শ্রাবণ ধরায়
আরমান হোসাইন অন্তর।।
ভরা অমাবস্যায় ঘোর অন্ধকারের মতন চোখদুটো মোর ভীত– গভীরে অনন্ত বর্ষার জমানো জল। কেবল মেঘেদের অপেক্ষা। পাগলা হাওয়ায় মেঘের ভেলা উড়ে আসে মুহূর্তে! চমকিত আমি অগোছালো মনে দুঃখ উড়াই দীর্ঘশ্বাসে।
শ্রাবণ পূর্ণিমায় নদীজল যেমন ফুলেফেঁপে ওঠে তেমনি অক্ষিকোটরে রক্ষিত বাষ্পজল গলতে মরিয়া হয়। সে জলে ভেসে চলে জীবন ও জগৎ। চাঁদের আলোয় আমার ব্যথারা কেমন রো–রো ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়! এ যেন ভরা তারার আলোয় তুমুল আনন্দে খোলা আকাশতলে খেলায় মত্ত অবহেলিত শিশু। কোথায় সে শিশুর রাত-দিন, কোথায় তার আদর-স্নেহ, কোথায় বা তার ঘর! এতসব তোয়াক্কা না করে অবুঝ শিশু কেবল ক্ষুধা ভুলতে খেলায় মাতে। তেমনি অবুঝ আমার ব্যথারা! ক্ষুদ্রতম সহানুভূতি পাবেনা জেনেও কেমন অবলীলায় অবহেলা কুড়াতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ফিরে যাই বেদনার দীর্ঘ ছায়াতলে।
শ্রাবণ ধারায় আমার ব্যথারা মাথা গুজবার ঠাই পায়। শ্রাবণে বোধকরি পৃথিবীজুরে ব্যথার চিকিৎসা হয়। নইলে এমন শ্রান্ত কোমল বৃষ্টিতে আমার চোখ কেন জলে ছলছল হয়! কেনই–বা স্নিগ্ধ শীতলতায় হৃদয় টালমাটাল! কি দোষ করেছি আমি, কি মোর অপরাধ— শ্রাবণ সুখ সইবার অধিকার বিধাতা কেন দেননি আমায়!
সেই ভোর রাত্তির হতে টিপটাপ বৃষ্টি ধরণীর বুকে মুগ্ধতা জমা করেছে। অথচ শেষ রাত্তিরে ঘুম ভেঙে কি নিদারুণ বেদনায় অন্তর আমার ক্ষয়ে–ক্ষয়ে যায়! বৃষ্টির জল মনের বারান্দায় একা আসে, ক্লান্তির সীমানায় আঘাত করে জানালার সিকে, সে আঘাত প্রতিঘাত হয়ে ফেরে আমার নির্জন বক্ষপর্বতে! আমি হয়ে অনাবিল দুঃখী পর্বতের ঢাল, বয়ে চলি বেদনার নির্বিকার ক্ষত অতল!
রাস্তার ধারে ঝোপের আড়ালে কদম গাছটা কেন জানি ঘোরতর শ্রাবণে গা ঢাকা দেয়। দূর থেকে ফুলের সুরভী, কখনো—বা ঝরে পরা পাপড়িতে পথঘাট একাকার দেখা যায়, তবু যেন কেন কান্ড-শাখা, পত্র-পল্লবের দেখা মেলা ভাঁড়। কদমের সাথে মোর এক আত্মিক যোগাযোগ। ওপারের গাছ থেকে একটি কদমও মাটি স্পর্শের পূর্বে মোর ব্যথাতুর হৃদয়ে বিয়োগ ঘণ্টা বাজে। ব্যথিত হৃদয় হাহাকারে উচ্চারণ করে, “আরও একটু সজীবতা, একটুখানি পবিত্রতা দুনিয়াকে ছাড়লো তবে!”
সাজসজ্জায় কদমের চাইতে খুব পিছিয়ে না থাকলেও চালতা ফুলের ভাগ্যে অতো আদর-যত্ন-মমতা জোটে না। ফুলের চাইতে ফলের গুরুত্ব অধিক হওয়ায় অমন হৃদয়গ্রাহী সৌন্দর্যেও শিল্পীর মনগড়া অবজ্ঞার উদ্রেক কিনা জানি না তবে সৃষ্টিকর্তার এক অনবদ্য সৃষ্টি এই ফুল— সে কথা অনস্বীকার্য। নরম পাপড়ি জুরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় যে জমা হয়— অন্তর্দর্শন অবশিষ্ট রইলে, সৃষ্টির কৃতজ্ঞতা তার কেবল সৌজন্যবোধ মাত্র। সম্ভবত চালতা ফুলের এই কোমলতার জন্যই মানুষ অনায়াসে এমন অবজ্ঞা করে!
কোমলতার প্রতি মানবজাতির কোথাও যেনো একটা বিপত্তি বেঁধে দেওয়া। নাহয়, অবহেলাতেও যে ফুল পবিত্রতা বিলায়, তাকে অগ্রাহ্য করার সাহস কিভাবে হয়? একটা সময় ফুলের পূজারি ছিলাম। চালতা ফুলের প্রতি এমন অবিচারের পর সে থেকে ফিরে এসেছি। মানুষ মহামানব’কেই ভক্তি করে না, আর তো ফুল-লতাপাতা!
সেই থেকে তার প্রতি আমার অভিযোগ অনুযোগ নাই। কেবল শ্রাবণ এলেই দু’চার রত্তি আবোল-তাবোল আউরাই— এই যা! সত্যিকারে ভালবাসার মানুষকে আমরা ভক্তি-শ্রদ্ধায় যতই অতিমানব আখ্যা দেই— তারাও মানুষ। তারই বা কি দোষ.. মানুষই আজ বাছবিচারহীন দুর্বল আর কোমলতার প্রতি অত্যাচারী। বোধহয় জগতের নিয়মই এমন। আমি তাই স্মৃতি জমাই অগোচরে। স্মৃতি প্রকাশের বড় ভয়— জানলে যদি ছুড়ে ফেলে দেয়! দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত ব্যক্তি সামান্য ঢেউতেও যে মৃত্যুভয়ে ডোবে..
তবু ভ্রান্ত জগতে আমি এক নির্বোধ স্মৃতিকাতর। এখানে মানুষ অনায়াসে ভাঙে মূর্তি পূজোর; হেয়ালিতে পোড়ায় নিষ্পাপ অন্তর! ব্যথিত মুহূর্ত কি অপূর্ব দক্ষতায় ভুলে যায় মানুষ অথচ মোর অন্তরে স্মৃতির আকাশ মেঘ কালো করে। এমন দুর্বল স্মৃতি চিত্ত নিয়ে কেমন করে অমন ইস্পাত কাঠিন্যে গলতে গিয়েছি, সে জ্বালায় অসীম জ্বলছি। হৃদয় পোড়ার ধোঁয়া হয় না বলে লোকচক্ষুর আড়ালে আমার ক্ষতরা বেমালুম লুকিয়ে বাঁচে!
ভালবেসে যে অপবাদ পায়, মস্ত দুনিয়ায় সে বড় অসহায়। তার বেদনায় নিরবতা ভেঙে আকাশ কাঁদলে মানুষ তাকে বৃষ্টি বলে। জানিনা কতশত জনার জমানো বেদনায় শ্রাবণ ঢলে পৃথিবী ভাসে! বুক পাজরের ব্যথিত হাড়ে দুনিয়ার মস্ত সৌধ হয়। তবু মানবজনম তাদের মনে রাখে না। তারা যেমন ভালবেসে অবহেলা জমায়, তেমনি মরে গিয়ে পৃথিবীর জঞ্জাল সাফ করে।
তবু বরষার থইথই ভরা নদীতে নববধূ নিয়ে ঘরে ফেরা বরযাত্রীর পবিত্র দৃশ্য নিরাশার কালো মেঘের আড়ালে এক চিলতে সূর্যরশ্মির ন্যায় আমার মনে আশার সঞ্চার করে। স্বপ্ন জিয়োই অনাকাঙ্ক্ষিত বসন্ত বিকেলের ভুলচুক ভুলে আবারও হাসবে মৃণ্ময়ী প্রাণ, আবারও ওই চোখের চাহুনিতে অব্যক্ত রবে মোর অনুভূতি অম্লান। ব্যথিনী সে অন্তরে অমন অবিশ্বাসের শূলে ক্ষত-বিক্ষত করার দুঃসাধ্য মোর কোমল হৃদয় কেমোনে সাধন করে, সে হিসেব কচলিয়ে ঘরের কোণে ক্লান্তিহীন দুঃসময় কাটিয়েছি। তবু তার ভগ্ন হৃদয়ে সে খবর পৌঁছোতে দেইনি। বিষন্নতা ছড়িয়ে পরুক মোর দেহে, মগজে— তবু শ্রাবণ মেঘের ভেলায় সে ভাসুক অনাবিল, অসীম।
টিনের চালে নিগুঢ় রাত্রির শ্রাবণ বর্ষণ, ঝিরিঝিরি সে শব্দ আমার জাগতিক ব্যথায় বিষের ফোড়ন জুড়ে দেয়। আমি খেই হারাই, ফের উঠে দাঁড়াই— শূন্য মনের ডাহুক ডেকে ঘুম পাড়ানি গল্প শোনাই। স্মৃতিভেজা ক্লান্ত মন ডানা ঝাপটে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই যে পৃথিবীর চিরন্তন নিয়ম..