জাবির আহমেদ জুবেল

গল্পের ব্যবচ্ছেদ : ডলু নদীর হাওয়া

প্রবন্ধ, বুক রিভিউ
লেখাটি শেয়ার করুন

জাবির আহমেদ জুবেল ।। 

 

 

শহীদুল জহির আমাদের বাংলাদেশের গল্পকারদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যাতিক্রমী গল্পকার।  বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতার মিশেলে তিনি লিখে গেছেন দারুণ সব গল্প। তার গল্পের সবচেয়ে নান্দনিক যে বিষয় সেটা হলো তার বয়ান কৌশল, বাক্য বুনন। তার গল্প বলার ঢং একেবারেই তার নিজস্ব, আর সে গুণেই তিনি হয়ে উঠেছেন তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’ এর শহীদুল হক থেকে আজকের শহীদুল জহির। শহীদুল জহির মৃত্যুবরণ করেন ২০০৮ সালে। মূলত মৃত্যুর পর থেকেই মানুষ তাকে চিনতে শুরু করে। তার আগে শহীদুল জহির খুব বেশি মানুষের নজর কাড়তে পারেন নি। নিভৃতে তিনি লিখে গেছেন একের পর এক অসাধারণ গল্প, উপন্যাস৷ লিখেছেন খুব অল্প। কিন্তু যা লিখেছেন তা যে কালোত্তীর্ণ, তা যেকোনো সচেতন পাঠকমাত্রই স্বীকার করবে।
আমরা আজকে আলোচনা করবো শহীদুল জহিরের “ডলু নদীর হাওয়া” গল্পটি নিয়ে। শহীদুল জহিরের অধিকাংশ গল্পই পুরান ঢাকার পটভূমিতে লিখা, সেখানকার মানুষদের নিয়ে লিখা। কিছু গল্প আছে তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের পটভূমিতে লিখা। এই দিক দিয়ে দেখলে ডলু নদীর হাওয়া গল্পটা তার অন্য সব গল্প থেকে আলাদা, কেননা এই গল্পের পটভূমি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া।

আমরা এবার গল্পতে প্রবেশ করি। দীর্ঘ দীর্ঘ বাক্য লিখার প্রবণতা শহীদুল জহিরের আছে৷ তিনি তো একটি মাত্র প্যারাতে, কোনো দাঁড়ি ব্যাবহার না করে, কমা; সেমিকোলন এইসব ব্যবহার করেই “আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস” নামে অসাধারণ একটা গল্প লিখেছিলেন। তিনি যে বড় বড় বাক্য লিখতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, নিরীক্ষা করতে পছন্দ করেন এই গল্পই তার প্রমাণ। আমাদের আলোচ্য গল্পের প্রথমেই একটা লম্বা বাক্য দেখতে পাই। লম্বা বাক্যের কিছু অংশ পড়া যাক, “ডলু নদীতে এখন অনেক পানি, অথবা হয়তো পানি তেমন নাই,” এখানে এই বাক্যাংশটি লিখার কারণ এর মধ্যে থাকা “অথবা হয়তো” শব্দদ্বয়। প্রথম বাক্যের পরে যদি আমরা দ্বিতীয় বাক্যটি পাঠ করি সেখানেও লম্বা একটা বাক্য পাবো। এই বাক্যের শুরুর শব্দই  ‘হয়তো’ ব্যবহার করা হয়েছে তারপরই ‘অথবা’। এরকমই প্রায় প্রত্যেকটা প্যারাতেই শহীদুল জহির তার ‘হয়তো’ শব্দের খেলাটা খেলে গেছেন৷ শহীদুল জহির গল্প বলার ভেতর দিয়ে পাঠককে একটা অনিশ্চয়তার ভেতরে ফেলে দিতে চান৷ তাদের বিভ্রান্ত করে, মোহের মতো কিছুতে আচ্ছন্ন রেখে গল্পটা বলে যেতে চান। তিনি তার লেখার মধ্যে হয়তো/ অথবা এই ধরণের শব্দ ব্যাবহার করে পাঠককে অনেকগুলো সম্ভাব্যতার ভেতরে ফেলে দেন। এই জিনিষটা হতে পারে আবার ওই জিনিষটাও হতে পারে। এইযে একটা সম্ভাব্যতা, একটা অনিশ্চিতা, এর মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির পাঠককে বিভ্রান্ত করে গল্পটা সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চান। এরকম হয়তো জাতীয় শব্দের ব্যবহার সৈয়দ হকের গল্পেও পাওয়া যায়৷ তিনি এইসব শব্দ দিয়ে অনেকগুলো সম্ভাব্যতার জন্ম দেন, তিনি সঠিক করে বলেন না কোনটা ঘটছে বা ঘটেছিলো, তার কাছে গল্প মানেই অনেকগুলো সম্ভাব্যতার যোগফল। তবে হ্যাঁ, তার সম্ভাব্যতা পাঠককে বিভ্রান্ত করে না, যা শহীদুল জহির করেন। বিভ্রান্ত করার এই কৌশলটা দিয়ে শহীদুল জহির পাঠককে গল্পের ভেতরে বুঁদ করে রাখার জন্যই ব্যবহার করেন বলে আমার মনে হয়। আচ্ছা এবার আমরা গল্পটাতে একটু আগাই। এবার আমরা দেখি গল্পের এক নাম চরিত্র তৈমুর আলি চৌধুরী একজন খোঁড়া মানুষ। কিভাবে লুলা হলো, গল্পকার সেই ইতিহাস খুজতে চান, আর সেজন্য তিনি তার মায়ের দারস্থ হন। কিন্তু বৃদ্ধ মা, গোলেনুর বেগম সঠিক করে কিছুই বলেন না। অনেকটা আবুলতাবুল বকার মধ্য দিয়ে পাঠকদের বিভ্রান্ত করতে চান। ওই যে আমি আগেই বললাম শহীদুল জহির পাঠককে বিভ্রান্ত করে করে গল্প বলতে পছন্দ করেন৷ এখানে গোলেনুর বেগমকেও তিনি বিভ্রান্তি তৈরির কাজেই ব্যবহার করেছেন৷

পাঠক গল্পটা আরেকটু পড়ে সামনে আগালেই বড় একটা ধাক্কা খাবে৷ তৈমুর আলি নাস্তা করা শেষ হলে তার বৌ সমর্ত বানু তার জন্য দুই গ্লাস পানি নিয়ে আসে। এক গ্লাসে সমর্তের হাতের আঙুলে থাকা হীরার আংটি ডুবিয়ে তৈরী করা বিষযুক্ত পানি, অন্য গ্লাসে খাবার পানি। দুই গ্লাস থেকে বেছে এক গ্লাসের পানি তৈমুরকে খেতে হয়। গল্প থেকে জানা যায় এটা একটা খেলা, সমর্ত বানুর সাথে তৈমুরের এক চুক্তির নিয়মানুযায়ী তারা এই খেলা খেলে। গল্পকারের ভাষায়– “যৌবন ও পৌঢ়ত্বের পরে বার্ধক্যের দিন গভীরতর হয়- সমর্ত বানুর ডান হাতের মধ্যের আংগুলে পরা একটা আংটি চামড়া এবং মাংসের ভিতরে গেড়ে বসে থাকে, অথবা হয়তো বুড়া হয়ে যাওয়ার পর এটা ঢিলা হয়ে আসে — তথাপি তৈমুর আলি চৌধুরীর দিন কাটে সমর্তের হীরার আংটি ডুবিয়ে তৈরী করা বিষ খেয়ে মরা অথবা না মরার খেলায়।” সমর্তের এবং তৈমুরের এই খেলা শুরু হয় তাদের বিয়ের রাত থেকেই। কিসের জন্য এই খেলার সূচনা তা একটু পরেই জানা যাবে। তৈমুরের কখনো কখনো সন্দেহ  জাগতো যে কোনো গ্লাসেই হয়তো বিষ নেই। কিন্ত বিষ যে আছে তার প্রমাণ সমর্ত বিয়ের রাতে এই বিষ দিয়ে একটা বিড়াল মারার মধ্য দিয়ে এবং সেই সাথে আরো অনেক দিন কিংবা বছর পর আরেকবার আরেকটা বিড়াল কিংবা কুত্তা মেরে তৈমুর আলির সন্দেহ দূর করে দেয়। তারপর থেকেই তাদের সেই খেলা শুরু হয়। প্রতিদিন সকালে নাস্তা করার সময় সমর্ত দুই গ্লাস পানি নিয়ে আসে, এক গ্লাসে থাকে জহর, অন্য গ্লাসে থাকে পানি। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো বছরের পর বছর ধরেই তৈমুর নির্ভুলভাবে পানির গ্লাসটাই বেছে নেয়। চল্লিশ বছর ধরে তৈমুর সঠিক গ্লাসটাই তুলে নিচ্ছে। তার প্রচন্ড সন্দেহ হয়। একদিন সমর্ত বানু নাস্তা করানোর সময় তার জন্য চিনি নিয়ে আসতে গেলে সে এই সন্দেহ থেকে কিংবা প্রচন্ড পিপাসা থেকেই দুই গ্লাস পানিই খেয়ে ফেলে এবং কিছু পরেই মারা যায়৷

এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে, গল্পকার চল্লিশটা বৎসর ধরে পানি আর বিষ খেয়ে বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়ার খেলাটা পৌনঃপুনিকভাবে খেলে গেছেন। এই যে পৌনঃপুনিকতা এটা শহীদুল জহিরের গল্পের আরেকটা বৈশিষ্ট্য। তার অন্য সকল গল্পেই জীবনের বিভিন্ন ঘটনার ঘটা কিংবা না ঘটা পৌনঃপুনিকভাবে হয়ে আসছে। আমাদের জীবন যে একটা ছকের ভেতর আবদ্ধ সেটা জহিরের গল্পের পৌনঃপুনিকতার ভেতর দিয়ে বুঝা যায়। আমাদের দেশের আরেকজন গল্পকারের গল্পেও জীবনের বিভিন্ন ঘটনার পৌনঃপুনিকতা ভালো করে দেখা যায়, তিনি হলেন মঈনুল আহসান সাবের। শহীদুল জহিরের গল্পে ঘটনার পৌনঃপুনিকতা এতো এতোবার ঘটে যে কখনো কখনো তা প্রচন্ড একঘেয়ে মনে হয়। কিন্তু আমাদের আলোচ্য গল্পে এমন পৌনঃপুনিকতা দেখা যায় না। শুধু পানি কিংবা বিষয়ের পাত্র থেকে চল্লিশ বছর ধরে এভাবে নাস্তা করা, পানি খাওয়া কিংবা নির্ভুলভাবে পানির গ্লাস বেছে নেয়ার পৌনঃপুনিকতা ছাড়া আর কোনো পৌনঃপুনিকতা নেই।

‌গল্পকার এতোটুকু লিখার পর চলে যান ভিন্ন আরেক টাইমফ্রেমে। আমরা দেখি এখানে তৈমুর একজন যুবক। সে দশ বছর বার্মা থেকে ‘আল্লাহ মালুম’ জাতীয় কিছু কাজ করে সাতকানিয়া ফিরে আসলে এখানকার যুবতী, অনতি যুবতীদের জীবনে নতুন এক সংকট তৈরী হয়; অনেক মেয়ে গোপনে কাঁদে। এই ঘটনা থেকে তৈমুর সম্পর্কে একটা অনুমান করা যায় যে সে তার ধনী বাবার লম্পট ছেলে। যাইহোক, একদিন তৈমুর তার বন্ধুদের নিয়ে ডালু নদীর কিনারায় একটা শালিক খুজতে গেলে তারা শালিক খুজে পায় না। কিন্তু তারা সেখানে এক মেয়েকে খূজে পায়, হয়তো তৈমুর তখনি তার জীবনের শালিক পাখি পেয়ে যায়। আর এই মেয়েই পরবর্তীতে নানা নাটকীয়তায় তার বৌ হয়, সে আসলে সমর্ত বানু ছিলো।

