আমিনুল

শুরু

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

আমিনুল ইসলাম ।।

 

 

আমরা বাড়িটার কাছে চলে গেলাম। বাড়িটা গ্রামের একদম শেষ মাথায় অবস্থিত। বিশাল বড় জায়গায় কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, নির্জন একটা বাড়ি। গেটে বা কোথাও কোনো দারোয়ান নেই। বাড়িটাও একদমই পুরানো লাল ইটের একটা একতলা বাড়ি। এরকম বাড়ি এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। এই বাড়িটাকে রহস্যময় বাড়ি ভাববার মতো যথেষ্ট কারণ আসলেও আছে।

এবার আমরা ঘুরে ঘুরে বাড়িটার পেছনে চলে গেলাম, পেছনে একটা জায়গায় কাঁটাতারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়লাম তিনজন। সামনেই একটা ছোট পুকুর। পুকুর ধরে পাশ দিয়ে এগুতেই হঠাৎ করে একজনের সামনে পড়লাম। চমকে উঠলাম তিনজনেই। হিমেল আর মাহির আমাকে ফেলেই দিলো দৌড়।
হিমেল একবার চ্যাঁচালোও
“দৌড়া রিমন!” কিন্তু আমি তখন নড়তেও পারছি না, আমার পায়ে যেন শিকড় গজিয়েছে। লোকটা আমার মুখে টর্চের আলো ফেলল, তীব্র আলোর ঝলকানিতে আমি কিছু দেখতে পেলাম না। তারপরই আমাকে অবাক করে দিয়ে শ্লেষ্মা জড়িত কন্ঠে আমার নাম উচ্চারণ করলো।
“রিমন”

ঘটনাটা শুরু দুপুরে যখন আমি কলেজ থেকে ফিরছিলাম।

আমাদের শহরটা মফস্বল শহর, আসলে মফস্বল শহর বললেও ভুল হবে। মফস্বল শহরে যেটুকু কোলাহল থাকে সেটুকুও নেই এই শহরে। শহরের মাঝ দিয়ে একটা পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে বহুদূর। সে সড়কের দু’পাশে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্কুল, কলেজ আর সরকারি কয়েকটা ভবন। ব্যস এটুকুই, শহরে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটেনি, অন্তত আমার জন্মের পর তো নয়ই। বাংলাদেশের অনেক গ্রামও নিশ্চয়ই এর থেকে মজার, ঘটনাবহুল। আর শহরের মতোই আমার দীর্ঘ আঠারো বছরেও তেমন কোনো মজার অভিজ্ঞতা নেই, নেই কোনো উত্থান পতন। আমার বন্ধু বুলবুল, এস এস সি পাশ করে ঢাকার কলেজে গিয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রতিবার বন্ধে এলে কত শত গল্প করে সে, আমি হা করে শুনে যাই শুধু। গতবার বলেছে তার নাকি একটা গার্লফ্রেন্ডও হয়েছে। তারা দু’জনে কখনও কলেজ ফাঁকি দিয়ে ফুচকা খেতে যায় আবার কখনও বা বেইলি রোডের বৃষ্টিতে ভিজে। আমি বুলবুলের কথা শুনে ভাবি, ‘ইশ! আমার জীবনটাও যদি এমন হতো!’ বাবার জন্যই, বাবাই তো ঢাকার কলেজে যেতে দেয়নি। বাবা শহরের একমাত্র ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের অধ্যাপক। তার কল্যানে মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে পড়া সত্ত্বেও আমার ফিজিক্সের জ্ঞান দেখে কলেজের স্যাররাও চমকে যায়। যাবেই না কেন? যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি, সবাই যেত ক্রিকেট খেলতে আর আমাকে বসিয়ে বসিয়ে নিউটনের সূত্রের প্রমাণ গেলানো হতো। এরপর ক্রমান্বয়ে আরও বেশি… আরও বেশি…। ইদানীং তো বাবাও মাথা চুলকে বলে, “তোকে শেখানোর মতো আর কিছুই জানা নেই রে রিমন।”

অবশ্য আমি বাবা আর ফিজিক্স দুটোকেই ভীষণ পছন্দ করি। অবসর সময়ে আমি ফিজিক্সের বিভিন্ন সূত্রগুলোর কল্পনা করতে থাকি, সময় অতিবাহিত হতে থাকে। এমনকি আমি ঘুমালেও ফিজিক্স নিয়েই স্বপ্ন দেখি। এ কথা বন্ধুদের কানে গেলে নিশ্চয়ই আমার কপালে খারাবি আছে। এমনিতেই আমার ডাকনাম ‘আঁতেল আইনস্টাইন’। এতসব ভাবতে ভাবতে সড়কটা ধরে আনমনে হেঁটে যাচ্ছিলাম।
“অ্যাই আঁতেল আইনস্টাইন, আইনিস্টাইইই!” কে যেন চেঁচিয়ে ডাকলো। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি হিমেল আর মাহির ছুটে আসছে।

হিমেল শহর থেকে ভেতরের দিকে একটা গ্রামে থাকে। একদম পারফেক্ট গ্রামের দস্যি ছেলে যাকে বলে। এইতো সেদিনও কলেজের প্রিন্সিপালের বাসার গাছের আম পেড়ে খেয়েছে। আমার তো সারা সময় জুড়ে বুক ধুকপুক করছিল, যদি ধরা খাই!
“দাঁড়া শালা।” হাটুতে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মাহির। বেশ মোটাসোটা হওয়ায় অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠে সে। হিমেল অবশ্য প্রায় স্বাভাবিকই।
“কি হলো? চ্যাঁচাচ্ছিলি কেন?”
“আরে ইন্টারেস্টিং একটা জায়গা পাইছি। যাবি নাকি?”
“ইন্টারেস্টিং মানে?”
“হিমেলদের এলাকায় একটা পাগলা সাইন্টিস্ট থাকে। সে নাকি এলিয়েন নিয়ে গবেষণা করে। আমি যাচ্ছি হিমেলদের বাড়ি। কাল শুক্রবার আছে। তুই যাবি?”
“এলিয়েন! তোর কি মাথা খারাপ? আমারে বলদ পাইছিস?”
“হ, বিশ্বাস না করলে তুই ওরে জিগ্যেস কর।” হিমেলের দিকে ইশারা করে মাহির।
আমি অবিশ্বাস নিয়ে তাকাই হিমেলের দিকে,
“খোদার কসম, শালার বাড়িতে এলিয়েন আছে। আমি নিজের চোখে দেখছি।”
“তুই নিজের চোখে দেখছিস?”
“মানে গ্রামের সবাই দেখছে।”
“আচ্ছা! এলিয়েন কেমন দেখতে? বল তো শুনি।”
“ চিকনা, সবুজ কালার। বড় বড় চোখ আর লম্বা।” চোখ বড়বড় করে যে ভঙ্গিতে বলল হিমেল যে কেউ ভাববে সে আসলেও নিজের চোখে দেখে এসেছে এলিয়েন।
“তুই জানলি কীভাবে? তুই না বলে দেখিস নাই?”
“আরে, সবাই দেখছে। তারা বলছে। আমগো গ্রামের সবাই দেখছে।”
“সবাই?”
“মানে অনেকেই আর কী।”

আমি বুঝে গেছি ঘটনাটা। এর আগেও একবার এমন হয়েছে, সেবারেও হিমেল সবাইকে সৃষ্টিকর্তার নামে মাথায় হাত রেখে কসম কেটে বলে নিয়ে গিয়েছিল যে, ‘তাদের গ্রামে ভূত আছে।’ ভূত তো দেখতেই পারেনি কেউ, যারা গিয়েছিল তাদের কয়েকজন এক বিড়ালের খামচি খেয়ে এসেছে। কালো একটা বিড়াল ছিল সেই ভূত থাকা পরিত্যক্ত বাড়িটায়। হিমেল অবশ্য এরপরও গলা বড় করে বলেছে ভূতই নাকি বিড়ালের বেশ ধরে খামচি দিয়েছে। যারা গিয়েছিল তারা যদি অপেক্ষা করতো তবে অবশ্যই দেখতে পেত।

আমি ভাবতে থাকলাম, হিমেলের বলা বাড়িটায় এলিয়েন না থাকলেও কিছু আছে নিশ্চয়ই। আর সেটা দেখতে যাওয়াও নিশ্চয়ই মজার হবে।
“আচ্ছা, দেখি বাবাকে বলবো। যদি রাজি হয় তবেই যাবো।”
হিমেল আর মাহির আমার কথায় খুশি হয়ে গেল। একজন সঙ্গী তো বেড়েছে।

হিমেল আর মাহিরকে সাথে নিয়েই ফিরলাম বাসায়। বাবা বাসাতেই আছেন। আর উনাকে বলামাত্রই রাজিও হয়ে গেলেন। ঢাকার কলেজে যাওয়া ছাড়া বাবা আজ পর্যন্ত আমার কোনো কথা এমনিতেও ফেলেননি।
***
বিকেল পার করে বাসা থেকে বের হওয়ার কারণে হিমেলের বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত আটটা বেজে গেল। সারা গ্রাম তখন নীরব হয়ে গিয়েছে। একটু দূরে দূরে বিভিন্ন বাড়ির লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে।

হিমেলের বাড়িতে গিয়ে আমরা খাওয়া-দাওয়া করে নিলাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম, আসলে ঘুমাতে যাবার ভান করে হিমেলের বাবার ঘুমানোর অপেক্ষা করছিলাম। উনি জানলে বের হতে দিবেন না।

ঘড়িতে সময় যখন রাত এগারোটা তখন আমরা তিনজন পা টিপে টিপে হিমেলদের বাড়ি থেকে বের হলাম। এরই মধ্যে হিমেলের কাছ থেকে জানতে পারি, ওই বাড়িতে যে লোকটা থাকে তার নাম প্রবির মিত্র। লোকটার বাসার বাইরে রাখা বাড়ির নেমপ্লেটে হিমেল দেখেছে। সে নাকি একা থাকে, কারও সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে না। কেউ তার বাড়ি যাক সেটাও চায় না।

আমরা বাড়িটার কাছে চলে গেলাম। বাড়িটা গ্রামের একদম শেষ মাথায় অবস্থিত। বিশাল বড় জায়গায় কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, নির্জন একটা বাড়ি। গেটে বা কোথাও কোনো দারোয়ান নেই। বাড়িটাও একদমই পুরানো লাল ইটে তৈরি একতলা বিশিষ্ট, এরকম বাড়ি এখন আর সচারাচর দেখা যায় না। এই বাড়িটাকে রহস্যময় বাড়ি ভাববার মতো যথেষ্ট কারণ আসলেও আছে।

এবার আমরা ঘুরে ঘুরে বাড়িটার পেছনে চলে গেলাম, পেছনে একটা জায়গায় কাঁটাতারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়লাম তিনজন। সামনেই একটা ছোট পুকুর। পুকুর ধরে পাশ দিয়ে এগুতেই হঠাৎ করে একজনের সামনে পড়লাম। তিনজনই ভয়ানক চমকে উঠলাম। হিমেল আর মাহির আমাকে ফেলেই দিলো দৌড়।
হিমেল একবার চ্যাঁচালোও
“দৌড়া রিমন!” কিন্তু আমি নড়তেও পারলাম না, আমার পায়ে যেন শিকড় গজিয়েছে। লোকটা আমার মুখে টর্চের আলো ফেলল, তীব্র আলোর ঝলকানিতে আমি কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপরই আমাকে অবাক করে দিয়েই শ্লেষ্মা জড়িত কন্ঠে আমার নাম উচ্চারণ করলো,
“রিমন”

সাথে সাথেই তার হাত থেকে লাইটটা নিচে পড়ে গেল আর তিনি বুকে হাত দিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়লেন। আমি কী করবো, কিছুই বুঝতে পারলাম না। ভীষণ ভয় লেগে গেল এবার। লোকটার কী হলো!

আমি তাকে সাহায্য করার জন্য গিয়ে ধরলাম।
“কী হয়েছে? কী হয়েছে আপনার?”
এবার তার মুখ দেখতে পেলাম, চুল দাড়ি পেকে একদম সাদা হয়ে গিয়েছে। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। সে বিড়বিড় করে আমাকে কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু তার জড়িয়ে যাওয়া শব্দগুলোর একটাও আমি বুঝতে পারলাম না।
“কিছু বলছেন?”
আমি তার মুখের কাছে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলাম। দু’টো শব্দ বুঝতে পারলাম অনেক কষ্ট করে,
“তাদেরকে, বা..বা..বাঁচাও।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কাদের?”
লোকটা হাত দিয়ে সামনে ইশারা করলো। তার বাড়ানো হাত বরাবর তাকাতেই দেখতে পেলাম একটা ফুটবলের মতো দেখতে তামার বল মাটিতে পড়ে আছে। হয়তো এটা লোকটার হাতেই ছিল। এগিয়ে গিয়ে ওটা দেখার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আঙুলে একটা বাটনে চাপ লাগার স্পর্শ পেলাম। হয়তো ভুলে কোনো বাটনে চাপ দিয়ে ফেলেছি। আর সাথে সাথেই আমার চারদিক উজ্জ্বল সাদা আলোয় ভরে গেল। তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম আমি।
***
অন্ধকার কেটে যাওয়ার সাথে সাথেই সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আস্তে আস্তে আলোটা চোখে সয়ে যাওয়ার পর আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা বিশাল সবুজ মাঠে। দূরে বিশাল একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে, কিন্তু পরমুহুর্তেই চিনতে পেরে চমকে গেলাম। কারণ ওটা পাহাড় না, আগ্নেয়গিরি! বেশ উঁচু। চূড়াটা ছাতার মতো মেঘমালা দিয়ে ঢাকা।

আমি আমার হাতের তামার বলটার দিকে তাকালাম। বলটা ফুটবলের মতোই। একপাশে একটা বাটন তীর চিহ্ন দিয়ে কিছু সাল নির্দেশ করছে। এখন যে সালটার দিকে তীর চিহ্ন মুখ করে আছে, সেটা হলো ১৯৭১!

এক মূহুর্তের জন্য মাথা এলোমেলো হয়ে গেল! কীভাবে কী সম্ভব বুঝতে পারছি না। প্রবির মিত্র লোকটা সায়েন্টিস্ট ছিল বলে শুনেছি। আর এই জিনিসটার বাটনে চাপ দেওয়ার পরই আমি এখানে এসে পড়েছি। তার মানে এটা কি একটা টাইম মেশিন?

পর মূহুর্তেই সামনের আগ্নেয়গিরির দিকে তাকিয়ে উড়িয়ে দিলাম সেই সম্ভাবনা। আমাদের দেশে কোনো আগ্নেয়গিরি নেই। কিন্তু তাহলে কি অন্য কোনো দেশে এসে পড়েছি? এটা কি সম্ভব? প্রমাণ তো অবশ্য চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
আমি মাঠটা পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর বাড়িঘর দেখতে পেলাম। অদ্ভুত সুন্দর সব বাড়িঘর। ঠিক ছবির মতো। কারও বাড়ি চারকোনা, কারো গোল। সবগুলো সবুজ ঘাস দিয়ে বেষ্টিত।
আমার বয়সি একটা ছেলেকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকলাম,
“এই শোনো। এই।”
ছেলেটা আমার দিকে দু’ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে এগিয়ে এসে আমাকে অবাক করে দিয়ে বাংলাতেই বললো,
“তুমি কে? তোমাকে তো আগে দেখিনি এখানে।”
“এটা কোন জায়গা?”
ছেলেটা চোখ সরু করে তাকিয়ে বলল,
“নিহির নগর।”
নিহির নগর!
“মানে কোন দেশ?”
“দেশ! দেশ মানে কী?”
আমি অবাক হলাম।
“তুমি জানো না?”
“নাহ তো।”
“তোমাদের নিহির নগর এর মতো আরও কোনো নগর আছে?”
“থাকতে পারে, আমরা জানি না। কেউ কোনো দিন খুঁজে পায়নি।”
“ওহ।”
আমি ভেবেছিলাম অন্য কোনো দেশে এসে পড়েছি। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, সেটা বের করা সম্ভব না।
“এটা কত সাল?”
“১৯৭১”
“তুমি কে?
“আমি ম্রিনয়। তুমি?
“আমি রিমন।”
“রিমন তুমি কোথা থেকে এসেছো?” এবার জিজ্ঞেস করলো ছেলেটি।
“বললে বিশ্বাস করবে না।”
“আগে বলেই দেখ।”
আমি বলতে থাকলাম। আর সে চোখ বড়ো বড়ো করে শুনতে থাকলো।
*****
ম্রিয়ন আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে গিয়ে আর তার দুই বন্ধুকে ডাকলো। একজনের নাম মাহান আরেকজনের নাম লীনা।
“তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি অন্য কোথাও থাকো, এই যন্ত্রটার মাধ্যমে এখানে চলে এসেছো?”
বলল লীনা।
আমি বলটার দিকে তাকিয়ে আছি। বলটার সালগুলোর ডান দিকে আরেকটা তীর চিহ্ন আছে। সেটা বাম দিকে মুখ করে আছে।
“হ্যাঁ।” এমনই হয়েছে।
“দেখি, আমাকে বলটা দাও তো।” মাহান টেনে নিলো।
“কিছু চাপ দিও না।” আমি সতর্ক করলাম।
মাহান কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখে তারপর বলল,
“আমার মনে হয় এই যন্ত্রটা একটা দরজার মতো।”
“যেমন?”
“এই যে দুটো তীর চিহ্ন দেওয়া বাটন দেখতে পাচ্ছো। এ দুটোর মাধ্যমে সম্ভবত দুটো দুনিয়ায় যাওয়া যায়। সালটা ওই দুনিয়ার সাল নির্দেশ করে।”
আমি ভাবতে থাকলাম, দুটো দুনিয়া না বলে যদি দুটি ডাইমেনশন ধরি তাহলে মনে হয় খুবই পসিবল। প্রবির মিত্র হয়তো দুটি ডাইমেনশনে আসা-যাওয়ার যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে।
“তাহলে অন্য কোনো এক বাটনে চাপ দিলে আবার চলে যাওয়া যাবে?” বলে লীনা।
“তাইতো মনে হচ্ছে।” উত্তর দিলো মাহান।
“ঠিক আছে৷ সমস্যা সমাধান। এখন তুমি কিছুদিন থাকো আমাদের সাথে। এরপরে চলে যেও।” হাসিমুখে বলে লীনা।
“না, না, আমার এখনি যেতে হবে। বাবা আমাকে খুঁজে না পেলে চিন্তিত হয়ে যাবেন।”
“কালকে যেও। কাল আমরা নিহিরে যাবো। তুমিও আমাদের সাথে যাবে। এরপরে এসে বিদায়। এই সুযোগে আমাদের নগর আর নিহির আগ্নেয়গিরি ও দেখে ফেললে।”
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হলাম। বিষয়টা রোমাঞ্চকর। আমি অন্য এক ডাইমেনশনে এসে পড়েছি, ভাবা যায়! প্রবির মিত্র আলাদা ডাইমেনশন আবিস্কার করে ফেলেছে!

বিকেলে আমি নিহির নগর ঘুরে বেড়ালাম। নগরটা মোটামুটি বড়। হাজার দশেক মানুষ থাকে। একদম শান্ত, সুন্দর একটা নগর। সবাই খুবই ভালো আর মিশুক। এমনটা শুধু গল্পতেই সম্ভব। দূরে যে আগ্নেয়গিরিটা দেখা যাচ্ছে, সেটার নাম নিহির আগ্নেয়গিরি। এই নামেই নগরটার নাম।
আমার ঘটনাহীন জীবনে কী রোমাঞ্চকর বিষয় ঘটে যাচ্ছে, প্রায় অবিশ্বাস নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

সকাল সকাল উঠে আমরা চারজন নিহিরের পথ ধরলাম। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে টানা বারো ঘন্টা উঁচু পথে হাঁটার পর আমরা চূড়ায় পৌঁছাই। চূড়া থেকে দেখতে সব অসম্ভব সুন্দর লাগছে। নদীর পানির মতো মেঘ প্রবাহিত হচ্ছে। মাথার ওপরেও ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে মেঘমালা। দূরে ছোট্ট ছবির মতো সুন্দর নিহির গ্রাম দেখা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সবকিছু অসাধারণ, আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত।

আমরা রাতটা পাহাড়ের ওপরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। আঁধার ঘনিয়ে আসছে। ওপর থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম সবাই। পশ্চিম আকাশের ক্যানভাস গোলাপি রঙে রাঙিয়ে বিদায় নিলো সূর্য।

রাত গভীর হচ্ছে। আমরা মাটিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মেঘ কিছুটা কমেছে ওপরে। মিটি মিটি তারা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ অবাক হলাম আমি, একটা তারা ছুটে আসছে এদিকে!
“এই দেখ, উপরে।”
সবাই আমার আঙুল বরাবর তাকালো। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে সবাই দেখতে পেল জিনিসটাকে। তারার মতো লাগলেও তারা নয় জিনিসটা। আকাশের অনেক কাছে আর দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে। আমি বুঝতে পারলাম, কোনো উলকা ছুটে আসছে এদিকে। সাথে সাথেই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম সবাই।
চারজনেরই মুখের কথা হারিয়ে গিয়েছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি উল্কাপিণ্ডকে, তীব্র গতিতে ছুটে আসতে গিয়ে আগুন ধরে গিয়েছে গায়ে। নিচে এসে আমাদের একটু দূরেই আঘাত হানলো জিনিসটা। ঠিক নিহির নগরের ওপরে। প্রচন্ড আলোর ঝলকানিতে, ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলো সবকিছু।
লীনা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। বাকি দু’জনও কথা হারিয়ে বোবা হয়ে গেছে।
আমরা আর দেরি না করে রওনা হলাম। সকালের আলো ফোটার সময় পৌঁছে গেলাম নিহির নগরে। চারদিকে ধুলোর স্তরে ঢেকে আছে। আশে পাশে কোনো সাড়াশব্দও নেই। আমি বুঝে গেলাম কেউ বেঁচে নেই।
অনেকক্ষন খোঁজার পর কান্নায় ভেঙে পড়লো লীনা। মাহান আর ম্রিয়নও কাঁদতে থাকলো তার সাথে। তাদের নগরের একটা মানুষও বেঁচে নেই। এই অচেনা মানুষগুলোর জন্য আমার গলায়ও কষ্টের একটা দলা আটকে আসলো।

আমি বলটার দিকে তাকালাম। সালটা দেখলাম একবার। আর সাথে সাথেই প্রবির মিত্রর শেষ কথাটা স্মরণ হয়, ‘তাদেরকে বাঁচাও।’ সাথে সাথেই আমার হাত পায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আমাকে এটার কথাই বলেছিল! হায়, আমি বুঝতে পারিনি! তখনই আমার মাথায় বুদ্ধিটা খেলে গেল। আমি ভাবলাম আমি আমার ডাইমেনশনে ফিরে গিয়ে আবার ফিরে আসবো আর এবার সবাইকে বাঁচাবো।
“শোনো তোমরা। আমি একটা উপায় পেয়েছি। আমি সবাইকে বাঁচাবো।”
“কীভাবে?” ম্রিয়ন আমার দিকে তাকালো। তার চোখ ভিজে অশ্রু পড়ছে। তাকিয়েছে বাকি দুজনও।
“এই যে এই যন্ত্রটা দিয়ে। আমি আমার ডাইমেনশনে গিয়ে আবার গতকাল ফিরে আসবো। আর এসে সবাইকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাবো।”
“এটা সম্ভব?” বলল লীনা।
“হ্যাঁ বিশ্বাস রাখো আমার উপর। আমি আসবোই।”
“আমরা তোমার অপেক্ষা করবো।” বলল মাহান।
আমি শেষবারের মতো তিনজনকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলাম। তারপর একটু দূরে গিয়ে ডান দিকের বাটনটা চাপ দিলাম। আমার বিশ্বাস এই বাটনটাই ফিরে যাবার উপায়। সাথে সাথেই তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল।

চোখ মেলতেই অন্ধকারে একটা মেঠো রাস্তায় নিজেকে আবিস্কার করলাম। দেখলাম একদল ছায়া আমার দিকে ছুটে আসছে। আমার কাছে আসতেই বুঝতে পারলাম আসলে মানুষগুলো আমার দিকে নয়, এই পথ ধরে ছুটে পালাচ্ছে। একজনের সাথে ধাক্কা লেগে আমার হাতের বলটা ছিটকে পড়ে গেল।
“আল্লাহগো বাঁচাও, মিলিটারি আইতেছে।” একজন মহিলার বিলাপ শুনতে পেলাম।
তাদের মাঝে একটা বাচ্চাও কেঁদে উঠলো। সবাই আমাকে ঠেলে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি দাঁড়াতে পারছি না। বলটা কোনদিকে গিয়েছে বুঝতে পারলাম না।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে তাদের সাথে আবিস্কার করলাম। কিছু না বুঝে আমিও মিলিটারির ভয়ে তাদের সাথে পালাচ্ছি। অনেক দূরে গিয়ে সবাই যখন একটা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছালাম তখন একজনকে জিজ্ঞেস করলাম,
“ভাই মিলিটারি কেন আসছে?”
“আসবো না? দ্যাশে যুদ্ধ লাগছে, মিলিটারি যারে পাইতেছে তারেই মারতেছে। আমগো গেরাম জ্বালায়া দিছে।”
“মিলিটারি মানি? পাকিস্তানি মিলিটারি?”
“তয় কী ইন্ডিয়ার মিলিটারি? কই থাকেন মিয়া?”
এই কথা শুনে আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। পাকিস্তানি মিলিটারি মানে? আমি ১৯৭১ সালে! শিট! এখন মনে পড়লো আমার। আমি এই ডাইমেনশনে আসার আগে সালটা বদলাইনি। এখন কী হবে আমার! দু’পা মেলে মাটিতে বসে পড়লাম।
***
রাত কেটে গেলেই আমি আগের জায়গায় ফিরে গেলাম। যে করেই হোক বলটা খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু একজন মানুষের ভাগ্যে যখন বিপদ আসে, চারদিক থেকেই আসে। আমি সারাটা দিন খুঁজেও বলটা পেলাম না। এদিকে সারা রাত, সারাদিন না খাওয়ার কারণে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। অনেক ভেবে একটা উপায়ই পেলাম। হিমেলদের গ্রামে প্রবির মিত্রকে খুঁজে বের করা। একমাত্র উনিই পারবে এই অবস্থায় আমাকে সাহায্য করতে।
আমি মানুষকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, হিমেলদের গ্রামেই আছি। বহু খুঁজে খুঁজে প্রবির মিত্রর বাড়ি পেলাম। গিয়ে দেখলাম তার বাড়ি তালা দেওয়া। হিন্দু হবার কারণে পালিয়ে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছে।
এবার আর আমি সহ্য করতে পারলাম না। ২০২০ সালে আমার বাবা-মা আমার অপেক্ষায় আছে। আর ওদিকে নিহির নগরের তিনজন অপেক্ষা করে আছে যে, আমি তাদের নগরের দশ হাজার মানুষকে বাঁচাবো! অঝোরে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকলো। হায়! সৃষ্টিকর্তা আমাকে কোন পরীক্ষায় ফেললে?এখন আমি কী করবো!
ঘন্টা দুই পড়ে থাকার পর উঠে দাঁড়ালাম। আমি একটা পথ খুঁজে বের করবোই যেভাবে পারি। প্রবির মিত্রর বাড়ির তালা ভেঙে তার বাড়িতে ঢুকে গেলাম। তার বাড়ির একটা রুমে ঢুকে আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি দুনিয়ার যাবতীয় বিজ্ঞানের বই আর যন্ত্রপাতি দিয়ে ভরা জায়গাটা। এরই মধ্যে একটা কাগজে একটা নকশা দেখতে পাই। সেই নকশাটা অন্য কিছুর না। সেই বলটার! অসম্পূর্ন। আমার মনে আশা জাগতে শুরু করলো। আমি পদার্থ বিদ্যার অনেক কিছুই জানি। প্রয়োজন হলে আমি পাঁচ বছর ধরে পড়বো, আমার কাছে নকশা আছে। যন্ত্রপাতিও আছে। আমি সেই বলটা তৈরী করবো তারপর নিহিরনগরের মানুষদের বাঁচাবো, তারপর বাসায় বাবার কাছে ফিরবো।

এরপর কেটে গেল অনেক অনেক বছর। আমি জানিও না কতো বছর কেটেছে ঠিক। প্রবির মিত্র আর ফিরে আসেননি। তিনি অনেক ধনী ছিলেন। আমার মতো একা মানুষের এই বিরাট বাড়িতে থাকা খাওয়ার অভাব হয়নি। কেউ খুঁজতে এলে বলেছি আমি তার আত্মীয়। তিনি ফিরে না আসার আগ পর্যন্ত আমি এখানে থাকবো। তার বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় টাকা থেকে শুরু করে যা কিছু পেয়েছি সব বিক্রি করে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছি। সারাদিন পড়াশোনা করেছি, যন্ত্রটা বানানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি সফল হতে পারিনি। তবুও আমি থামিনি। আমার জন্য অপেক্ষা করছে অনেকগুলো মানুষ। আমাকে যে পারতেই হবে।

আরও অনেক বছর কেটে গিয়েছে। হঠাৎ একদিন দেখতে পেলাম, যন্ত্রটার সবকিছু অবশেষে তৈরি। আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। অবশেষে আমি সফল হয়েছি!

এখন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হবে। ঘরের ভেতর করাটা ঠিক হবে না। পেছনের দরজা দিয়ে ধীর পায়ে বের হলাম। বাইরে রাত, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শরীর আর আগের মতো সাহায্য করছে না। হাঁটাচলা করতেও কষ্ট হয় এখন।
ফাঁকা জায়গায় গিয়ে যখন বাটনটা চাপ দিবো ঠিক তখনই দশহাত দূরে একটা শব্দ হলো। সামনে আলো ফেলতেই একটা ছেলেকে দেখতে পেলাম। আর সাথে সাথে চমকে উঠলাম। ছেলেটি আর কেউ না, ৫০ বছর আগের আমি!
“রিমন” নামটা উচ্চারণ করলাম শুধু আর সাথে সাথেই বুকের বাম পাশে দুনিয়ার সবচেয়ে যন্ত্রনাদায়ক ব্যাথা অনুভব করলাম। আমার হাত থেকে আলোটা পড়ে গেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম আমি।

ছেলেটা এসে আমাকে ধরার চেষ্টা করলো, তাকে বলার চেষ্টা করলাম কিছু কথা। কিন্তু কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, তাই বেশি শব্দ বের হলো না মুখ দিয়ে।
“তাদেরকে বা,বা বাঁচাও।” এটুকু বলেই বলটার দিকে দেখাই।
রিমন সামনে এগিয়ে বলটা ধরলো আর সাথে সাথে তার চারিদিকে তীব্র আলোর ঝলকানি দেখতে পেলাম। আর মুহূর্তেই আমার সেই ঘটনা মনে পড়ে গেল। সবকিছুর শুরু এখান থেকেই… এই মুহূর্ত থেকেই! আমি অনুভব করলাম আমার প্রাণ আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি আকাশের তারাগুলোর দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকলাম।
আমি ব্যর্থ হয়েছি।


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply