ফিরে আসা অথবা না আসা আমাদের পৃথিবী

বেল পাকলে কাকের কি!

গল্প, ছোটগল্প, স্যাটায়ার
লেখাটি শেয়ার করুন

মো. মুয়াজ্জাজুর রহমান মুয়াজ  ।। 

(Grasshopper’s Tale)

 

 

মুহিবের সিগারেটের নেশা নেই। সে শখের বশে সিগারেট খায়। সিগারেট হাতে নিলে একটা আলাদা ফিলিংস হয়, টেনশনের সময় নিকোটিন একটু আরাম দেয়। তার মা বাবা অবশ্য এ ব্যাপারে জানেন না। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন ছেলে তো এখনো ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না, সিগারেট খাবে কোত্থেকে? মুহিবের উচিত ছিলো তাদের কারো হাতে ধরা খাওয়া। নাহ, সে ধরা খেলো অপরিচিতা একটা মেয়ের হাতে। সে এক বিরাট ঘটনা।

ঈদুল ফিতরের ছুটি সবে শুরু হয়েছে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে যাত্রী এবং বাসের জটলা। একটু পরপর বাস আসছে, যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে সেটায় উঠছেন, গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। করোনার কারণে দুই সিটে একজন করে যাত্রী বসানো হচ্ছে। তাই একজন যাত্রীকে ডাবল ভাড়া দিতে হচ্ছে। এ নিয়ে অবশ্য কারো মাথা ব্যথা নেই। বাড়ি যেতে পারাই এখানে মূল বিষয়, ভাড়া কোনো বিষয় না।
মুহিব একটা বেনসন সুইচ ধরিয়ে গাড়িতে উঠলো। তার গন্তব্য সিলেট। গাড়ি ছাড়তে দেরী আছে, তাই যাত্রীরা এখনো সবাই আসেননি। মুহিব জানালার পাশের সিটে বসে বাইরে মাথাটা বের করে দিলো। সে আপনমনে সিগারেট ফুঁকছে। মাথায় তখন বাড়ি যাওয়ার চিন্তা। তার সম্বিৎ ফিরলো একটা মেয়েকন্ঠ শুনে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, সেই অপরিচিতা মেয়ের কণ্ঠ।মুহিব সেদিকে তাকালো। মেয়েটার বয়স বোঝা যাচ্ছে না। মেডিকেলে পড়েও মুহিব বয়স সস্পর্কে কোনো ধারণা করতে পারলো না। মেয়েটার মুখে মাস্ক নেই। তাই চেহারা স্পষ্ট। গোলগাল গঠন, ছোট ছোট চোখ। নাকটা একটু লম্বা। পরনে ঝোলা টপস। সে ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
“পাবলিক প্লেসে সিগারেট খান কেন হ্যাঁ?”
মুহিব থতমত খেয়ে গেল। বাসের গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে সিগারেটটা নিভালো। তারপর বলল,
“সরি”
“কি সরি? আপনি যে আমার উপরে ছাই ফেলেছেন খেয়াল আছে?”
মুহিব চুপ করে রইলো। মেয়েটা বাসে উঠে আসছে। মুহিবের কলিজা শুকিয়ে সাহারা মরুভূমি হয়ে গেল। হাত পা কাঁপতে শুরু করলো।
মেয়েটা এসে মুহিবের সামনে দাঁড়ালো।তার চোখমুখ এখন আর কঠিন মনে হচ্ছে না।যেন হঠাৎ করেই একটা কোমলতা চলে এসেছে। সে নরম গলায় বলল,
“সরি, আমার উপরে ছাই পড়েনি। এমনিতেই বলেছি।”
“কি?”
“আপনার কাছে আমার দরকার আছে একটু।”
“কি দরকার?”
“আপনি সিলেট যাবেন না?”
“হ্যাঁ। কি করে বুঝলেন?”
প্রশ্নটা করেই মুহিবের মনে হলো ভুল করেছে। সে সিলেটের গাড়িতে বসে আছে, সুতরাং গন্তব্য আন্দাজ করা কঠিন কিছুই নয়।
“সিলেটের গাড়ি কি বরিশাল যাবে? দেখেই তো বুঝেছি। এখন শুনুন”
“কি?”
“আমার একটা উপকার করতে হবে।”
“বলুন।”
মুহিব আবার ভয় পেলো। মেয়েটার চোখমুখের কোমল ভাবটা তার ভয় দূর করতে পারছে না।
“আমিও সিলেট যাবো। আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি?”
মুহিবের মনে এক ফ্যাক্টরি লাড্ডুর বিস্ফোরণ হলো। সাথে সাথে মনে পড়লো,এখন তো গাড়ির দু সিটে একজন করে বসতে হয়। সে মিনমিন করে বলল,
“কিন্তু এখন তো গাড়ির দুই সিটে একজন করে বসতে হয়। গাড়ির লোকজন মানবে না তো।”
“আরে মানবে। আপনি চুপচাপ থাকুন। আমি ব্যবস্থা করছি। আপনার আপত্তি নেইতো?”
মুহিব খুশি গলায় বলল,
“আপত্তি থাকবে কেন? কারো উপকার করতে পারলে আমার ভালোই লাগে।”
“বাহ, আপনি তো মহান মানুষ।”
মুহিব মুখ লুকিয়ে হাসলো। হাসিটা দেখতে দেয়া যাবে না। মেয়েরা গদগদ টাইপ ছেলে পছন্দ করেনা, তারা সিরিয়াস টাইপ ছেলেদের পছন্দ করে।তাই মুহিবকে সিরিয়াস ভাবটা ধরে রাখতে হবে।



গাড়ি ছাড়ার দুই মিনিট বাকি।মেয়েটা উঠে মুহিবের পাশে বসে পড়লো। গাড়ির সুপারভাইজার এসে বলল,
“আপা এখানে তো বসা যাবে না।”
মেয়েটা বলল,
“কেন?”
“নিয়ম তো নিশ্চয়ই জানেন।”
“ও আমার বয়ফ্রেন্ড। আমরা কালকে বিয়ে করবো। কালকে যাদের বিয়ে, তারা দুজন দুই গাড়িতে যাবে এমন তো হওয়া উচিত না। তাই না?”
“কিন্তু আপা আমাদের তো নিয়ম মেনে চলতে হবে, আপনি বুঝতে পারছেন না।”
“গাড়ি ছাড়বে রাত এগারোটায়। পৌঁছাবে সকাল পাঁচটায়। এই সময়ে কারো ঠেকা পড়েনি নিয়ম দেখতে আসবে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”
মেয়েটি দুটো একশ টাকার নোট সুপারভাইজারের দিকে এগিয়ে দিলো । আমাদের দেশে টাকা একমাত্র কাগজ, যেটা দেখালে সব মাফ। সুপারভাইজার একটু গাঁইগুই করে চলে গেল। গাড়ি চলতে শুরু করলো।

মেয়েটি মুহিবকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার নাম কি?”
“মুহিব। আপনার?”
“চন্দ্র।”
“বাহ, সুন্দর নাম তো।”
“জ্বি সুন্দর নাম, কিন্তু আমি দেখতে সুন্দর না।”
মুহিব হাসলো। এমন ভঙ্গি করলো যেন কথাটা শুনে সে অনেক অবাক হয়েছে। মুখে কিছু বললো না।মেয়েটার হাতে একটা ছোট ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সে কি যেন পড়তে শুরু করলো। মাঝখানে জিজ্ঞেস করলো,
“গাড়ির বিরতি দেয় কোথায়?”
“ভৈরব।”
“ঠিক আছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভৈরব এলে জাগিয়ে দেবেন।”
চন্দ্র সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লো। নাটকে বা সিনেমায় নায়িকা ঘুমানোর সময় নায়কের গায়ের উপর ঢলে পড়ে। মুহিবের ক্ষেত্রে এমনটা হলো না। মেয়েটা যথেষ্ঠ দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমাচ্ছে। সচেতনভাবে নড়াচড়া করছে। গাড়ি দ্রুত গতিতে চলায় বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। নীল রঙের আলো চন্দ্র’র মুখে পড়ছে। চেহারাটা মায়ামায়া দেখাচ্ছে। মুহিব সেদিকে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্র চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বলল,
“ঘুমান”

ভৈরব এসে বাস থামলো রাত দুটোর কিছু পরে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খাবার হোটেলের বারান্দা ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছে। যাত্রীরা লাফ দিয়ে দিয়ে নামছে। মুহিব আর চন্দ্রও নামলো। চন্দ্র বললো,
“আমার কাছে খুব কম টাকা আছে। আপনি কি করেন?”
“ডাক্তার।”
“বাহ, তাহলে তো ভালো ইনকাম। আমাকে একটা স্যান্ডুইচ খাওয়ান।”
মুহিব আর চন্দ্র একসাথে বসে স্যান্ডুইচ খেলো। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ মুহিব লক্ষ্য কয়েকটা ছেলে লাঠিসোঁটা হাতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মুহিব ভাবলো ওরা বোধ হয় অন্য কাউকে খুঁজছে।কিন্তু না, ছেলেগুলো এসে তাদের সামনেই দাঁড়ালো। সবচেয়ে ষন্ডা মার্কা ছেলেটা চট করে চন্দ্রর হাত ধরলো। বলল,



“কই যাস তুই? কি ভেবেছিস আমি কিছু জানি না?”
মুহিব অবাক হয়ে গেল। সে নিজে থেকে বিপদে পড়েনি, বিপদ তার উপরে এসে পড়েছে। চন্দ্র কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“কোথাও যাই না ভাইয়া।”
“এই ছেলে কে?”
“চিনি না। পাশের সিটের যাত্রী।”
“পাশের সিটের যাত্রী? আমারে ভুগোল বোঝাও?” ছেলেটা
মুহিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কে? সত্যি করে বলো।”
মুহিব প্রায় কেঁদে ফেলে বলল,
“সত্যি ভাই, আমি উনাকে চিনি না।”
মুহিবের কথা ছেলেটা প্রায় বিশ্বাস করেই ফেলেছিলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধালো বাসের সুপারভাইজার।সে এসে বলল,
“ভাইয়া, আপুকে নিয়ে উঠে পড়ুন, আমাদের গাড়ি এখনই ছাড়বে।”
মুহিব বলল,
“কে আপু? কোন আপু? আমি কাউকে চিনি না।”
সুপারভাইজার হেসে বলল,
“ভাইয়া ঝগড়া হয়েছে বুঝি?”
চন্দ্র’র দিকে হাত দেখিয়ে বলল,
“এই যে আপনার গার্লফ্রেন্ড।উনি আপু।”
মুহিবের কান্না এসে গেল। চন্দ্র’র বড় ভাই আগুনের মতো চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। মুহিব কি বলবে বুঝতেই পারছে না। সে কিছু বোঝার সময়ও পেলো না। লাঠির কয়েকটা আঘাত তার হাত পায়ে ঠাস ঠাস করে নেমে এলো। কচি হরিণ ছানা পেলে বাঘ যেমন খুশি হয়, চন্দ্রের ভাই আজকে তেমন খুশি। মুহিবকে মারছে, আর খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বৃষ্টির ছাট বাড়ছে। মুহিব দুনিয়াতে যতো কিছু আছে, সবকিছুর কসম খেয়ে বলছে সে মেয়েটাকে চেনে না। তবু ভাই সাহেব বিশ্বাস করছে না। দুপদাপ কিল ঘুষি আর ঠুসঠাস লাঠির বাড়ি পড়ছেই।মুহিবকে মারামারি পর্বের মধ্যেই আরেকটা নতুন নাটক ঘটে গেল। মোটরসাইকেল নিয়ে একটা ছেলে এসে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়ালো। চন্দ্র তার ভাইয়ের হাতে কামড় দিয়ে ছাড়া পেয়ে সে ছেলের পিছনে উঠে বসলো। মোটরসাইকেলটা হাইওয়েতে উঠেই নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল। মারামারি পর্বের দর্শক এবং অভিনেতারা কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।

মুহিবকে ছেড়ে দেয়া হলো। সে যখন বাড়ি পৌঁছালো তখন তার গায়ে চারটা সেলাই আর তিনটা ব্যান্ডেজ। ছিনতাইকারির কাজ বলে মুহিব নিজের মুখ রক্ষা করলো। সে নিজের বুক পকেটে একটা চিরকুট পেলো,
“ভৈরব নেমে যাবো।সেখানে আমার বিএফ আসবে।আমরা পালিয়ে বিয়ে করবো। আমার ভাইয়া আসতে পারে,সাবধান থাকবেন।”
মুহিব পস্তাতে লাগলো,চিঠিটা যদি একটু আগে দেখতো তাহলে হয়তো মারগুলি হজম করতে হতো না। মুহিব সাবধান হয়ে গেল। বাসে উঠলে এখন সে পাশের সিটে চার পাঁচটা ব্যাগ রাখে। সে মনে মনে ঠিক করলো, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে চিরকুমার সংঘের ফরম কিনবে… 😬😬




লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply