বাঙালীর দেউলিয়া তত্ত্ব এবং কিছু ‘আজাইরা আলাপন’!
ফাইয়াজ ইফতি ।।
কিছুদিন পর পর ফেসবুকে দেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে, শীঘ্রই দেউলিয়া হয়ে যাবে – ধরনের রব উঠে। সস্তা জোকস আর থার্ড ক্লাস বিনোদন সরবরাহের জন্য আমার একটা কুখ্যাতি আছে, আর এসবের রসদ আমি খুঁজে পাই এই অতি কিউট বাঙালী মধ্যবিত্তের ফেসবুক একাউন্টে।
যাক, ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে লাভ নেই, যা বলার সরাসরি বলি। এই যে দেশ দেউলিয়া হওয়া নিয়ে যারা ভয়ে আছেন তাদের জন্য একটা হাস্যকর কথা শোনাই। মোবাইল ফোন মানুষের সময় বাঁচানোর জন্য আবিষ্কার হয়েছিলো এটা যেমন এখনকার সময়ে হাস্যকর, তেমনি দেশ নতুন করে দেউলিয়া হয়ে যাবে এটাও হাস্যকর। দেশ বহু আগেই দেউলিয়া হয়েছে। না না, অর্থনৈতিকভাবে নয়, মানসিকভাবে!
আমরা একেকজন আসলে মানসিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছি। আমরা শিল্প বুঝি না, সাহিত্য বুঝি না, কৃষ্টি-কালচার-যুক্তি-তর্ক-সৌন্দর্য কিচ্ছু বুঝি না, বুঝি খালি কাগজের এক তাড়া নোট। এই আমরা-ই আবার নোটের তাড়াটা একটু কমে গেলেই দেউলিয়া হওয়ার ভয় পাই! উদ্ভট!
এখন আবার একদল ভাববেন, তবে কি আমরা টাকার পেছবে ছুটবো না? টাকা ছাড়া উন্নয়ন হবে কেমন করে? এসব শিল্প-ফিল্প সাহিত্য-ফাহিত্য করে কি আর পেট চলবে বদ্দা?
আলোচনাটা টাকার বিরুদ্ধে নয়, এমনকি টাকার পিছনে ছোঁটার বিরুদ্ধেও নয়। আলোচনাটা জীবনবোধ জন্মানোর, আলোচনাটা রুচি সৃষ্টির। অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদের একটা উক্তি হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন – “ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে যে মধ্যবিত্ত, সে মধ্যবিত্ত এ দেশে হয়নি। এ দেশের মধ্যবিত্ত ৮০ হাজার টাকা দিয়ে আইফোন কেনে, কিন্তু বই কেনে না। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এ মধ্যবিত্ত কোনো কাজে আসবে না।”
আমাদের মূল কনসার্নটা আসলে এইটা।
ব্যাক্তিগত একটা অভিজ্ঞতা বলি, অনার্স বলতে গেলে শেষ, চাকরির পড়া শুরু করবো করবো করছি কিন্তু এখনো করিনি (কথাটা বলার কারণ হচ্ছে নিজে চাকরীর পড়ার বিরুদ্ধে না এটা বুঝানো)। দুচারটা বই, আপনাদের ভাষায় যেগুলো ‘আউট বই’, অনেকদিন আগেই অর্ডার করা ছিলো আজকে ডেলিভারি করতে এসেছে। হলগেটে নামলাম পার্সেল রিসিভ করতে। পার্সেল নিয়ে রুমে ফিরছি, এক বড়ভাই জিজ্ঞেস করলেন, “কি বই?” নাম বললাম। উনি নাঁক সিটকে বললেন, “এসব সাহিত্য ফাহিত্য করে কিস্যু হবে না। এখনো সময় আছে ভালো হয়ে যা!” আমি জবাবে কি বলবো ভেবে পেলাম না। “ভালো হয়ে যা?” সিরিয়াসলি?
দু চার পাতা এমপিথ্রি কপচিয়ে আল্লাহ না করুক এসব মানুষজন যদি ভালো একটা জায়গায় পৌঁছে যায়, এরা দেশকে কি সার্ভ করবে সেটাই ভাবছি। এসব মানসিক দেউলিয়া লোকজন দেশের উঁচু উঁচু জায়গায় বসে দেশের খোল নলচে ভেঙে চুরে বিক্রি করে খাবে আর রব তুলবে, “শ্যাষ! সব শ্যাষ! দেশডা দেউলিয়া হইয়্যে গেলো!”
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একবার বলেছিলেন, “এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয়না।” কথাটা আমাদের জন্য এতটাই সত্য যে, যুগ-সময় যেটাই হোক, আমাদের চরিত্রের সাথে মিলে যাবে-ই।
যাক, অনেক হুদা প্যাচাল পাড়া হলো, দেউলিয়া দিয়ে শুরু করেছিলাম, দেউলিয়া দিয়েই শেষ করি। সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা উক্তি, ফেসবুকের কল্যাণে আমাদের খুবই পরিচিত, “বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না”। এই উক্তিটার পেছনের গল্পটা আমরা কয়জন জানি? ফেসবুকে বসে আঁতেল সেজে স্ট্যাটাস দিই, “ভিটেমাটি সব বিক্রি করে দিয়েও দেউলিয়া হই নি, কারণ ঐ টাকায় বই কিনেছি।” ওতে আবার অসংখ্য হা হা রিয়েক্ট পড়ে, আমাদের মানসিক দেউলিয়াত্ব আরও সুস্পষ্ট হয় চোখের সামনে। প্রথম কথা হলো – বইয়ের একটা বস্তুগত মূল্য-ও আছে, তাই এই বইটা যেকোন সময়ে আপনি বিক্রি করে টাকায় রূপান্তর করতে পারবেন। এভাবে দেখলে আপনি দেউলিয়া হননি আসলেই, কারণ একই অংকের অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। আর দ্বিতীয় কথা হলো, যেই বই গুলো কিনেছেন সেগুলো পড়া-বুঝা-ধারণ করা শুরু করেন, দেখবেন মানসিক দেউলিয়াত্বটাও কেটে গেছে।
আমাদের কথাটায় নয়, বরং কোন প্রেক্ষাপটে কথা বলা হয়েছে তা বুঝতে হবে।সৈয়দ মুজতবা আলী আসলে আমাদের বই না কেনার, না পড়ার স্বভাবকে কটাক্ষ করে একটা প্রবন্ধে কথাটা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একটা বই প্রকাশ করে বা বইয়ের পিছে বিপুল অংক লগ্নি করে একজন প্রকাশক দেউলিয়া হয়ে যেতে পারেন, এমন বহু নজিরও আছে। কিন্তু একটা বই কিনে আপনি দেউলিয়া হবেন না, এমন কোনো নজিরও নেই। তাই বই কিনুন, কারণ বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না, প্রকাশ করে হলেও হতে পারে!