ইমরানুল ইসলাম

বই হলো মনের খোরাক

প্রবন্ধ, মতামত
লেখাটি শেয়ার করুন

ইমরানুল ইসলাম,
চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

 

আমরা সবাই পরিবারের সদস্য। কেউ একক আবার কেউ যৌথ পরিবারের। আমাদের ব্যক্তি জীবনে চলার পথে প্রয়োজন নিখুঁত ভালোবাসার। এ ভালোবাসা কেউ পায় পরিবার, বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয় স্বজন , সমাজ থেকে। কেউ পায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে। জাগতিক নিয়মে অনেকে আমাদের খুবই আপন, শ্রদ্ধাশীল, বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে ওঠে। সেটা নারী-পুরুষ উভয় মহলের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। আমাদের কাছের বন্ধু ও আমাদের সাথে এক সময় রাগ,অভিমান, হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস ও ভুল বোঝাবুঝি হয়। আমাদের জীবন বৈচিত্র্যময়। জীবনের এক একটি ধাপে আমরা নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলি। স্বার্থপরতার যাঁতাকলে আমরা আবদ্ধ না হয়ে পারি না। তারপরও প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে একটি ভালো বন্ধু বা সঙ্গ প্রয়োজন।

আমার মতে, এই ভালো বন্ধুর তালিকায় বইকে স্থান দেওয়া যুক্তিযুক্ত। কেননা আমাদের চলার পথে বন্ধু মহলের সাথে কথা তর্কবিতর্ক হয়। সেজন্য বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্তোয় বলেছেন, জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়োজন, তা হচ্ছে বই,বই এবং বই। অর্থাৎ আমরা হাসলে বই ও হাসে আমরা কাঁদলে বই ও কাঁদে। আমরা ব্যক্তি জীবনের পরিপূর্ণ জ্ঞান বই থেকে আহরণ করতে পারি। সমস্ত প্রাণীজগতের সাথে মানুষের পার্থক্য এইখানে মানুষ তার জ্ঞানকে,বোধকে বইয়ে রূপ দিয়ে যুগ থেকে যুগান্তরের সাক্ষী হিসেবে রেখে যেতে পারে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম মনের খোরাক, দুঃখ-কষ্ট, হাসি, প্রেম ভালোবাসা সেখান থেকেই খুঁজে নিতে পারে।

বই আমাদের মনের খোরাক জোগায়। মনের কৌতূহল মেটায়। বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবীর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে বিস্ময়। অজানা, অদেখা, বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয় বই। আমরা বইয়ের মাধ্যমে মুহূর্তে ছুটে যেতে পারি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। এজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
বিশাল বিশ্বের আয়োজন
মোর মন জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এককোণ,
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে—–

এভাবে বই আমাদের মনের কৌতূহল মেটায়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ কখন ও কখনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যায়। এই চোরাবালি থেকে উদ্ধার হতে প্রয়োজন ভালো মানের বই। উৎকৃষ্ট বই মানুষকে দিতে পারে অনাবিল আনন্দ ও শান্তি। মানুষের উচ্চতর বৃত্তিগুলো চায় সত্য, জ্ঞান ও আনন্দের আলো।

আজকের এই দিনে আমরা কোথায় পাব হোমার,ভার্জিল,দান্তে, শেকসপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত? কোথায় পাব মাদাম কুরি,মার্কনি,আইনস্টাইন, জগদীশ চন্দ্র বসুকে? এই একবিংশ শতাব্দীতে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল আর কার্ল মার্কসকে প্রত্যক্ষভাবে দেখা অসম্ভব। কিন্তু তাদের সাহিত্য কর্ম অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা তাদের পেতে পারি নিকট সান্নিধ্য। এসব গুণী ব্যক্তিদের সাহিত্য কর্মের দ্বারা হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য, ভাষা সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্য সবকিছু সম্পর্কে ধারণা পাই।

মনীষীগণের ভালো বই মনের কুসংস্কার মনকে শুদ্ধ করে। মানুষ খুঁজে পায় যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার ঠিকানা। এতে মনের জানলা খুলে যায়,উঁকি দেয় মুক্ত ও বিশুদ্ধ চিন্তা। বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, সংসারের জ্বালা – যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করা এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। অর্থাৎ যে যত বেশি ভুবন তৈরি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার তত বেশি।

কবি ওমর খৈয়ামের বেহেশতের আসবাবপত্রের ফিরিস্তি বানাতে গিয়ে কাব্য গ্রন্থের কথা ভোলেননি, রুটি, মদ হয়তো নিঃশেষ হয়ে যাবে, সাকি ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু অমর কাব্য তার সাথে থাকবে অনন্ত যৌবনা সঙ্গিনীর মতো। অর্থাৎ বই আমাদের আনন্দের সঙ্গী। কত মানুষের পথ চলায় পদচিহ্ন পড়েছে এই পৃথিবীর বুকে,তার ছন্দকে ধরে রেখেছে বই। কত ভাষায় কত মানুষ কথা বলেছে, তার সঙ্গীত ধ্বনি স্তব্ধ মুখরতায় লিপিবদ্ধ বইয়ের পাতায়।

নির্জন অরণ্যে একাকী মানুষের নিঃসঙ্গতা দূর করে বই। নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত জনের চিত্তে নিঃসঙ্গতার বেদনা দূর করতে পারে বই। তাই মানুষ যত বেশি বই পড়বে,তত আনন্দ ও জ্ঞান লাভ করবে এবং বই পাঠের মাধ্যমে জ্ঞানের স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের সুযোগ পাবে। সৈয়দ মুজতবা আলী যথার্থ বলেছেন “বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না”। কারণ বই মানুষের জ্ঞান ও ঐশ্বর্যকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

তাই ভালো মানের বই আমাদের পড়ার বিকল্প নেই। তাইতো বিখ্যাত সাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কি বলেছেন,

আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী। পরিশেষে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।




লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply