তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি
মধুরিমা গুহ নিয়োগী
মূল লেখক: তেৎসুকো কুরোয়ানাগি
অনুবাদ: চৈতি রহমান
পৃষ্ঠা: ২৫৬
অনেকদিন পর কোনো বইয়ের রিভিউ লিখতে বসেছি। রিভিউ লেখা শুরু করার আগে একটা কথাই বলতে চাই যে, এই বইটা প্রত্যেক মা-বাবা এবং শিক্ষকের পড়া উচিত।
যদিও আমি চিনতাম না, কিন্তু “তোত্তোচান” বিশ্বসাহিত্যের এক বিখ্যাত বই। “তোত্তোচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি” বইটা মূলত আত্মজীনী হলেও আমার কাছে শিক্ষণীয় একটা বই মনে হয়েছে। তেৎসুকো কুরোয়ানাগি বইটির রচয়িতা যিনি তোমায়ে স্কুলের ছাত্রী ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং জাপানের জনপ্রিয় দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব এবং সমাজসেবী। ১৯৭৯-৮০ পর্যন্ত তোত্তোচান জাপানের একটি সাময়িকীতে ধারাবাহিক হিসেবে বেরোত। ১৯৮১ সালে বইটি প্রকাশিত হলে জাপানে বইটি “ইনস্ট্যান্ট বেস্ট সেলার” পুরস্কার পায়। ১৯৮২/১৯৮৪ (?) সালে ডরোথি ব্রিটন বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এই ইংরেজি বই থেকেই পরে মৌসুমী ভৌমিক বইটির বাংলা অনুবাদ করেন। ২০১৮ সালে চৈতি রহমান বইটির পুনরায় বাংলায় অনুবাদ করেন। পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায়, ভারতবর্ষেও একাধিক ভাষায় অনুদিত হয়েছে এই বই। অনেক দেশে “তোত্তোচান” স্কুলের পাঠ্যপুস্তক।
বইটার ঘটনা শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এবং যুদ্ধ যে একটা দেশকে কি পরিমাণে বিধ্বস্ত করে দেয় এটাও বইটাতে দৃশ্যমান। মূলত তোমায়ে গাকুয়েন স্কুলকে নিয়ে এই বই লিখিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে স্বপ্নের মত সুন্দর এই স্কুলটির অস্তিত্ব কিন্তু আসলেই ছিল, যেখানে শিশুদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবেই গড়ে তোলা হত। তবে এই বইটার মূল লেখক যিনি সেই তোত্তোচানের মা-বাবা, তার কুকুর রকি ও তার দৈনন্দিন জীবনও বইটিতে রয়েছে।
‘তোমোয়ে গাকুয়েন ইশকুল’টি টোকিওর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক ছিলেন সোশাকু কোবাইয়াশি। কোবাইয়াশী ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। দেশবিদেশ ঘুরে তিনি যত ভালো ভালো আইডিয়া জোগাড় করেছিলেন সেগুলো সব মিলিয়ে তাঁর নিজের স্কুলে প্রবর্তন করেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে যায় এই স্কুলটি। তোমোয়ে স্কুল একেবারেই অন্যরকম ছিল বাকি সব স্কুল থেকে। তাদের ক্লাসরুমগুলি ছিল রেলগাড়ির কামরা দিয়ে বানানো। এখানের শিশুরা কখনোই পড়াশুনা নিয়ে মানসিক চাপ বোধ করত না। নিজে থেকেই তারা পড়াশুনা করতে চাইতো কারণ এই স্কুলের পরিবেশই এখানকার শিশুদের তৈরি করেছিল। তাই তারা যা করত সব আনন্দের সাথে। এই স্কুলের আরও অনেক অবাক করা নিয়ম ছিল। যেমন- স্কুলে কখন কোন বিষয় পড়া হবে সে সব ঠিক করত ছাত্রছাত্রীরা। টিফিন খাবার সময়টাও ভীষণ মজাতে কাটতো তাদের। আবার কোনোদিন যদি সকালবেলা পড়া হয়ে যেত দুপুরবেলা নদীর তীরে হাঁটতে যেত। চাষবাসও শেখানো হত। ক্যাম্পিং করা হতো। গ্রীষ্মের ছুটি কাটতো তাদের সমুদ্রস্নানে। চড়ুইভাতির ছলে রান্নাও শেখানো হতো। এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কখনও নৈতিকতা আলাদা করে শেখানো হয় নি। সেটা নিজ থেকেই তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এবং তারা প্রত্যেকেই পরবর্তী জীবনে সফলতা লাভ করে।
তোত্তোচান অর্থাৎ এই বইটির লেখিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ছোট্ট এক জাপানি মেয়ে যে ছিল এই তোমায়ে স্কুলের ছাত্রী। সে ছিল অন্যান্য শিশুদের চেয়ে আলাদা আর খুব চঞ্চল। সে প্রচুর কথা বলত, অনেক প্রশ্ন তার মনে ছিল, সারাক্ষণ এটা-ওটা জানতে চাইত। পুরোনো স্কুল থেকে দুষ্টুমি করার জন্য তাকে সত্যিই বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তোময়ে স্কুল তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাতে সহায়তা করেছিল।
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ‘তোমোয়ে গাকুয়েন ইশকুল’ ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়েও কোবাইয়াশী নাকি বলেছিলেন, পরের স্কুলটা কেমন হবে? তবে তিনি ১৯৬৩ তে মারা যাওয়াতে আরেকটা তোমোয়ে গাকুয়েন পরবর্তীতে আর কোনোদিনও তৈরি হয়নি।
বইটা পড়ার সময় আমার বেশ কয়েকবার হিন্দি ‘তারে জামিন পার’ আর ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুভি দুটোর কথা মনে হয়েছে। তবে এই বইটা একদম সত্যি কাহিনী অবলম্বনে লেখা। তেৎসুকো কুরোয়ানাগির ভাষাতেই বলা যায়-
“এই বইয়ের একটি ঘটনাও আমি আমার খেয়ালখুশি মতন বানিয়ে লিখিনি।”
বইটা নিয়ে আর বেশিকিছু লিখতে চাই না। শুধু বলতে চাই এখনকার সময়ের জন্য বইটা অনেক বেশি উপযোগী। শেষে লেখিকার মতোই বলতে পারি এখনকার যুগে যদি ‘তোমোয়ে গাকুয়েন ইশকুল’-এর মত স্কুল থাকতো তাহলে এখনকার কোনো শিশু বলতে পারতো না যে স্কুল ভালো লাগে না!