জালাল উদ্দিন রুমি

শুষ্ক মরুময় জীবনে প্রাণের সঞ্চারকারী রেহনুমা -মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী(রহঃ)

জীবনী, প্রবন্ধ
লেখাটি শেয়ার করুন

তানজিনা আক্তার,

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

“আমি জেনেছি প্রত্যেক নশ্বর সৃষ্টিই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, তবে এ-ও জেনেছি যে, কেবল গুটি কয়েকই জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করবে ”

প্রেম ও প্রজ্ঞার বাহক নামে খ্যাত মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী সম্পর্কে জানেন না কিংবা তাঁর প্রেমের মহাসমুদ্র থেকে নেহায়েত অত্যাল্প পরিমাণ বারি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করেননি এমন সাহিত্য প্রেমী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া জুড়ে বিরাজ করছিল বিশৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনৈতিক ও যুদ্ধ -সংঘাতের পরিস্থিতি। খ্রিস্টানদের সামরিক অভিযান ‘ক্রুসেড’ ইউরোপের পশ্চিম অংশ থেকে আনাতোলিয়া উপদ্বীপ পেরিয়ে এই অঞ্চলে আছড়ে পড়ছিল এবং পূর্ব দিক থেকে অপ্রতিরোধ্য মোঙ্গল বাহিনি ধেয়ে আসত এই অঞ্চলের ওপর হামলা চালাতে। দীপ্তিমান অতীন্দ্রিয় চেতনায় জাগ্রত হওয়ারও সময় ছিল তখন। মানবাত্মার মাঝে ঈশ্বরের সান্নিধ্য সৃষ্টিকারী বিশ্বের মহান প্রেমিকদের আবির্ভাবও ঘটেছিল এই সময়ে। তার মধ্যে জালালুদ্দিন রুমী অন্যতম। এই কবি, আইনজীবী, ইসলামী পণ্ডিত, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং সুফি অতীন্দ্রিয়বাদী মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী ১২০৭ সালে আফগানিস্তানের বালখে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর বাবা বাহাউদ্দীন একজন সুপরিচিত আলেম। সেই সাথে তিনি বালখের একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞও ছিলেন। রুমীর অনুসারীদের কাছে তিনি ”সুলতান-আল-উলামা” নামেই  পরিচিত।

বাবার হাত ধরেই শৈশবে ধর্মীয় জ্ঞানের পথে পা বাড়ান রুমী। তাঁর চিন্তা -চেতনার মূল স্রোতের শুরু সেখান থেকেই। পরিচিত আলেম সমাজের সাথে চলাফেরা, পড়াশোনার পাশাপাশি বহু মানুষের সাথে আলাপ -আলোচনাও তাঁর চিন্তার গভীরতা জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।  অপরদিকে মাওলানা রুমির মা মুইমিনা খাতুনের পরিবার ছিল সে সময়ে সম্মানিত।



জালালুদ্দিন রুমির শৈশবের ঘটনা খুব একটা জানা যায় না, তবে বেশ কিছু ঘটনায় এটা স্পষ্ট হয় যে তিনি শৈশবে থেকেই আলাদা। শৈশবেই তিনি ছিলেন নিজের আলোয় আলোকিত আর বিকশিত। রুমীর তরুণ বয়সেই তাঁর পরিবারকে বালখ থেকে পালাতে হয় চেঙ্গিস খানের হামলার পূর্ব মুহূর্তে। রুমী ও তাঁর পরিবার এবং তাঁর বাবার কিছু অনুসারী নিয়ে প্রথমে দামেস্ক এবং সেখান থেকে নিশাপুরে যান। সেসময় রুমী চলার পথে অনেকের সান্নিধ্যে আসেন, যা তাঁর জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তার মধ্যে একজন হলেন কবি ও শিক্ষক ফরিদউদ্দীন আত্তার। তিনি কিশোর রুমীর মধ্যে বিরাট আধ্যাত্মিক চেতনার অস্তিত্ব দেখতে পান। বাহাউদ্দীনের একটু পিছনে রুমীকে দেখেই নাকি তিনি বলেছিলেন –

“একটি সাগর আসছে, তাকে অনুসরণ করছে একটি মহাসাগর “।

নিজের এই অন্তর্দৃষ্টিকে সম্মান করতেই তিনি রুমীকে একটি গ্রন্থ উপহার দেন “ইলাহিনামা” (আল্লাহর গ্রন্থ)

 

১২২৮ সালের দিকে আনতোলিয়ার শাসক আলাউদ্দিন কায়কোবাদ রুমীর বাবা বাহাউদ্দীন এবং তার পরিবারকে আনাতোলিয়ার  কোনিয়ায় নিমন্ত্রণ করে আনেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুরোধ করেন। যার ফলশ্রুতিতে রুমীর পুরো পরিবার সেখানে থেকে যায়। তাঁর বাবা সেখানের একটি মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিছুদিন পর তিনি মারা গেলে মাত্র ২৫ বছর বয়সে রুমী সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে সবার কাছে মাওলানা হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা ছিল বলেই তিনি সেসময় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হন।

মাওলানা রুমীর ভেতর গভীর চিন্তা -চেতনার জন্ম আসলে এমনি এমনি হয়নি। প্রচুর পড়াশোনা আর জগত জানার চেষ্টাই তাঁকে নিয়ে গেছে জ্ঞানের গভীরতম শাখায়। জ্ঞান আমাদেরকে অহম থেকে মুক্ত করে প্রকৃত “আমিকে” ধারণ করার সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তাই রুমী বলেন-

“যে জ্ঞান তোমাকে তোমার অহম থেকে মুক্ত করতে পারে না ;সে জ্ঞান অপেক্ষা অজ্ঞতা ঢের শ্রেয় “।

রুমীর বাবার এক ছাত্রের কাছে তিনি টানা নয় বছর পড়াশোনা করেন ইসলামী শরিয়াহ আর সুফিবাদ নিয়ে। তাঁর লেখায় জীবন নিয়ে যেসব গভীর ভাবনা আমাদের হৃদয় নাড়িয়ে দেয়, সে অবস্থায় যেতে আসলে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে জ্ঞানের এক বিশাল পথ। সেই সাথে নিজের ভেতর নানা রকম জ্ঞানগত পরিশ্রম, কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজই হলো আলো বিলানো। তাই হয়তো মাওলানা রুমী বলতেন –

” মোমবাতি হওয়া সহজ কাজ নয়, আলো দেয়ার আগে নিজেকে পুড়তে হয় “।

১২৪৪ সালে রুমীর সাথে শামস- তাবরিজির সাক্ষাত ঘটে। এ সাক্ষাত রুমীর জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ঘটনা। শামস ছিলেন প্রচন্ড এক খোদা ভক্ত মানুষ। মানুষ তাকে ” পাখি” বলে ডাকতো, কারণ তিনি এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না, দ্রুত জায়গা পরিবর্তন করতেন। একটি কালো রঙের আলখিল্লা পরিধান করতেন তিনি। সুফি কাহিনি অনুসারে তিনি একজন বন্ধুর সন্ধানে ঘুরছিলেন। শামস তাঁর সময় অতিবাহিত করতেন ভাব বিহ্বল অবস্থায়, আবার কখনো কারিগর হিসেবে কায়িক পরিশ্রম করে। শামসের চিরন্তন একটি প্রশ্ন ছিল, “আমি কি কোন বন্ধু পাবো না “?

শেষপর্যন্ত একটি কন্ঠ বলল,”বিনিময়ে তুমি কী দিবে “?
” আমার মাথা”।
“তোমার বন্ধু হবেন কোনিয়ার জালালুদ্দিন “।

রুমী ও শামস এর মধ্যে প্রথম সাক্ষাতের বিভিন্ন বিবরণ রয়েছে। একটি বিবরণ অনুসারে, কোনিয়ার এক চত্বরে ফোয়ারার পাশে বসে রুমী তাঁর মুরিদদের তাঁর পিতার মা’রিফ পড়ে শুনচ্ছিলেন। শামস ভিড় ঠেলে সেখানে প্রবেশ করে বইটি এবং অন্য বইগুলো পানিতে ফেলে দিলেন।

” আপনি কে, আর এটা কী করছেন “?রুমী প্রশ্ন করেন।
শামস বলেন -” তুমি যা পড়ছিলে তা আর পড়া উচিত নয়”।
রুমী পানির তলদেশে বইগুলোর দিকে ফিরলেন,
“আমরা এগুলো তুলে নিতে পারি। আগে যেমন শুকনা ছিল, এখনও তেমনই আছে” শামস বললেন।

তিনি এটি রুমীকে দেখালেন, ঝকঝকে শুকনো।
এই পরিত্যাগের মধ্য দিয়েই রুমীর গভীর জীবনের সূচনা। তিনি বলেন, “আগে আমি আল্লাহ বলতে যা ভেবেছি,একজন মানুষের মাঝে আমি তার সাক্ষাৎ লাভ করলাম “।
তাইতো শামস তাবরিজ বলেন-
” শেখার জন্য তুমি পড়াশোনা করো, কিন্তু বুঝতে হলে তোমার প্রয়োজন প্রেম “।

ধর্মীয় গুরু হিসেবে রুমীর জীবনের অবসান ঘটলো। তিনি এবং শামস একত্রে মাসের পর মাস নিভৃতে সময় কাটাতে শুরু করলেন। তার সাথে আলাপ- আলোচনা য় রুমী যেন অন্য এক জগতের সন্ধান পান; যেখানে দুনিয়ার অনেক বড় বিষয়গুলো ক্ষুদ্র হতে থাকে।

শামস- তাবরিজির সাথে দেখা হওয়ার আগেও রুমী অনেক বড় একজন ইসলামী ধর্মতত্ত্ববীদ ছিলেন কিন্তু শাসমের সান্নিধ্যে আসার পর তাঁকে ইশক্বের (খোদা প্রেমের) আগুনে পুড়াতে থাকে তখনই তাঁর মধ্যে রুপান্তর ঘটে এবং তিনি সুফি সাধক হয়ে উঠেন।

সত্যের সঙ্গে যখন প্রেমের মিশ্রণ ঘটে তখনই সে প্রেম আমাদের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তুলে। নিজের মধ্যে রুপান্তর ঘটায়। নিজের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে শিখায়। তাইতো শাসম- তাবরিজ বলেন-

“শোন হে রুমী!

ঈমান হচ্ছে নিজের থেকে নিজেকে পৃথক করে তোলা “।



বলা হয়া থাকে ঐশী রুহ যেমন মারিয়ামের মধ্যে এসে ঈসার জন্ম দিয়েছে ঠিক তেমন তেমন ভাবে শামস-তাবরিজ এসে রুমীর জন্ম দিয়েছে। রুমী, রুমী হয়ে উঠেছেন।

তাইতো রুমী বলেন –
“খোদাকে পাওয়ার অনেক পথই রয়েছে। আমি প্রেমকে আমার ধর্ম হিসেবে নিয়েছি “।
“শুধু প্রেমই পারে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করতে”।

 

রুমীর সাথে তাবরিজির জ্ঞানের সম্পর্ক মানুষ মেনে নিতে চায়নি; এক তো তাবরিজি সমাজ থেকে পুরোপুরি আলাদা, সমাজের অধিকাংশ নিয়ম-কানুনকে তিনি সবসময়ই একরকম প্রত্যাখানই করেন। তার উপর রুমীর পরিবার সমাজে সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। যদিও তাবরিজি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত এক বাদশাহ তবে অধিকাংশ মানুষ সেই হিসেবে কোনদিন তাঁকে বিচার করতে চায়নি। তাদের কাছে তাবরিজ এক নিঃস্ব মানুষ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।

সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই এগিযে যান রুমী। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, ঠিক তখন রুমী করে বসলেন অদ্ভুত কাজ;তিনি তাঁর সৎ মেয়ে কিমিয়ার সাথে তাবরিজির বিয়ে দিয়ে দেন। এতে করে সেই সমাজে তাবরিজির একটা শিকড় জন্মে, যা প্রত্যাখান করে কেউ আর তাঁকে ছুঁড়ে ফেলার সাহস করবে না।

 

 

তবে তাবরিজির সাথে রুমীর জ্ঞানসাধনা বেশি দিন টেকেনি। তাঁর সাথে কিমিয়ার বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই কিমিয়া মারা যায়।
কিছু লোক শামসকে দামেস্কে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু রুমী তাকে অাবার ফিরিয়ে অানেন।

শেষ পর্যন্ত এটা মনে করা হয় যে,রুমীর মুরিদদের কেউ কেউ, এবং সম্ভবত রুমীর পুত্র অালাউদ্দিনও তাদের মধ্যে ছিল। তারা শামসকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে। সে যা-ই হোক,তাবরিজ যেন হয়ে উঠেন বনের সেই পাখিটি, যে কিনা আবার হারিয়ে যায়৷

বন্ধুকে হারানোর বেদনায় রুমী তাঁর বাগানে একটি খুঁটিকে প্রদক্ষিণ করতে করতে আবৃতি করতে থাকেন,  যে কবিতাগুলো স্বর্গীয় মিলনের সন্ধানে উচ্চারিত সেরা কবিতা বলে আমরা বিবেচনা করতে পারি। তাঁর এই প্রক্রিয়াকে নিশ্চিতভাবেই দরবেশদের বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে ( Whirling Darwish Dance) ধ্যানের পদ্ধতির উদ্ভাবনও বলা যায়।



রুমীর পরমানন্দ সূচিত হয়েছিল বিষাদের  মধ্য  দিয়ে। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই স্বতঃস্ফূর্ত ও বিনা প্রস্তুতিতে সৃষ্টি। তাঁর “দিওয়ান-ই-শামস-ই -তাবরিজি”

যেন তাঁদের বন্ধুত্বের গভীর অনুভূতির অনুরণন। তাঁদের বন্ধুত্ব লিঙ্গ ও বয়সের বাঁধা, ভাবাবেগ এবং গুরু শিষ্যের সম্পর্কের ধারণা ছাড়িয়ে কবিতার মাঝে বিস্তৃত হয়েছে। তাঁর কবিতা “সূর্যালোক” ও”মানুষের যেকোন কথাকে ” অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উন্মুক্ত ছিল।
তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল ভিন্ন এক জগত, যেকানে তাঁরা বাস করতেন।” প্রেম দ্বারা যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে তাঁরা বরং প্রেমের জীবন্ত জগত ছিলেন “।

 

তাবরিজের হারিয়ে যাওয়া রুমীকে প্রচণ্ড ব্যথিত করে। তাবরিজির হারিয়ে যাওয়া অথবা মৃত্যুর অনেকদিন পর অবধি রুমী তাঁকে ফিরে পাওয়ার আশায় বিভোর ছিলেন। তারপর যখন বুঝতে পারলেন জ্ঞানের সাগরের সাথে তাঁর আর দেখা হচ্ছে না, তখন তাবরিজকে খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার বিপরীত দিকে গিয়ে তিনি লিখেন –

” আমি কেন তাঁকে খুঁজবো?

সে আর আমি তো একই

তাঁর অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে

আমি নিজেকেই খুঁজছি”।

 

শামস তাবরিজকে নিজের আলোয় অমর করতে তাঁর গ্রন্থ “দিওয়ান-ই -শামস -ই -তাবরিজি ” তে একে একে যোগ করতে থাকেন গজল, কবিতা যা আধ্যাত্মিকতার এক নতুন পাঠ হিসেবে সবার কাছে প্রকাশিত হয়।

লোকমুখে তখন প্রচলিত হয় যে, তাবরিজির মৃত্যুর পর মাওলানা রুমীই তাবরিজ হয়ে ওঠেন। কারণ ততদিনে রুমীর লেখা একটি লাইন মানুষের ভেতর নাড়িয়ে দিতে থাকে, ক্ষমতাশীল পৃথিবীকে তুচ্ছ করে দেয়ার মতো সব লিখা লিখতে থাকেন তিনি।

নতুন রুমী সবার কাছে আধ্যাত্মিক গুরু এবং সুফি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। হৃদয়ের আলো -অন্ধকারের কথা, সুফিবাদের কথা এমনভাবে বলতে থাকেন, যে দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয় কেউ দেখেনি। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, মানুষের হারিয়ে যাওয়া, সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের সম্পর্কের ভাবনা নিয়ে হাজির হন এক অন্য রুমী।

জীবনে এগিয়ে যাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া, দুনিয়ায় টিকে থাকার যুদ্ধ এসব বিষয়কে রুমী যেন পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসেন। রুমী মানুষের নিজস্বতার উপর জোর দিলেন, যে আলো পৃথিবীর থেকেও শক্তিশালী বলে জানান –



“তুমি কি এখনও এ ব্যাপারে অবগত নও?

এ তো তোমারই আলো, যা দিয়ে সমগ্র জগত প্রজ্বলিত হয়”!

রুমী তাঁর কবিতায় নিজের অন্তরের দিকে যাত্রা  করার আহ্বান করেছে- তিনি বলেন,

“হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি; অন্তর্লোকের যাত্রা কবে আরম্ভ করবে”।

আরো বলেন-

” কেন তুমি প্রত্যেক দরজায় কড়া নাড়ছো!

যাও নিজের হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ো।

তিনি দগ্ধ হৃদয় সম্পর্কে বলেন –

 

” তোমার দগ্ধ হৃদয় এমন একটি জায়গা যা তোমাকে আলোর পথে হাঁটতে শিখাবে সত্যের সন্ধান পেতে”।

সুফিরা ইন্দ্রিয়লদ্ধ বিশ্বের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ  করার আগে নিজের অভ্যন্তরস্থ বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে বলেন। এতদুভয় জগতের মধ্যে সমন্ধ স্থাপনের মাধ্যমে স্রষ্টায় একাঙ্গীভূত হওয়াতেই সুফিদের স্বার্থকতা।

কুরআনুল কারীমও ঠিক এই নির্দেশই দেয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন –

“আমি তাদেরকে আমার আয়াতসমূহ (নিদর্নসমূহ)

দেখাবো দিগন্তে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে; যতোক্ষণ না তাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয় যে, তিনিই মহাসত্য “।

 

রুমীও তদনুরুপ বলেছেন –

” যা-ই তুমি বহির্জগতে দেখো তা তোমার মধ্যেই বিদ্যমান”।

তিনি অন্যত্র বলেন –

” তুমি নিজেকে মহাসমুদ্রের একটি ফোঁটা ভেবো না, বরঞ্চ তুমি এমন একটি ফোঁটা যা মহাসমুদ্রকে ধারণ করে”।

তেমনিভাবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)  বলেন-

” আত্মজ্ঞানী যে হয়েছে, স্রষ্টাকে সে চিনেছে “।

অর্থাৎ আত্মজ্ঞানই হলো স্রষ্টাকে চেনার উপায়।

 

শামস তাবরিজকে হারিয়ে রুমী অন্য এক রুমী হয়ে উঠার  পর তিনি জীবনের গভীর ভাবনা ভাবতে ভাবতে তাঁর দিন কাটতে থাকে। জীবনে আর গুরত্বপূর্ণ কেউ না আসলেও বন্ধু আবারও। যার নাম ছিল সালাউদ্দিন জাকুব। পেশায় তিনি একজন স্বর্ণকার ছিলেন। রুমী অবশ্য এই বন্ধুকেও হারান। যদিও ততদিনে তিনি সম্পর্কের বন্ধন থেকে নিজেকে অনেক উপরে নিয়ে গিয়েছিলেন।

রুমী তাঁর জীবনের শেষ বারো বছর ধরে একটি সুদীর্ঘ ধারাবাহিক কবিতা “মসনবী’ রচনা করেন।

চৌষট্টি হাজার লাইন বিশিষ্ট কবিতাটি ছয় খণ্ডে বিভক্ত। বিশ্ব সাহিত্যে এর সমতুল্য গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নেই। সুফিবাদের উপর রচিত এটি সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী রচনার মধ্যে একটি। এতে কুরআন ও আধ্যাত্মিক জীবন সম্পর্কিত রুমীর উপলব্ধির বর্ণনা রয়েছে। কীভাবে খোদার সাথে প্রেমের লক্ষে পৌঁছানো যায় তার শিক্ষা দেয়। ” মসনবী” কে ফার্সি ভাষার “কুরআন” বলে অভিহিত করা হয়।

রুমী তাঁর উক্তিগুলোকে তাঁর লিপিকার হুসাম চেলেবিকে লিখে রাখতে বলতেন তাঁরা যখন কোনিয়ায় ঘুরে বেড়াতেন। হুসাম ছিলেন শামস এর শিষ্য।



এই গ্রন্থের প্রথমেই তিনি লিখেন –

” বাঁশের বাশি যখন বাজে, তখন তোমরা মন দিয়ে শোন সে কী বলে

সে তাহার বিরহ বেদনায় অনুতপ্ত হইয়া ক্রন্দন করিতেছে”।

১২৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের সময় রুমী ইন্তেকাল করেন। বলা হয়ে থাকে যে রুমীর দাফনের সময় সকল প্রধান ধর্মের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা রুমী এবং তাঁর কবিতাকে  দেখেছেন তাদের নিজ নিজ বিশ্বাসকে সুদৃঢ় করার উপায় হিসেবে। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে তাঁর মৃত্যুবার্ষিক পালন করা হয় খোদার সাথে তাঁর মিলনের রাত হিসেবে।

 

” আমি সেই প্রেমিকের কাছে আমি

যে দুই পৃথিবীকে একটি হিসেবে দেখেছে

এবং সেই একটিকেই জেনেছে

প্রথম, শেষ, বাহির ও ভিতর বলে

ওটাই কেবল মানুষের নিঃশ্বাস “।

 

রুমীর মৃত্যুর পর  জর্জিয়ার রানী তাঁর সমাধিস্থল নির্মাণ করতে তহবিল প্রদান করেন, যার ফলে কোনিয়ায় তাঁর সমাধিস্থল নির্মাণ করা হয়। তাঁর বড় ছেলে সুলতান ওয়ালাদ বাবার অনুসারীদের নিয়ে মৌলভী সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, যারা বর্তমান তুরস্কে ঘূর্ণায়মান দরবেশ নামে পরিচিত। এখনও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে যায় রুমীর সমাধিস্থলে, যেখানে তাঁর দেখানো পথে মানুষ ঘুরছে সৃষ্টিকর্তার কাছে সঁপে দিতে।

আমরা রুমী, তাবরিজের প্রেমবাক্য যতোই আওড়াই না কেন,তার রসবোধ ভাষায় ব্যক্ত করা অসম্ভব। এজন্যই রুমী বলেন –

“নীরবতাই রবের ভাষা;বাকিসব দুর্বল অনুবাদ”।

মানুষের হৃদয়ে আলো জ্বালাতে যা লিখে গেছেন, তার সবই আধুনিক বিশ্বে খুবই আলোচিত।

প্রেম নিয়ে গভীর কবিতা রুমীর মতো করে পৃথিবীর আর কোন কবি লিখতে সক্ষম হয়নি।

রুমি বলেন —

“প্রেম আমার ধর্ম; আর প্রতিটি হৃদয়ই আমার মন্দির”।

তিনি আরো বলেন –

” আমরা প্রেমের জন্যে জন্মেছি ;প্রেমই আমাদের মা “।

রুমী শুধু মুসলিম বিশ্বে নয় পাশ্চাত্যেও খুব প্রভাব ফেলেছেন। তাঁর কবিতা পৃথিবীব্যাপি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রুমী হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বে বহুল পঠিত এবং জনপ্রিয় কবি এমনি আমেরিকায়ও।



মানুষ তার জীবনে খুব বেশি কিছু হলে একটি ইতিহাস হয়, মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি হয়েছেন এক জীবনব্যবস্থা, ভাবনার পরিপূর্ণতা, পথপ্রদর্শক। তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন বার বার, তবে পা দুটো তাঁর মাটিতেই ছিল। তিনি নিজের ভেতর জন্ম নেয়া আলোকে চিনতে পেরেছেন, সেই আলোয় আলোকিত করতে চেয়েছেন সারা পৃথিবীকে। শক্তিশালী সব চিন্তা- চেতনা দিয়ে হৃদয় আলোকিত করতেই যেন জন্মেছিলেন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি। এক আধ্যাত্মিক জীবনের খোঁজে তার কাছে তো যাওয়াই যায়।

রুমী বলেন-

” তোমার ক্ষুদ্র জগত থেকে বের হয়ে আসো এবং স্রষ্টার অসীম জগতে প্রবেশ করো। ”

” ভালো -মন্দের উর্ধে আছে এক জগৎ; আর সেটাই আমাদের মিলনস্থল।”


লেখাটি শেয়ার করুন

One thought on “শুষ্ক মরুময় জীবনে প্রাণের সঞ্চারকারী রেহনুমা -মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী(রহঃ)

Leave a Reply