মো ফেরদৌস আলম

মানবাধিকার ও কিছু কথা

প্রবন্ধ, মতামত
লেখাটি শেয়ার করুন

মো: ফেরদৌস আলম
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

দেশ গঠনে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড না থাকায় হয়েছে নানা অনাসৃষ্টি। কোথাও বড়, কোথাও ছোট; জনসংখ্যার ঘনত্ব কোথাও বেশি, কোথাও কম। কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে, কোথাও ভাষার ভিত্তিতে, কোথাও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। কখনও বিশ্বযুদ্ধ বা যুদ্ধ এই অনাসৃষ্টিতে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। জয়-পরাজয়, শান্তি-অশান্তি সবই মানুষের। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষের বাঁচার দাবি সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সত্য হয়ে আছে। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ”সব মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং তাদের মর্যাদা ও অধিকার সমান।” সবাই মানুষ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মানুষ। মানুষের বিচিত্র অধিকার একের পর এক বর্ণনা করা হয়েছে ১৯৪৮ সালে ঘোষিত মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে। এর আগেও মানবাধিকারের ধারণা ছিল। মানুষের অধিকার ছিল। অধিকারের লঙ্ঘনও ছিল। মানুষের ইতিহাসে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যা বিভিষীকার নিষ্ঠুর মানদণ্ড হয়ে রয়েছে। যাহোক, বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার বিতর্কে যেসব অঞ্চল আলোচনায় এসেছে সেসবের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। একে একে দায় এড়িয়ে যায় দেশগুলো। জাতিসংঘ দায় এড়াতে ব্যর্থ হয় প্রায়ই। এর দায়সারা বার্তা দায় এড়াতে দেয় না সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। এ দায় কার? ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার মানদণ্ড কী পরিমাণে বিপর্যস্ত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু সংখ্যালঘু নয়, হিংস্র শক্তির কাছে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ও নিপীড়িত হয়েছে যুগে যুগে। এ যেন অদৃষ্টের পরিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি নিধন নিয়ে তো সমালোচনাই নিষিদ্ধ ইউরোপের কোনো কোনো দেশে! এ দায় কার উপর চাপিয়ে দিয়ে এড়িয়ে যাবে তারা? ঘুরেফিরে দায় আসে দায়ীদের উপর। কিন্তু স্বীকার করতে রাজী নয় তারা।

 

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটি গল্প বলা যায়। একবার নাসিরুদ্দিন নির্দিষ্ট পরিমাণ গোশত নিয়ে স্ত্রীর কাছে দিয়ে বললেন, খুব ভালো করে রান্না করতে। অনেকদিন গোশত খাওয়া হয়নি। এই বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন জরুরী কাজে। স্ত্রী বেচারি লোভ সামলাতে পারলে না। সব গোশত একাই সাবাড় করে দিলেন। নাসিরুদ্দিন ফিরে এসে যখন গোশত খেতে চাইলেন তখন স্ত্রী পড়লেন মহাবিপদে। তিনি উপস্থিতমতে বলে দিলেন সব গোশত বিড়াল খেয়েছে। নাসিরুদ্দিন তো হতবাক! তিনি বিড়ালটাকে ধরে দাড়িপাল্লায় চাপালেন। দেখা গেল বিড়ালের ওজন গোশতের ওজনের সমান। নাসিরুদ্দিন তার স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, যদি এটা বিড়াল হয়, তাহলে গোশত কোথায়? আর যদি এটা গোশত হয়, তাহলে বিড়ালটি কোথায়? আমাদেরও প্রশ্ন, দায় যদি কারো না হয়, তাহলে দায় কার? বিড়াল যদি গোশত খেয়েও থাকতো তাহলে গোশতের ওজনের চেয়ে বেশি হতো তার ওজন। আর যেখানে রক্ষকই ভক্ষক, সেখানে বিড়ালের ওজন কোনো বিষয় নয়। যার অর্থ দায় চাপিয়ে দায় এড়ানো দেশগুলোর দায়ই বেশি।

 

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন তিনি সেদিনই শান্ত হবেন যেদিন অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না। কবির বাণী আজও অশান্ত। মানুষের মুক্তি কীসে? মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি বর্ণিত একটি রূপক কাহিনী এখানে উল্লেখযোগ্য। একবার গজনীর রাজদরবারে সুলতান সভাসদদের একটি চমৎকার পাথর দেখিয়ে এর মূল্যায়ন করতে বললেন। উজির প্রশংসা করে বললেন, জাঁহাপনা! এ অতি মূল্যবান পাথর। পৃথিবীর অতি আশ্চর্য বস্তু। তখন সুলতান উজিরকে আদেশ করলেন, এখনি ভেঙে ফেলুন এটি। কিন্তু উজির অপারগতা প্রকাশ করে বললেন, সুলতানের পছন্দের বস্তু তিনি নষ্ট হতে দেবেন না। এরপর সেনাপতি বললেন, হুজুর! এ বিরল হীরক খন্ড তুলনাহীন। সুলতান সেনাপতিকেও পাথরটি ভাঙতে বললেন। সেনাপতি অস্বীকার করে বললেন, সুলতানের প্রিয় পাথর তিনি নষ্ট করতে পারবেন না। এভাবে সভাসদরা কেউই পাথরটি ভাঙতে চাইলেন না। দরবারে সুলতানের প্রিয় পাত্র আয়াজ উপস্থিত হলে তাকেও পাথরটি দেখানো হলো। আয়াজ ভূয়সী প্রশংসা করলেন এর। সুলতান তাকেও এটি ভাঙতে বললেন। আয়াজ সাথে সাথে পাথরটি ভেঙে চূর্ণ করে ফেললেন। সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, একি করলেন, আয়াজ! আয়াজ বললেন, এ পাথর অনেক মূল্যবান কিন্তু সুলতানের আদেশ আমার কাছে তারও চেয়ে মূল্যবান। সুলতান খুশি হলেন। এ কাহিনী থেকে আমরা মানবাধিকারকে সুলতানের আদেশের সাথে তুলনা করতে পারি। সৃষ্টিকর্তার অমোঘ বিধান এবং সৃষ্টির অমোঘ শৃঙ্খল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ যে স্বার্থই আসুক, মানবাধিকার সবার আগে। হীরক খনিতে মানুষ ধুঁকে ধুঁকে আর মরবে না। সোনার খনিতে মানুষ হারিয়ে যাবে না। তেলের খনির জন্য মানুষের জীবন বিপন্ন হবে না। মানুষের জীবন সব থেকে দামী। বড়ু চণ্ডীদাস বলেছেন, ”সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।”


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply