ছোট ছোট ইন্টারেস্টিং অধ্যায়৷ বইয়ের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত চরিত্রগুলোর কনসিসটেন্সি মেইনটেইন (ছোট্ট একটা উদাহরণ – অতিনাটকীয়তা প্রিয় সূর্যের কনভারসেশনগুলো) আর রূপক ব্যাবহার করে চারপাশের পরিবেশের বর্ণনা (যেমন – অন্ধকারে বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাওয়া চারপাশে; জেগে থাকা পুলসিরাতের মত সরু একটা রাস্তা) – জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং৷
এবং দেওয়ান মমিনুল মউজউদ্দিন৷ হাসন রাজার নাতি, মরমী কবি এবং সুনামগঞ্জের তিনবারের নির্বাচিত মেয়র৷ উনার একটা অদ্ভুত সুন্দর কবিতার পঙক্তির অদ্ভুত সুন্দর উল্লেখ…
এবার আসি চাঁদের কলঙ্কের খোঁজে –
কারো কারো সংলাপ কখনো কথ্য কখনো শুদ্ধ৷
সুর্য, তুহিন আর আব্দুল্লাহর শহীদ মিনারের সিকোয়েন্সটা বেশ দুর্বল ও আরোপিত লেগেছে৷ অজ্ঞান একজনকে বাইকে তুলে এত ঘটনা সাজানো – কল্পনা করাটা কষ্টসাধ্য মনে হয়েছে৷
পুরো বইয়েই শুভ ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কিন্তু তার উপস্থিতি ছিল অশরীরীর মত৷ তুহিনের সাথে আবদুল্লাহর যে সম্পর্ক চিত্রায়িত হয়েছে তা শুভর সাথে দেখানো হয়নি এক বিন্দুও৷ তাই শুভর জন্য তুহিনের অনুভূতি ঠিক যুতসই হয়নি৷
কাকতালিয় ব্যাপার স্যাপার যে কোন গুরুভাবকে ড্যাম্প করে দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ৷ এত এত ভবন থাকতে জোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবনের ছাদেই কেন ইফতির নেশা করতে হল আর সূর্য, তুহিনের মাল লুকানোর দরকার পড়লো?
সবচেয়ে বড় যে দূর্বলতাটা আমার মনে লেগেছে; তা হল ‘মোটিভ’৷
– বাবার সাথেই যার বহু বছর দেখা হয়নি, সেই বাবার বন্ধুর মৃত্যুতে ‘দিবাকরের’ মোটিভ৷
– চাকরি থেকে অন্যায় ভাবে বরখাস্ত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া ‘ইফতির’ মোটিভ৷
বইটা মাস্টারপিস হবার সব রকম যোগ্যতা থাকা স্বত্ত্বেও শেষে এসে এই প্লটহোল গুলোর কারনে সেই সুযোগটা মিস করেছে৷
প্রথম বই হিসেবে প্রচন্ড ম্যাচিউরিটির পরিচয় দিয়েছেন লেখক৷ গল্পে, সংলাপে, এক্সিকিউশানে৷
ভূমিপ্রকাশের প্রোডাকশন দারুন৷ প্রচ্ছদ গড়পড়তা মানের৷
আসিফ সিদ্দিকী দিপ্র’র ‘একাত্তরের কানাগলি’, মাহমুদুস সোবহান খান’র ‘দ্যা মাস্টারপ্ল্যান’ এর পর ফাইয়াজ ইফতি’র ‘ধ্বংসতত্ত্ব অথবা ইসরাফিলের শিঙা’ নিঃসন্দেহে নবীন মৌলিক লেখকদের দুর্দান্তভাবে চমকে দেয়া কাজ৷

 

 


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply