হঠাৎ প্রেম
লেখাটি শেয়ার করুন
ফাহিম পারভেজ দীপ্ত ।।
নিউমার্কেট মোড়ে কড়া রোদে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়। তীব্র রোদের সাথে তীব্র যানযট। মাথায় হেলমেট ছিলো বিধায় কিছুটা রক্ষে। নিলয়ের মতো বহু মানুষ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাই ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালায়। সাইকেল হেলিকপ্টারের আধুনিক সংস্করণ এই বাইক রাইড শেয়ারিং। প্রথম-প্রথম বাড়তি আয়ের আশায় করলেও এখন এটাই বহু মানুষের জীবীকার একমাত্র অবলম্বন। করোনা মহামারি এই দেশের বহু মানুষের জীবিকার উৎসগুলোকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। নিলয়ও একই পরিস্থিতির শিকার। পড়ালেখা শেষ করে বহু কষ্টে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলো সে। গ্রামের অসুস্থ বাবা-মার দায়িত্ব তারই কাঁধে। একটু মাথা তুলে দাঁড়ানোর আগেই করোনায় তার চাকরিটা চলে গেলো৷ বাসা থেকে বিয়ের জন্য টুকটাক যা কথাবার্তা চলছিলো। চাকরি না থাকায় তাও বন্ধ। এর মধ্যে মরার উপরে খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ালো বাবার করোনা পজিটিভ। অক্সিজেন লেভেল নেমে যাওয়ায় সেটার চিকিৎসায় সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ তাকে ব্যয় করতে হলো। চাকরি হারানোর প্রথম কয়েক মাস লকডাউনে বাসায় বসে অবশিষ্ট সঞ্চয়টুকুও শেষ করেছে সে।
সব আশা ব্যর্থ করে যখন কোনো সুরাহা মিললো না তখন নিজের সেই পুরনো বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিলয়। আগে যেখানে কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার ফাঁকে তেল খরচ ওঠাতে দুই একটা ট্রিপ দিতো। সেই নিলয় এখন ভোর ছ’টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত বাইক চালায়। প্রথম-প্রথম পিঠে ব্যথা হলেও এখন গা সহা হয়ে গিয়েছে সব৷ প্যাসেঞ্জারদের দুর্ব্যবহারও যেন আর গায়ে লাগে না।
প্রথম দিকে রাইড শেয়ারিং এ্যাপসে ভাড়া মারলেও এখন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে প্যাসেঞ্জার খোঁজে নিলয়। কারণ, এ্যাপসের ভাড়ায় তার পোষায় না। কড়া রোদে বহু সময় দাঁড়িয়ে নিলয় একজন প্যাসেঞ্জার খুঁজে পেলো। প্যাসেঞ্জার একজন সুন্দরী তরুণী হওয়ায় নিলয়ের আকর্ষণ বেশ খানিকটা বেড়ে গেলো। মুখের জড়তা কাটিয়ে সে বেশ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলো। হিজাব পরিহিত মেয়েটির চেহারা যেমন মিষ্টি কণ্ঠটাও তেমন মিষ্টি।
মেয়েটির গন্তব্য মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকা। মেয়েটিকে বেশ পছন্দ হওয়ায় নিলয় আর ভাড়া নিয়ে খুব বেশি দরকষাকষি করলো না৷ বাইকে ওঠানোর পর থেকেই নিলয় মেয়েটির সাথে নানাভাবে ভাব জমানোর চেষ্টা করলো। তার নাম কী, বাসা কোথায়, এখানে কী করতে এসেছিলো,কোন ক্লাসে পড়ে এইসব নানা ধরণের প্রশ্ন করতে লাগলো। মেয়েটিও খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে তার প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে লাগলো। লম্বা জ্যামে এটা যেনো তাদের অঘোষিত ডেটিং। মেয়েটি নিলয়কে জানালো তার নাম রাজিয়া। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। নিউমার্কেট এসেছিলো কেনাকাটা করতে। বেড়িবাঁধ এলাকাতেই তার বাসা। নিলয়কেও রাজিয়ার বেশ পছন্দ হয়েছে। নিলয়ের বর্তমান যে মানসিক দুরবস্থা তাতে এই মুহুর্তে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে প্রেম-ভালোবাসা তার জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে৷ রাজিয়া মেয়েটাকে নিলয় সব দিক দিয়ে নিজের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করেছে।
বাসার সামনে আসার পর রাজিয়া তাকে ভাড়া দিতে গেলো। কিন্তু নিলয় সেটা নিতে অস্বীকৃতি জানালো। রাজিয়া তাকে ভাড়া নিতে খুব জোরাজোরি করলো। কিন্তু নিলয় নাছোড়বান্দা। উপায় না দেখে রাজিয়া নিলয়কে বাসায় চা পানের আমন্ত্রণ জানালো। নিলয়ের কাছে বিষয়টা বেশ অদ্ভুত মনে হলো৷ প্রথম দেখাতেই রাজিয়া তাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে চাইছে। রাজিয়ার বাবা-মা কী ভাববে? রাজিয়া নিলয়কে আশ্বস্ত করে বললো, তার মা বেঁচে নেই। আর বাবা সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরবেন না। সুতরাং সে চাইলে বাসায় আসতে পারে।
নিলয় আশেপাশে একটু ভালোভাবে দেখে নিলো। দেখার মতো তেমন কেউ নেই৷ সুতরাং বেশি না ভেবে সে ভেতরে প্রবেশ করলো৷ বাসার মধ্যে ছোট-ছোট দুইটা রুম, একটা বার্থরুম, একটা কিচেন। রাজিয়া কিচেন এ গেলো চা বানাতে। নিলয় বসে আছে সামনের ঘরে। কিন্তু তার নজর দরজার দিকে। সেখান থেকে কেউ হুট করে ভেতরে ঢোকে কিনা সেইজন্যে।
এরই মধ্যে হঠাৎ রান্নাঘর থেকে রাজিয়া বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠলো। চিৎকার শুনে নিলয়ের পিলে চমকে উঠলো। সে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো। রান্নাঘরে ঢুকে সে দেখলো রাজিয়া চা বানাতে গিয়ে হাতে গরম পাতিলের ছেঁকা খেয়েছে। নিলয় সময় নষ্ট না করে দ্রুত ওর হাতটা ধরে বেসিনের ঠান্ডা পানিতে ধুতে লাগলো।
নিলয়ের হাতের ছোঁয়ায় রাজিয়ার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠলো। রাজিয়ার নিঃশ্বাসের শব্দে নিলয়ের যৌবনে যেনো আগুন জ্বলে উঠলো। সে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। রাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে সে তার ঠোঁটে গভীরভাবে চুম্বন করতে লাগলো। রাজিয়ার সারা শরীর উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো। সে নিলয়কে বাঁধা দিতে পারলো না। এভাবে কিছুক্ষণ চুম্বনের পর নিলয় রাজিয়াকে বিছানায় নিয়ে গেলো। রাজিয়া দ্রুত খাট থেকে নেমে দরজাটা ভালো ভাবে লক করে আসলো। রাজিয়া দরজা লক করে আসার পর নিলয় নির্ভয়ে নিজের জামাকাপড় খুলে ফেললো। রাজিয়ারটা খুলতে গেলে সে লজ্জায় নিলয়কে বাঁধা দিলো। এদিকে নিলয়ের উত্তেজনা চরমে। সে রাজিয়াকে রাজি করাতে ব্যস্ত। এই ফাঁকে হঠাৎ মোবাইল ক্যামেরা অন করে রুমে একজন আগন্তুকের প্রবেশ ঘটলো। নিলয় কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি ফোনে নিলয় আর রাজিয়ার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ধারণ করে ফেললো। নিলয় কোনো রকমে খাট থেকে উঠে তাকে বাঁধা দিতে গেলো। কিন্তু লোকটি নিলয়কে উল্টো ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিলো। নিলয় লোকটির কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলো। লোকটি তখন নিলয়কে জানালো, সে রাজিয়ার স্বামী। কথাটা শুনে নিলয় যেনো একেবারে আকাশ থেকে পড়লো। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। নিলয় লোকটিকে রাজিয়ার বাবার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলো। লোকটি তখন তাকে জানালো, সে আর রাজিয়ায় এই বাসায় থাকে। আর কেউ থাকে না। রাজিয়া তার বিয়ে করা বউ। অনেক দিন ধরে সে রাজিয়াকে সন্দেহ করে আসছে৷ আর আজ তাকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছে। এবার নিলয়কে সে পুলিশে দেবে।
(বাংলাদেশের আইনে স্বামীর অজান্তে কেউ তার স্ত্রীর সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হলে তার শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড।)
এই কথাশুনে নিলয় কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। লোকটি নিলয়ের কোনো কথা শুনতে চাইলো না। তার কাছে ভিডিও সহ প্রমাণ আছে।
লোকটি কল করে আরো দুজন লোককে ঘরে ডেকে আনলো। তারা নিজেদেরকে স্থানীয় বলে পরিচয় দিলো। তারাও সব শুনে নিলয়কে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে চাইলো। নিলয় খুব আতংকিত। সে সকলের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলো আর বিষয়টা যাতে এখানেই মিমাংসা হয়ে যায় সেই আকুতি জানালো। রাজিয়ার স্বামী তখন কিছুটা নরম হয়ে নিলয়কে এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে ছাড়তে রাজি হলো। পাশাপাশি সে এ কথাও বললো যে, টাকা পেলে ভিডিওটাও সে নিলয়ের সামনে ডিলেট করে দেবে। সব শুনে নিলয় একেবারে হতবাক হয়ে গেলো৷ এতোটাকা সে কিভাবে ম্যানেজ করবে৷ সে রাজিয়ার স্বামীকে জানালো এতোগুলো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য তার নেই। রাজিয়ার স্বামী তখন প্রস্তাব দিলো নিচে থাকা নিলয়ের মোটরসাইকেলটা তাকে দিয়ে দিতে৷ শুধু তাই না সে রীতিমতো একটা দেড়শো টাকার স্ট্যাম্প পেপারও সাথে করে নিয়ে এসেছে। যেখানে সে লিখবে নিলয় তার কাছে মোটরসাইকেলটি একলক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছে৷
পুরো ঘটনাটা পর্যালোচনা করে নিলয়ের মনে সন্দেহ জাগলো। প্রথমেই তার মাথায় এসেছিলো রাজিয়া দরজা লক করতে গেছিলো। তাহলে বন্ধ দরজা খুলে এই লোক ভেতরে ঢুকলো কিভাবে? ঢুকলো তো ঢুকলো আবার সাথে করে স্ট্যাম্প পেপার নিয়ে এসেছে৷ নিলয় কিছু বুঝে ওঠার আগে ভিডিওটাও করে ফেলেছে। তার কাছে সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে হলো৷ সে রাজিয়ার স্বামীকে জানালো, সে গাড়িও দেবে না কোনো টাকাও দেবে না। উল্টো সে রাজিয়ার স্বামীকে ভয় দেখালো, সে পুলিশের কাছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করবে৷ এই বলে নিলয় ঘর থেকে বের হতে গেলো। রাজিয়ার স্বামী নিলয়ের কর্মকান্ডে ঘাবড়ে গেলো। পুলিশের কাছে ধরা খাওয়ার ভয়ে সে নিলয়কে বাইরে যেতে বাঁধা দিলো। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হলো। আর রাজিয়ার স্বামী সহ বাকি দুইজন নিলয়কে খাটের উপরে ঠেসে ধরলো। রাজিয়ার স্বামী তখন নিলয়ের মুখে বালিশ চাপা দিলো। আর বাকি দুইজন কুরবানির গোরুর মতো শক্ত করে নিলয়ের দুই হাত চেপে ধরলো। কয়েক মিনিট বাদেই নিলয়ের ছটপটানি দেহ একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেলো। কামের ফাঁদে নিজের তরতাজা জীবনটাই হারিয়ে ফেললো সে।
অপরাধীদের একজন মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে গেলো। অন্য দুইজন রাতের অন্ধকারে লাশটা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিলো। পাশাপাশি ওইদিনই তারা ভাড়া বাসা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেলো। বেশ কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর পুলিশ নিলয়ের লাশটি সনাক্ত করতে সক্ষম হয়৷ কপাল ভালো যে, হত্যা মামলা দায়েরের সময় বুদ্ধিকরে নিলয়ের একবন্ধু আর পুলিশের পরামর্শে নিলয়ের বাবা হত্যা মামলার পাশাপাশি মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের ও একটি মামলা দায়ের করেন।
এই ঘটনার প্রায় মাসখানেক পরে মোটরসাইকেল ছিনতাই ও চোরাকারবারির বড় একটি চক্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে। উদ্ধার হয় বেশ কিছু মোটরসাইকেল। যেখানে নিলয়ের সেই মোটরসাইকেলটিও ছিলো। এই উদ্ধারকৃত মোটরসাইকেলের সূত্র ধরেই পুলিশ নিলয়ের প্রকৃত খুনিদেরকে এরেস্ট করতে সক্ষম হয়।
লেখাটি শেয়ার করুন