মাশফিক আরেফিন

স্বাধীনামৃত

গল্প, স্যাটায়ার
লেখাটি শেয়ার করুন

মাশফিক আরেফিন,
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

অলিম্পিক পাহাড়ে ঘুরঘুর করছি কম দিন হলোনা। এখনো একবারও দেবরাজ জিউসকে দেব-দেবীদের সম্মেলন আহ্বান করতে দেখলাম না। শুনেছি জিউস এবং হেরা টিকটক করা নিয়ে এখন ব্যস্ত থাকেন বেশি, রাজকার্যে মনোযোগ কমে গেছে৷ আসলে বয়স হয়েছে তো, কথায় আছে বয়স হলে বুড়োরা বাচ্চা হয়ে যায়। জিউস আর হেরার অনেকটা বোধহয় সেই দশা। এখানে আসার পর থেকেই দেখছি হিফাস্টাসই মূলত অলিম্পিক পাহাড়ে ছড়ি ঘুরাচ্ছেন, অবশ্য এখনও অলিম্পিক পাহাড়ের সর্বাধিপত্য বিস্তারকারী হিফাস্টাসের পিতা দেবরাজ জিউসই। হিফাস্টাস একবার বিদ্রোহ করে খোড়া হওয়ার পর থেকে আর পিতার অবাধ্য হননি। পিতাকে সামনে রেখেই ডিপ্লোমেটিক উপায়ে সমুদ্রাধিপতি পসিডন এবং পাতালপুরীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হেইডসকে সুকৌশলে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকানো থেকে বিরত রাখছেন তিনি। দেবতাদের জন্য স্পেশাল টুইটারে হিফাস্টাস খুবই সরব, তাঁর ফলোয়ার সংখ্যা দেব-দেবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ।

গর্গনের মতো ভয়ানক নারী, যার কিনা কেশ সাপের এবং দৃষ্টিমাত্র লোকে পাথর হয়ে যায় তিনিও হিফাস্টাসের সব টুইটে লাইক কমেন্ট করে পাশে থাকেন। তবে লক্ষণীয় একটা বিষয় হচ্ছে, খোড়া পা নিয়ে নয় হিফাস্টাসের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ তাঁর স্ত্রী আফ্রোদিতেকে নিয়ে। মাঝে মধ্যেই তিনি আফ্রোদিতেকে খোঁচা মেরে টুইট করেন, অতঃপর বয়ে যায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। টুইট যুদ্ধে জয় অবশ্য হিফাস্টাসেরই হয়, তবে তাতে আফ্রোদিতের কান দিতে বয়েই গেছে! যুদ্ধ দেবতা এরিস, এমনকি ডায়োনিসাস এ সকল টুইটের প্রতিক্রিয়ায় আফ্রোদিতের চরিত্রকে তুলোধনা করতে একফোঁটাও কার্পণ্য করেননা। তবে হিফাস্টাস নিজেও জানেন আফ্রোদিতের হোয়াটসঅ্যাপে ওঁরাই সবচেয়ে বেশি মেসেজ দিয়ে ভরে রাখেন। বলতে লজ্জা লাগছে আসলে আমিও আফ্রোদিতেকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছি, “মাইসেল্ফ, ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ফ্রম মর্ত্যলোক, ফর্মার সুলতান অফ বাংলা। ক্যান উই বি ফ্রেন্ডস?”
গত পরশু আমার বন্ধু, সাবেক গৌড়েশ্বর লক্ষণ সেন অলিম্পিক পাহাড়ে বেড়াতে এসেছেন বায়ু পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। আমরা দুইজন মর্ত্যলোক হতে আসা রাজ্যাধিপতি ভিআইপি হিসেবে দেবালয়ের বিশ্রামঘরে একই কক্ষে অবস্থান করছি। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার হচ্ছে, আমার বন্ধুও আফ্রোদিতেকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছেন। কিন্তু তাঁকেও কোন জবাব আফ্রোদিতে দেননি! খবর নিতে গিয়ে এখানকার রক্ষীদের মুখে মুখে শুনলাম, আফ্রোদিতে নাকি খুবই স্বাধীনচেতা নারী, তিনি নাকি কোন স্বাধীনতা হরণকারীদের সাথে মিশতে চাননা।
কথাটা শুনে আমরা দুজনই অবাক! বলে কি!!! আমরা কিসের স্বাধীনতা হরণকারী? এটা কোনো কথা! যেই আমি বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করে মুসলিমদের হিরো হয়ে আছি সেই আমি কিনা স্বাধীনতা হরণকারী? এত বড় অপমান! তো মানলাম আমি না হয় লক্ষণ সেনকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলাম, কিন্তু আমরা বন্ধু লক্ষণ সেন কি করেছেন! তাঁর কি অপরাধ? তাঁর মেসেজের রিপ্লাই তো অন্তত দিবেন! তাতেও না হয় একটু সান্ত্বনা পেতাম, দেবলোক ভ্রমণের কিছু স্মৃতি থাকতো অন্তত। এ নিয়ে আমি আর লক্ষণ সেন বিস্তর আলোচনা করেছি, কিন্তু কোন সদুত্তর পাইনি।

হিফাস্টাসের সাথে আমাদের খাতির নেহায়েত কম নয়। আমি একজন বিজেতা মর্ত্যবাসী, সে হিসেবে আমার যথেষ্ট খাতির তিনি করেন। লক্ষণও মর্ত্যলোকে একজন রাজা ছিলেন এবং আমার পরম বন্ধু ও উত্তম শিল্প প্রশংসক হিসেবে গত দুদিনেই হিফাস্টাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আমি একসময় লক্ষণ সেনের থেকে রাজ্য দখল করলেও এখন আমাদের খাতির নেহায়েত খারাপ নয়। এতদিন পরে আসলে বুঝেছি, যেই বাংলার রাজত্ব নিয়ে এত ঘটনা ঘটালাম আমি আর লক্ষণ সেন, এখন সেই রাজ্যের হাল দেখেশুনে রাজ্যকে এক মাকাল ফল বিনা আর কিছুই মনে হচ্ছে না। হেরেমটুকু ছাড়া রাজ্য আমার যাপিত জীবনে কোন উপকারেই আসেনি, সুতরাং ও নিয়ে শত্রুতা রেখে লাভ নেই, তাই আমরা এখন জব্বর দোস্তি পাতিয়েছি।
তো আমরা দুজন ঠিক করলাম, পত্নীবিমুখ হিফাস্টাসের সাথেই তাঁর পত্নী কেন আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী মনে করেন তা নিয়ে আলোচনা করবো। তাই সময় সুযোগ বুঝে একদিন সূর্যাস্তের পূর্বে হিফাস্টাস যখন তাঁর সুইমিং পুলের পাশের রাজকীয় দোলনায় শুয়ে নিভৃতে অপলকে শেষ বেলার সূর্য দেখে থাকেন, তখন হাজির হলাম। সহজেই তাঁর দৃষ্টি আমরা আকর্ষণ করতে সক্ষম হলাম এবং পাশে বসে অলিম্পিক পাহাড়ের সুমিষ্ট আঙুরও মুখে পুরতে পারলাম। তবে দেবরাজ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রশংসা বাক্য এবং হিফাস্টাসের শিল্প, রাজকুটনীতির বিস্তর সুনাম ও শুভকামনা করলেও যে উদ্দেশ্য আমরা এসেছি সেটা কোনোক্রমেই মুখে আনতে পারছিলাম না। দেবীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুচ্ছ মানব হয়ে কথা বলে বসবো! এত বড় স্পর্ধা করি কিভাবে? হিফাস্টাস তখন আমাদের কথা শুনছিলেন এবং তার ‘আইপ্যাড দেবতা ভার্সন ম্যাক্স প্রো’ তে করে ইন্সটাগ্রাম স্ক্রলিং করছিলেন৷ দৈবাৎ ইন্সটাগ্রামে স্ক্রলিংরত অবস্থায় আফ্রোদিতের একটি নাচের কভার সামনে চলে আসলে আমি চোখে পড়তেই ‘মারহাবা’ এবং একই সাথে লক্ষণ সেন ‘অপূর্ব’ বলে উঠলে হিফাস্টাস আমাদের দিকে তাকালেন। বুঝতে বাকি রইলোনা মর্ত্যলোকের নিচু মানুষের কাজটি করে ফেলেছি বলে তিনি যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন৷ এভাবে কারো মুঠোফোন ব্যবহারের সময় তাকানোর মতো নীচ কাজটি দেবলোকে এসে করে ফেলেছি! ভেবেই লজ্জিত হয়ে পড়লাম, কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। নিরবতা ভেঙে হিফাস্টাসই বললেন, “আজকাল ইন্সটাগ্রামে বেশিই সময় কাটাচ্ছেন মনে হচ্ছে আফ্রোদিতে।” আমাদের দুজনকে জিজ্ঞেস করলেন আমরা এসব ব্যবহার করি কি না?
আমি বললাম, ‘আজ্ঞে মহামান্য দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা, আমরা দুজনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করি তবে ততটা সক্রিয় নই। এই মাঝে মধ্যে আরকি। এখন মর্ত্যলোকে তো আর আমাদের পাত্তা নেই বললেই চলে আর দেবলোকে আমাদের কে পাত্তা দিবে!’
একটু ইনিয়ে বিনিয়ে বলেই ফেললাম, ‘শুনেছি দেবী আফ্রোদিতে আমাদের দুজনকেই স্বাধীনতা হরণকারী হিসেবে গণ্য করেন। আমরা এতে যথেষ্ট অপমানবোধ করেছি হে দেবশ্রেষ্ঠ।’

হিফাস্টাস শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসি যেন থামতেই চায়না, হাসতে হাসতেই বললেন, ‘তোমরা পারোও বটে! এসব নিয়ে মাথা ঘামানোরও সময় পাও! স্বাধীনতা হরণ করেছো তো কি হয়েছে! স্বাধীনতা হরণ না করলে কি আর আজ দেবলোকে এসে ভিআইপির মর্যাদা পেতে? না কোনদিন রাজা বা সুলতান হতে পারতে বলতো হে!’
লক্ষণ সেন বলে উঠলেন, ‘হে মহামান্য, খিলজি সাহেব না হয় আমার রাজ্য দখল করেছিলো কিন্তু আমি কি করেছিলাম? আমি কেন স্বাধীনতা হরণকারী বলে বিবেচিত হবো? আর খিলজি সাহেব তো তৎকালীন মুসলিমদের এবং ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের স্বাধীনতাই এনে দিয়ে ছিলেন তাইনা?’
হিফাস্টাস হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন বললেন, ‘তোমরা বলতে চাইছো কি? তোমাদের কাছে স্বাধীনতা কি? একজন তুরস্ক থেকে এসে বাংলা দখল করে নিয়েছো আরেকজন যে কর্ণাটক থেকে এসে বাংলা ভাষাকে প্রায় গলা চেপে মারতে বসেছিলে, বাংলার সাহিত্যকে থমকে দিয়েছিলে দুজন নিজেদেরকে স্বাধীনতা হরণকারী হিসেবে অস্বীকার করতে চাইছো? বাংলার ওই অনার্য জনগোষ্ঠীকে তোমরা যারা শোষণ করেছো তোমরা কি বাঙালি ছিলে হে? মুসলিম আর হিন্দু পরিচয় দিয়ে, ধর্মের দোহাই দিয়ে একদল আরেকদলকে পরাধীন করে রেখেছো। মনে করেছো তোমার দল স্বাধীন, কিন্তু জাতি হিসেবে ওই পশ্চাৎপদ বাঙালিরা কবে স্বাধীন ছিলো? তোমরা শাসকশ্রেণীর লোকেরা কি আদৌ ওদের দলের ছিলে? ওই চাষাভুষা জনগোষ্ঠীর শাসনকর্তা কি ওদের মতো বাঙালি চাষাভুষা কোনদিন ছিলো? চারশো বছরের পাল শাসনামলের পর তোমরা সেনরা যখন বাংলা দখল করলে বাংলায় তো তখন বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো, এখনো বাংলায় প্রায় সকল পুরাকীর্তি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের।তারা এখন কই? তাদের স্বাধীনতা কি ছিলো?’
লক্ষণ সেন একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘দেখুন মহামান্য দেবশিল্পী হিফাস্টাস, বৌদ্ধমাত্রই ক্ষাত্রকূল উদ্ভূত। আর বর্তমান যে বাংলা দেখছেন তা যে সকল জনপদের সমন্বয়ে তৈরি সেই জনপদগুলোকে এক করেছিলেন শাহ-ই-বাঙ্গালা সুলতান শামস্-উদ্-দীন ইলিয়াস শাহ্ এবং ‘বাঙ্গালা’ নামকরনও তাঁর শাসনামলে হয়। এই বর্বর, অনার্য, দ্রাবিড়, প্রাকৃতজাত ভাষায় কথা বলা শংকর জনগোষ্ঠী; এরা নিজেদের একত্র করে চলার সক্ষমতা কোনদিন রাখে বলে মনে হয় আপনার?’


হিফাস্টাস ব্যাঙ্গর সুরেই বললেন, ‘বটে! সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করে নিজেকে গৌড়েশ্বর পরিচয় দেওয়া শাসক, যার শাসনামলে সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্র-বৌদ্ধ জন আচারভ্রষ্ট, তাদের মুখের ভাষা ঘৃণ্য বলে বিবেচিত হতো এবং যে সময়ে বঙ্গের ব্রাহ্মণ আর উচ্চবর্ণীয় লোকেরা বাইরে নিজেদের গৌড়ীয় বলে পরিচয় দিত, বঙ্গীয় নয়। সেই শাসক বৌদ্ধদের ক্ষাত্রকূল বলে প্রমাণ করতে চাইলে দুগ্ধপোষ্য শিশুও মিথ্যা বলবে৷ তবে হ্যাঁ, আর্য কর্তৃক স্বীকৃত এই অসুরদের অঞ্চলটিতে দিল্লির সুলতানদের শাসনকাল বাদ দিলে যেই সুলতানি আমলের দুশো বছর দেখা যায়, তা বাঙালি জাতির ঐক্য ও বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো৷ ঐতরেয় আরণ্যক আর জৈনগ্রন্থের ঘৃণ্য, শশাঙ্কের অবজ্ঞার, পালরাজাদের অবহেলার, সেন-রাজাদের উপেক্ষার ‘বাঙ্গালা’ কে একত্র করে বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করে বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধদের বাংলা ভাষার মাধ্যমে কাছাকাছি নিয়ে এসে মুসলিম সুলতানরা যদি বাংলা ভাষাকে শক্তিমান হওয়ার সুযোগ না দিতো তাহলে এই বাংলা এবং বাঙালি ভাষাভাষীরা মোঘল-ব্রিটিশ-পাক সাম্রাজ্যবাদীদের সাংস্কৃতিক আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারত কি না কে জানে! কিন্তু নিবিড় ভাবে এই অনার্য দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থা যদি পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে বুঝা যায় যে, খাইবার গিরিপথ দিয়ে আসা দখলদার আর্য বা চারশ বছরের পাল শাসনামল শেষ করে বাংলা দখল করা কর্ণাটক থেকে আসা সেন কিংবা তুর্কি, আফগানি, পারসিক ভিনদেশী মুসলিমদের আগমন না হলেও বাংলা স্বাধীন স্বার্বভৌম অঞ্চল হিসেবে নিজস্ব স্বাতন্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত হতে পারতো।’
‘মহামান্য দেবশিল্পী কথার মধ্যে কথা বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ প্রাথমিকভাবে আমি আমার বন্ধু লক্ষণ সেনর সম্মানার্থে নিজেকে স্বাধীনতা হরণকারী হিসেবে মেনে নিতে রাজি থাকলেও এখন এতগুলো শাসকদের জন্য অপমানজনক প্রথাবিরোধী কথা মগজে ঢোকানোর পর আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। বলে উঠলাম, ‘পৃথিবীর সকল দেশই কোন না কোন শাসক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলো এবং আছে। শাসনতন্ত্র বিহীন রাষ্ট্রকাঠামো ভঙ্গুর হয়। তা বেশিদিন স্থায়ী হওয়া কখনোই সম্ভব না অন্তত এমন এক জাতির যারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে সভ্যতা শিখেছে।’
হিফাস্টাস হেসে বললেন, ‘চলো উদাহরণসহ যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবো বাংলার সমাজ ব্যবস্থার ততটুক সামর্থ্য ছিলো, যাতে করে বাংলাদেশ সুপ্রাচীন কাল থেকে স্বাধীন ভাবে নিজেদের পরিচালিত করতে পারতো এবং তাদের সমাজ ব্যবস্থা ছিলো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রজা সহায়ক সমাজ ব্যবস্থা।’
আমরা দুজন একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে হিফাস্টাসকে শুরু করতে অনুরোধ করলাম।


‘প্রায় আশি হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত নদীবিধৌত পলি দ্বারা গঠিত এক বিশাল সমভূমি হচ্ছে বাংলা। একদিকে সুউচ্চ পর্বত, দুই দিকে কঠিন শৈলভূমি আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র এই বাংলার ভৌগোলিক ভাগ্য; মাঝখানের এই সাম্য সমভূমিতে যে সকল পরিচালক ছিলেন, যারা শাসক নন বরং সেবক ছিলেন, তাঁদের কিছু ব্যবস্থাপনাকেই আমি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছি। যেমন- যদি বাংলার একটি গ্রামের দিকে তাকাই যা কয়েক শত বা কয়েক হাজার একর আবাদি বা পতিত জমির এক-একটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত, সেখানে অধিবাসীরা জীবন যাপন করতেন। এই অধিবাসীদের মধ্যে পুলিশ ছাড়াই পুলিশের কাজ করতেন স্থানীয় পটেল অথবা প্রধান মন্ডল যিনি গ্রামের তদারকি করতেন ও অধিবাসীদের ঝগড়ার মীমাংসা করতেন। গ্রামে থাকতেন কর্নম, যিনি চাষের হিসেব রাখতেন এবং চাষ সংক্রান্ত সবকিছু নথিবদ্ধ করতেন। আরোও ছিলেন একজন তৈলার যিনি অপরাধীদের সংবাদ সংগ্রহ করতেন এবং গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গমনাগমনে লোকজনকে পৌঁছে দেওয়া ও রক্ষা করার কাজ করতেন।
পাশাপাশি একজন তোত্তি থাকতেন যিনি শস্য পাহারা দেওয়া ও পরিমাপের কাজ করতেন। একজন সীমানাদারের কাজ ছিলো গ্রামের সীমানা রক্ষা করা এবং কলহ উপস্থিত হলে সীমানা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়া। জলাশয় ও জলপ্রণালীর তত্ত্বাবধায়ন করতেন একজন, জলের বিধিব্যবস্থাও তাঁর হাতেই ছিলো। গুরুমহাশয়কে দেখা যেত বালির উপর ছেলেপেলেদের পঞ্জিকা-ব্রাহ্মণ অথবা জ্যোতিষবিদ্যা শিখাচ্ছেন। এই ধরণের শাসনব্যবস্থায়ই অবিস্মরণীয় কাল হতে বঙ্গবাসী বাস করে এসেছিলো। গ্রামের সীমানা কদাচিৎ বদল হয়েছিলো ঠিকই, পাশাপাশি যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ গ্রামগুলিকে বিধ্বস্ত করলেও সেই একই নিয়মে পরিবার সমূহ যুগের পর যুগ চলেছিলো। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যদি এই সুনিপুণ সমাজ ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে নিজেদের স্বার্থে কাজে না লাগাতো, তাহলে এই বাংলায় যখন এক টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত তখনও বাংলার কৃষককে দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্য নিজের কিশোরী মেয়েকে বিক্রি করতে হতোনা এবং আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে সোনার ফসলে আগুন ধরাতে হতোনা। এই চাষাভুষা জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা হরণ সকল সাম্রাজ্যবাদীরা করেছে। এককালের এই সুসভ্য জাতিকে অনাচার স্বরূপ সভ্যতা চাপিয়ে অসভ্য প্রমাণ করে, নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছিলো সাম্রাজ্যবাদীরাই। যার রেশ ওই জনপদের সহজ-সরল চাষাভুষারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’

দিবাকর চলে গেছে, অলিম্পিক পাহাড়ের গায়ে আছড়ে পড়েছে সুধাকরের শীতল পরশ। নিশ্চুপ হয়ে আছি আমি, নিশ্চল লক্ষণ সেন। দূর হতে মনে হচ্ছে ভেজা চোখে চেয়ে আছে বাংলা মা। হাজার বছরের কলংক নিয়ে বয়ে চলা এই বাংলার মাটি, যা নানান দেশের নানান বীজ আপনার মাঝে আপন করে নিয়েছে, হয়েছে এক শংকর জাতের মা। যেই মা বুক ভরে তাঁর সন্তানদের ভালোবাসে, বিনিময়ে চায় স্বাধীনতার অমৃত। কিন্তু পায় যে সে শুধুই মৃত স্বাধীনতা।

“তোমারা ধরণীতে কাব্য-মহাকাব্য রচেছো,
রচেছো অমরগাঁথা।
ভেবেছো কি কখনো আর্তের কথা?
চাষাভুষা যারা অন্নদাতা!
মগজে বুনেছো বীরদের নাম,
ক্ষত্রিয়দের করেছো প্রণাম।
নত শিরে যারা কর্ষিল ধরণীরে,
শ্লোক কি কভু রচিয়া দেখিছো তাহাদেরও তরে!
যাদের শ্রমে মিটিয়াছে ভূখ,
পাকযন্ত্র, মগজযন্ত্র নতুবা এই দেহযন্ত্র, কুড়াইতেছে সুখ।
সাধিয়াছো কি কভু অমৃত তাদের?
স্বাধীনতার ফল মৃত যাদের!
 ধরণী মাতার সুধার ধারা,
পান করিলো শুধুই দেখ যুদ্ধবাজ যারা।
শান্তিপ্রিয় চাষার দল,
স্বাধীনতার অমৃতের নামে দেখ
পেয়ে গেলো শুধুই মাকাল ফল।”



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply