সাব্বির সাদাত পিয়াস

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি, রাতগুলি…

মতামত, স্মৃতিচারণ
লেখাটি শেয়ার করুন

সাব্বির সাদাত পিয়াস ।। 

 

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মৃতিচারণা লিখেছেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাব্বির সাদাত পিয়াস।)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রেমটা অনেকটা কৈশরের প্রথম প্রেম। সাল ২০১৫। সদ্য এসএসসি পাস করেছি।  একদিন ঢাকা আসি। সম্ভবত এটা ছিল দ্বিতীয়বার ঢাকায় আসা। প্রথম যেবার এসেছিলাম তখন ক্লাস তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। ঢাকায় থাকার বন্দোবস্ত হয় এক ভাই কাছে, যিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নেমে দেখি ভাই আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর তিনি আমাদের নিয়ে কোথা থেকে যেন বাসে উঠলেন। বাস আমাদের শাহবাগ নামিয়ে দিল। আমরা হেঁটে যেতে যেতে জাদুঘর দেখিয়ে বললেন, ‘এটা হলো জাতীয় জাদুঘর।’ সেটা শুনার পরপর আমাদের মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে কাজী নজরুল ইসলামের সমাধী দেখালেন। তখন যাই দেখি তাই ভালো লাগে। সূর্যসেন হলের ক্যাফেটেরিয়াতে আসলাম। তিনি বললেন,‘আর কিছুক্ষণ পর থেকে আর খাবার পাওয়া যাবে না। তাই খেয়ে নাও এখনি।’
আমরাও ক্ষুধার্ত ছিলাম, খেয়ে নিলাম। খাওয়ার পর উনার হল বিজয় ৭১ হলে নিয়ে গেলেন। নতুন হল হবার সুবাদে হলটি চকচক করছিল (যদিও তখন জানতাম না যে নতুন হল), হলের ভিতরের পরিবেশও খুবই সুন্দর ছিল। পাঁচতলায় রুমে যাওয়ার পর দেখি, রুমটি কী সুন্দর! চারকোনায় চারটা খাট, টেবিল, লাইট, সবই আলাদা।

মনে মনে ভাবলাম, এই পরিবেশের জন্যই হয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল অন্যান্য হল থেকে আলাদা। যেহেতু এই হলগুলোর কথা অনেক শুনেছি। যারা হলে থাকতেন তারা খুবই গর্ব করেন হল নিয়ে। রাত কাটল আন্তরিকভাবে গালগল্প করে। তাদের এই আতিথেয়তার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের প্রেমে পড়ে গেলাম। এলাকার ভাই ক্যাম্পাস ঘুরে দেখালেন। অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য—ইশ কত দেখছি টিভিতে, আজ চোখের সামনে এটা দেখছি, কী যে ভীষণ ভালো লাগছিল।

সেদিনই মনে মনে একটা সুপ্তবাসনা কিংবা ইচ্ছা জেগে ওঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও হলের জন্য ইচ্ছাটা বেশি হয়েছিল। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার ট্রেনে আবার জামালপুর ফিরে আসি। এরপর আরও দুইবার ঢাকা গেলেও কখনো কোনো হলে থাকার সুযোগ হয় নি। দিন গেল, মাস গেল, বছরও  যেতে একসময় আমারও সুযোগ হলো পরীক্ষা দেওয়ার,পরীক্ষা দিলাম চান্স পেলাম।

২০১৭ সালে যখন ভর্তি হয়ে জানাতে পারলাম  আমাকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমি অনেকটা অবাক হয়ে গেলাম, আমি যে এই হলে থাকতে চাই, তারা কি করে বুঝল? মনে মনে খুশিই হলাম। এ রাজপ্রসাদে থাকব। কাজ শেষ করে আবার জামালপুর চলে আসি।
জামালপুর এসে ইন্টারনেটে খোঁজতে শুরু করি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সম্পর্কে। খুঁজে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম হল। আরও অবাক হয়ে জানতে পারলাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই হলের সাবেক আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। কী পরিমাণ আনন্দ লাগছিল— বলে বোঝাতে পারব না। আরও জানলাম, দেশের ১৪ জন রাষ্ট্রপতি এই হলের সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। তখন দেখতে লাগলাম, একাত্তর হলের কে কে ছিলেন? যেহেতু এই হলই আমি চিনতাম ভালো করে এবং এই হলে থাকার ইচ্ছাও ছিল প্রবল। জানলাম, হলটি নতুন। তখন ভাবলাম নতুন হল, এত সুন্দর। তাহলে না জানি, আমার হল আরও কত সুন্দর হবে। এত এত গুণীরা যেখানে থেকেছেন।

২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি তোষক,কম্বল, ট্রাংক এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে থেকে হল এলাম। পৌঁছে পরিচিত এক বড় ভাইকে ফোন দিলাম, ‘হলে উঠতে কি কি করতে হবে?’ ভাই আমাকে নিয়ে বারান্দায় একটি চৌকির উপর জিনিসপত্রগুলো রেখে বলে গেলেন, কিছুক্ষণ পর আসবেন বলে। আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর পাশের বিছানা থেকে একজন বলল, কেন তোষক ফেলছি না বেডের উপর। আমি বললাম, এখানে তোষক রেখে কি করব ভাই। রুম দেখতে গেছে যে রুমে থাকব। শুনে তার অট্টহাসি। তারপর সে বুঝিয়ে বলল,  এখানেই নাকি থাকতে হবে। আমরা যারা প্রথম বর্ষে ভর্তি হইছি তাদের নাকি রুম দেওয়া হয় না। শুনে ত আকাশ থেকে পরলাম। কী ভাবলাম আর কি হচ্ছে? বারান্দার সামনে, ডানে, বামে তিনদিকেই খোলা শুধু মাথার পিছে একটা দেওয়াল আর উপরে একটা ছাদ রয়েছে। যাকে বলা হয় খোলা বারান্দা। একসঙ্গে পাশাপাশি প্রায় ১০০ এর মত চৌকি সাজানো,  প্রতিটি চৌকিতে ২ জন করে থাকতে হবে।

জানুয়ারির কনকনে শীতকে ধীরে ধীরে পরাস্ত করতে শিখতে লাগলাম।  যদিও বেশ কয়েকবার ঠান্ডা, কাঁশিতে আক্রান্ত হই। নিজেদের অনেকটা ইউরোপের আশ্রয় প্রত্যাশী অভিবাসীদের মত মনে হত। যারা জঙ্গলে সামান্য একটা তাবুতে শীতের মধ্যে সামান্য গরম কাপড়কে আশ্রয় করে টিকে থাকতে লড়াই করে। আমরাও সামান্য একটা কম্বল জয় করার চেষ্টা করতাম। বেশি শীত হলে ২-৩জন একসঙ্গে থাকতাম। তবুও যারা একসঙ্গে  থাকতাম তারা একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে সবকিছুকে কাটিয়ে ওঠতে লাগলাম। এ সুখ শান্তি বেশি দিন থাকল না। বৈশাখী ঝড়ের সময় এসে গেল। যখন রাতে ঝড় ওঠত, তখন সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতাম দেওয়াল ঘেঁষে। নিরাপত্তার জন্য বর্ষাকালে দিনের বেলায় আনন্দ করলেও বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেললে কিংবা গোসল করলেও রাতে তা আমাদের কাছে অভিশাপ লাগত। কারণ তখন আমাদের না ঘুমিয়ে সারারাত বিছানাপত্র যেন না ভিজে সেই পাহারা দিতে হত। মাঝে মাঝে ঘুম একটু গাঢ় হলে বৃষ্টি নিজ দায়িত্বে ডেকে দিত। কখনো কখনো তোষক ভেজার কারণে দুই তিন দিন নিজের বিছানায় ঘুমুতে পারতাম না।

বারান্দায় কারেন্টের লাইন বলতে ছিল মাল্টিপ্লাগ থেকে মাল্টিপ্লাগের মাধ্যমে। কখনো কখনো শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুন লেগে যেত মাল্টিপ্লাগে। কেউ কেউ নিভানোর চেষ্টা করত কেউ বা ভয়ে পালিয়ে যেতাম। অনেকটা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতাম। কাকে বলতাম আমাদের দুঃখগুলো। তখন শুধুই ভাবতাম, কবে দ্বিতীয় বর্ষে ওঠব, কবে সিট পাব?
কিন্তু হায় মরিচিকার পিছনে ছুটেছিলাম।২-৪ জনের ভাগ্য বদলালেও আমরা অভিবাসীরা অভিবাসীই রয়ে গেলাম। শীতের দিন আসলে হয় ইউরোপের অভিবাসী, আর গ্রমের দিন হয়ে যায় রোহিংগাদের মত শরনার্থী। আগে শুধু ১ম বর্ষ একসাথে থাকলেও এখন ১ম,২য়,৩য় বর্ষের সবাই একসাথে থাকি।এখন যে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বুলি আওড়ানো হচ্ছে তার হাজার ভাগের একভাগও কখনো পাই নি। এভাবেই হয়তো আমরা একসময় তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়।

অথচ এমনটা হবার কথা ছিলো না ত।ইতিহাসের দিকে, ঐতিহ্যের দিকে তাকালে কেন আমাদের মনে হয় ঐসব রুপকথা? সময়ের সাথে সাথে আরো সুন্দর হবার কথা ছিলো,আরো গোছানো হবার কথা ছিলো।ঐতিহ্যের প্রদীপের নিচে একেমন বাস্তবতার অন্ধকার?
যেখানে তোমার সন্তান হয়ে থাকার কথা ছিলো আমাদের সেখানে আজ আশ্রিত হয়ে আছি।তবুও বলবো ভালোবাসি তোমায়,বেচে থাকো তুমি সহস্র, লক্ষ, কোটি বছর।অভিমান নিয়ে চলে গেলেও কখনোই ভাববে না তোমায় ঘৃনা করেছি। You will remain in my heart till my Death. শুধু একটাই আবদার এই অন্ধকারকে কখনো ঐতিহ্য বানিয়ো না। ধ্বংস করে দাও এর স্রষ্টাকে।

এমন একদিন আসবে তখন হয়ত আরও সুন্দর হবে, আরও পরিপক্ক,আরও গোছানো হবে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়। ভালোবাসি, হে রূপকথার প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়, বেঁচে থাকো তুমি সহস্র, লক্ষ, কোটি বছর।


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply