মিলনের পথে: ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ পর্ব
সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।
তেরো
দেবীকা যেদিন তার বৌদিকে নিয়ে মাঝপথে বাস থেকে নেমে পড়েছিল সেদিন থেকে অশােক নিজেকে অপরাধীর মতাে সবসময় নিজেকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখতাে। একটু ভুলের জনাে পরস্পরের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়তার জন্যে অনেক তো মাশুল গুনতে হয়। সে কথা বলার আগে মনে করি দুই বন্ধুকে। আজ শােভন এসেছে, অশােকের কাছে। তারা দুজনেই পরীক্ষা দিয়েছে। বর্তমানে যা অবস্থা মনে হয় বছর খানেকের মধ্যে না হলে বি.এ., বি.এস.সি,
পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয় না। এই খবরটুকু তাদের জানা বলেই তারা দুজনে যুক্তি করে কিছু করতে চায়। কিন্তু কি করবে তারা। বর্তমান বেকার যুগে কিই বা করার আছে। অনেক আলােচনার পর তারা ঠিক করলাে তারা দুজনে মিলে টিউটোরিয়াল হােম খুলে স্বল্প বেতনে শিক্ষাদান করবে। কিছুদিনের মধ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। তারা রূপাডিহির ও সােনাদিঘির সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে তাদের মনের কথা বললাে। কুড়িজন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে তারা শুরু করলো তাদের শিক্ষাদান। প্রত্যেকের কাছে পঁচিশ টাকা করে নিয়ে তাদের হিসেবে পাঁচশাে টাকার মতাে হবে। তারপর দুজনের ফিফটি ফিফটি। অশোক শােভনের টিউটোরিয়াল হােম ভালােভাবেই চলছে। এতে স্টুডেন্ট কল্যাণের ফলে তাদের দুই বন্ধুর সম্মান দুই গ্রামেই বেড়ে গেছে। দুজনের নম্রতা প্রত্যেক গ্রামবাসীর কাছে প্রশংসার বিষয়বস্তু ছিল।
আর দুই বন্ধু অশোক ও শােভন তাদের নতুন ভাব দর্শনের স্রোতে ভেসে চললাে। ছােট ঘটনাটি ঘটলে হয়তাে অশােক দেবীকার মধ্যেকার সম্পর্কে কতখানি দৃঢ় তাহা বুঝা যেত না। অতি প্রত্যুষে উঠে অশোক শােভনের বাড়ি গেল আজ সুদীর্ঘ তিন মাস পরে। শােভনের বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই অশােক, দেবীকা কে ফুল বাগানে দেখতে পেল। আড়ালে দাঁড়িয়ে অশোক তাকে নিরীক্ষণ করতে থাকলাে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে দেবীকা ঘুরে দাঁড়াতেই অশােকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। এক পলক তাকিয়েই দেবিকা ঘাড় নীচু করে ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো, অশােক তাকে ডেকেও উত্তর পেল না। অশোক চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মাসীমার অর্থাৎ সবিতা দেবীর ডাকে সচকিত হয়ে সে ঘুরে দাঁড়ালাে। সীতা দেবী তাকে এতদিন না আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
অশোক আমতা আমতা করে কোনরকম শােভনের ঘরে প্রবেশ করল। প্রায় দু তিন ঘণ্টা পরে অশােক যখন শােভনের ঘর থেকে বাইরে এল তখন দেবীকা লাল পাড়ের শাড়ি পরে কলেজের পথে পা বাড়িয়েছে। বর্তমানে গলসি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। অশােক দেবীকার পিছু নিল। দেবীকা কিন্তু অনড়, অচল। সে ভুল করে একবারও অশােকের ডাকে সাড়া দিল না বা তাকাল না। অশােক কাতর স্বরে বারংবার বলতে শুরু করলাে। দেবীকা তুমি আমায় ভুল বুঝাে না। আমি তােমায় আমি তােমায় ভালােবাসি। পথের মাঝে তার ফলে সে সিনক্রিয়েট হলাে। তার প্রতি বিন্দুমাত্র লক্ষ্য ছিল না অশোকের। পথযাত্রীরা প্রত্যেকে ভুল বুঝে অশোকের পথ রুদ্ধ করলো। অশোক পাঁচ ছয় ব্যক্তির বেড়া ভেঙ্গে দেবীকার কাছে যেতে চেষ্টা করলাে কিন্তু দেবীকা তার প্রতি ভ্রক্ষেপ মাত্র না করে বাসে উঠে আপন পথে এগিয়ে গেল। অপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তির হাতে প্রহৃত হয়ে অশোকের হৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হলাে সেই ক্ষতের দাগ নিশ্চিহ্ন হতে যুগ যুগ হয়তাে কেটে যাবে। তবু সে দেবীকার সামনে এ মুখ দেখাবে না।
তার প্রতি বিন্দুমাত্র আসক্তি ও নেই।ও ভুলবে না,এই প্রতিজ্ঞা করলাে। অশােক ও শােভনের বি.এ. পরীক্ষার ফল ঠিক এক বৎসর দেড় মাস পর প্রকাশিত হল। অশােক ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করেছে আর শােভন ফরটি ফাইভ’ পারসেন্ট পেয়ে পাশ করেছে। শােভন গ্র্যাজুয়েট হওয়ার প্রথম খবর মা, বাবাকে দেওয়ার পর,বীথিকার বাড়ি গেলাে। কিন্তু বীথিকার পাশে বসে কে ওই তরুণী পিছন দিকে থেকে দেখার ফলে তাকে চেনা যাচ্ছে না। শােভন এগিয়ে না গিয়ে দুর থেকে ইশারা করে বীথিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাে। বীথিকা উঠেআসতে পাশের তরুণী ঘুরে বসে দেখলাে শােভনকে, আর দেখল শােভন ও বীথিকা ঘনিষ্ট অবস্থায় দাঁড়িয়ে। খুশির প্রথম চুম্বন আঁকলাে বীথিকার চিবুকে শােভন। তারপর…. আর দেখতে পারলাে না তরুণীটি। দৌড়ে বেড়িয়ে গেল সে। বীথিকা বান্ধবীকে ডেকে উঠলাে। এই অপর্ণা কোথায় যাচ্ছিস?স্তম্ভিত শােভন। এমনভাবে আঘাত দিতে চায়নি অপর্ণাকে। সে জানতাে অপর্ণা তাকে ভালােবাসে। কিন্তু শােভন যাকে একবার তার বােনের আসনে বসিয়েছে তাকে প্রেমিকার আসন দিতে পারেনি। এটা শােভনের নীতি বিরুদ্ধ। শােভনকে ধাক্কা দিয়ে বীথিকা সহজভাবে বলে উঠলাে, পূৰ্ব্ব প্রেমিকা বুঝি ?
চৌদ্দ
আজ রবিবার। ১২ই জানুয়ারী। অশােক ও শােভন যৌথভাবে আজ একটি পার্টি দিয়েছে তাদের পাশ করার আনন্দ স্বরূপ। সেখানে নিমন্ত্রিত আছেন অনেকে। প্রথমত দুই পরিবারের সকল সদস্য এবং এ ছাড়া উভয় পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ব্যক্তি। যেমন গােপালবাবু ও মেয়ে অপরূপা আর বীথিকা ও তার পিতা অরুণ মুখার্জী ও মাতা রিয়া দেবী, অপর্ণা বীথিকার বন্ধুত্বের সূত্র ধরে।।
অশােক ও শােভন তাদের উভয়ের মিলিত টিউটোরিয়াল হােমের অর্থ খরচ করে,ব্যবস্থা করেছিলাে অতিথিদের জন্য, সবরকম ব্যবস্থা। সবসময় ভেসে আসছিল সংগীতের মিষ্টি সুর। সুদৃশ্য অলােকসজ্জা আর সুরুচিকর খাদ্য পরিবেশনের মাধ্যমে আসর জমে উঠেছিলাে। অরিন্দম ও অপরূপা একটি পপ সংগীত গাইতে তালে তাল নাচতে থাকে। তার সঙ্গে নাচতে থাকে উপস্থিত সকলে। শােভন ও অশােক একই সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে থাকে। – “যদি তাের ডাক শুনে ..”.
এরই মধ্যে চলতে থাকে আর একটি নাটক। দেবীকা অশোকের হৃদয়ের গভীর ক্ষতের কথা জানতে পেরেছে। সেই ক্ষতস্থানে প্রলেপ দেওয়ার জন্যে সে বারবার অশােকর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। অশােক আজ সেই অশোক নেই সে আজ দিশেহারা আজ সে একটু ড্রিংকসও করছে। ব্যথা হঠাৎ বুকে এসে অশোকের সঙ্গ দিতে শুরু করেছে। সে কোমর দোলাতে দোলাতে অশোকের কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে। আর ঘন ঘন ক্যামেরার ফ্লাশ গর্জন করে চলেছে শােভনের হাত থেকে।।
শােভন, অপর্ণাকে পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে সােফায় বসল। অপর্ণা ঘরে বসে তার দাদা অশােকের সঙ্গে নাচছে, দেখছে কি সুন্দর ভঙ্গিমায় তার বান্ধবী বীথিকা তার দাদার সঙ্গে কতক্ষণ গান গাইছে। সে কেন পারছেনা। তাদের মানসিকতার, শিক্ষাদীক্ষার ফারাক মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাে। সে আরও বুঝতে পারলাে ভালােবাসা কোনদিন মরে না। সে তার আপন গতিপথে স্বতঃস্ফূর্তি ভাবে এগিয়ে চলে। সে কি করল, তার দাদা অশােকের চোখ তারই দিকে চেয়ে আছে। সে দাদার অন্তরের কথা যেন বুঝতে পারল। সে দ্রুত উঠে পড়ে দেবীকার পাশে দাঁড়াল। শােভন এ দৃশ্য উপভােগ করতে লাগল। দেবীকার পাশে দাঁড়ানাে মাত্র অপর্ণা এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলাে। সে দেবীকাকে ডেকে বাইরে পূর্ণিমার আলাের মধ্যে বসল। দেবীকার মুখের এবং অশ্রুসজল চোখের ভাষায় অপর্ণা ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলব্ধি করলাে।
রূপা অপেরার চাহিদা বেড়েই চলেছে। অপেরা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক হিসাবে গােপালবাবুর সুনাম চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়ে চলেছে। আজ পর্যন্ত অনেক নামীদামী অপেরার পার্টির থেকে রূপা অপেরাটির বৈশিষ্ট্য আলাদা। সুদর্শন সান্যাল বিশেষ লোক, যে কোনাে বইয়ের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতেন। কিন্তু অরিন্দম সে বিষয়ে কোনাে গুরুত্ব দিত না। গােপালবাবুর নির্বাচন মতাে সে অভিনয় করে যেত। অপেরার স্বার্থে গােপালবাবু কিছু পরিবর্তন করতে চাইলেন। কিন্তু সর্বপ্রথম তিনি বাধা পেলেন সুদর্শন সান্যালের কাছে। নিজেকে তিনি একজন বড়াে অভিনেতা বলে অহংকারে মত্ত ছিলেন। গােপালবাবুর মতে সুদর্শনবাবুর অভিনয়ের শিক্ষার অনেক অভাব ছিল। তিনি অরিন্দমকে প্রধান চরিত্রে মনােনীত করতে চাইলেন। কিন্তু সুদর্শন সান্যাল এই সুযােগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না।। গােপালবাবুকে কথা দিলেন যে এবার তিনি সাধ্যমত অভিনয় করে তার আসন পাকা করে নেবেন।
সান্যাল ধনী দুলালের পুত্র কিন্তু তার অর্থের প্রলােভন ছিল বেশী। সে। চেয়েছিল প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে বেশী উপার্জন করতে। গােপালবাবু সহৃদয় লোক। তিনি সুদর্শন সান্যালকে আর একটি সুযােগ দিলেন। অরিন্দমের কিন্তু কোনো বিকার নেই। গোপালবাবুই তার গুরুদেব।তার নির্দেশমতাে চলতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।।