প্রথম দেখাতেই তৈমুর আলির সমর্ত বানুকে ভালো লেগে যায়। কিন্তু সমর্ত বানু যে তার গ্রামের সুরত জামাল নামের এক ছেলেকে ভালোবাসে! এটা বুঝার পর, তৈমুর আলি সমর্ত বানুকে কাছে পাওয়ার জন্য চারটা ফন্দি বের করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে। প্রথমে সে সুরত জামালকে তাদের জমি দেখার কাজ দিয়ে আলিকদম পাঠিয়ে দেয়। তারপর একদিন সমর্তর বাপ জসিম করাতিকে নিয়ে গাছ কেনার অজুহাতে লোহাগড়ায় যায়, এবং টাকা কম নিয়ে আসার অজুহাতে করাতিকে সেখানে রেখেই তৈমুর তার গ্রামে ফিরে আসে। ফিরে এসে রাতে সে সমর্ত বানুর কাছে যায় কিন্তু সমর্ত বানু সে রাতে তাকে ফিরে যেতে বলে এবং আগামীকাল রাতে আসার কথা বলে!  পরেরদিন রাতে সমর্তের বাড়িতে গেলে দেখা যায় বাড়ির চারপাশ বাঁশের কাঞ্চি আর বরইয়ের কাটা দিয়ে ঘিরা। ফলে বাড়ি ঢুকার কোনো রাস্তা থাকে না। আর তখনি সমর্ত বানু তৈমুর আলিকে তার প্রথম চুক্তির প্রস্তাব দেয়। চুক্তি অনুযায়ী এই বাড়ির চারপাশে তিনটি প্রবেশের পথ রয়েছে  এবং এই তিন পথের একটায় খরগোশ ধরার ফান্দ পাতা আছে। তৈমুর আলিকে এই ফান্দ এড়িয়ে প্রবেশ করতে হবে৷ যদি সে ফান্দে পড়ে যায় তাহলে আর কখনো সে এই মুখা হবে না। তৈমুর এমন চুক্তিতে মজা পায়, এবং তা গ্রহণ করে। যাই হোক সে গর্তপথ দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে সে খাদে পড়ে যায় এবং তাঁর বাম পায়ের চাকতি নড়ে যায়। তারপর সে রাতে সমর্ত বানুর কপালে নেমে আসে এক ভয়াল রাত, যে রাতের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয় তাঁকে সারাটা জীবন। সমর্ত বানুর সতীত্ব বা নারী জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি সে রাতে তৈমুর আলি নিয়ে যায় তাঁর কাছ থেকে। বাড়ি ফেরার পথে তৈমুর আলি আবিষ্কার করে তাঁর বাম পা নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর তখন থেকেই তাঁর খঞ্জত্বের শুরু। অনেক অনেকদিন চিকিৎসা করালেও তাঁর পা আর কখনো ভালো হয়নি। এমন অবস্থায় একদিন হঠাৎ করেই তৈমুরের বাড়িতে সমর্ত বানুর আবির্ভাব হয়, সে তৈমুর আলিকে দেখতে আসে। এবং জানায় সে আলী কদম চলে যাবে। কিন্তু দেখা যায় যে সমর্ত বানু আলী কদম যায় না বরং ২য় আরেকটা শর্ত দিয়ে তৈমুর আলির সাথে সে বাকি জীবন কাটায়। তাঁর শর্ত অনুযায়ী সে তৈমুরকে প্রতিদিন দু গ্লাস পানি দিবে, এক গ্লাস পানি হবে তাঁর হাতের হীরের আংটি ডুবিয়ে তৈরী করা জহরের বিষ মেশানো এবং অন্য গ্লাস হবে খাবার পানি। এখান থেকেই তাঁকে এক গ্লাস বেছে নিয়ে তাঁকে তা পান করতে হবে। বাকি চল্লিশ বছর দেখা যায় তৈমুর আলি বিষ এবং পানির গ্লাস থেকে ঠিক ঠিকভাবেই প্রতিদিন পানির গ্লাসটাই বেছে নেয়। কখনো কখনো তাঁর মনে সন্দেহ জাগে, মনে হয় কোনো গ্লাসেই বিষ নেই কিন্তু সমর্ত বানু গ্লাসে যে বিষ আছে তাঁর প্রমাণ বিয়ের রাতেই দুই বিড়াল মেরে প্রমাণ করেন, তারপর আবার বহুদিন পর আবারো আরেকটা কিছু বিষ দিয়ে মেরে বিষের প্রমাণ দেন। তারপর আরেকদিন তৈমুর আলি যখন এক সুযোগে দুই গ্লাসের পানিই পান করে ফেলে তখন তৈমুর আলি মারা যায়। ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেটে লিখা থাকে আকস্মিকভাবে প্রবল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সে মারা যায়। তৈমুর আলির চল্লিশা হয়ে গেলে সমর্ত বানু তাঁর ছোট ছেলেকে ডেকে সে বলে, ‘আঁই আলিখদম যাই থাইক্কম, আঁরে আলিখদম রাখিয়ে আইয়ো।’ এবার আবার আরেকটা নাটকীয় ঘটনা ঘটে। আলি কদম যাওয়ার আগে তাঁর হাতের হীরের আংটি ছেলেকে দিয়ে বলে ‘ইবা রাখি দঅও, ইবা হীরা’ কিন্তু পরে ছেলে যখন হীরা বিক্রি করতে চায় তখন দেখা যায় জহুরিরা বলে এটা হীরা নয় বরং কাচ!

এই গল্পকে আমি একটা ভালোবাসার গল্প হিসেবেই দেখতে চাই। তৈমুরের বাপ অর্থ বিত্ত এবং ক্ষমতার মালিক এবং তৈমুর নিজে একজন লম্পট কেননা তাঁর বার্মা থেকে সাতকানিয়া ফিরে আসলে পাড়াপড়শি এবং যুবতী মেয়েরা ভয় পেয়ে যায়। তবুও তাঁর জীবনে ভালোবাসা আসে। ডলু নদীর তীরে একটা শালিক দেখার পর আরেকটা শালিক খুঁজে। তাদের লোককথায় সম্ভবত এ ব্যাপারে আছে একটা শালিক দেখলে আরেকটা শালিক খুঁজে বের করতে হয়। সমর্ত বানুর সাথে তৈমুর আলির দেখা হওয়ার পর, তাঁর সাথে কথা বলার পর সে আর সমর্তকে ভুলতে পারে না। তাঁকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁর ভেতরে তৈরি হয়। এবং এক রাতে সে যখন সমর্তের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারলে সে রাতে সে সমর্তের সাথে মিলিত হয়, সমর্তকে সে ধর্ষণ করে। আবার যখন একদিন সমর্তের সাথে তাঁর বিয়ে হয় তখন কিন্তু তাঁদের বিয়ে হয় অদ্ভুত এক শর্ত মেনে নিয়ে। প্রতিদিন বিষ ও পানি থেকে পানি বেছে খাওয়ার যে খেলা সমর্তকে বিয়ে করার বিনিময়ে তৈমুর মেনে নেয় সেটা শুধুই তাঁর চরিত্রের কামুকতা থেকে? নাকি তাঁর মধ্যে তীব্র ভালোবাসাও ছিলো? হ্যাঁ তাঁর মধ্যে কমুকতা ছিলো, যার প্রথম প্রকাশ সমর্তকে ধর্ষণের মধ্যমে। তবে সে সমর্তকে ভালোবাসত সেজন্যই সমর্তের দ্বিতীয় শর্ত মেনে নিয়ে তাঁকে বিয়ে করতে সে রাজি হতো না। ভালোবাসা মানেই তো বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়া। তৈমুরের এক পাশে আছে বেঁচে থাকা অন্যপাশে রয়েছে মৃত্যু। সে সেটাকে জেনেই আলিঙ্গন করেছে।

এবার অন্য আরেকটা বিষয়ের দিকে নজর দেয়া যাক। শহীদুল জহিরের গল্প পড়লেই বুঝা যাবে তিনি কতোটা জীবন্ত করে গল্পটা উপস্থাপন করেন। তাঁর প্রত্যেকটা চরিত্র আমাদের সামনে সরাসরি উপস্থিত হয়ে যায়। তাঁদের মুখের কথা কোনোভাবেই আরোপিত নয়। তিনি তাঁদের ভাষায় গল্প বলে গেছেন। আমাদের আলোচ্য গল্পেও এমনটা হয়েছে, তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে দিয়েছেন দারুণ মুনশিয়ানার পরিচয়। তাছাড়া আরেকটা বিষয় আমরা দেখি। যখন তৈমুর আলি সমর্তের বাড়ির পাশের তিনটা গর্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন তখন তিনি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা চিত্র এঁকে দেখান। গল্পের মধ্যে চিত্র এঁকে, টেবিল এঁকে বিশ্লেষণ করা আমার জানাশোনার মধ্যে শুধু শহীদুল জহিরই করে দেখিয়েছেন। তাঁর অন্য আরেকটা গল্প, “ইন্দুর বিলাই খেলা” তেও এই ব্যাপরটা দেখা যায়। অর্থাৎ শহীদুল জহির শুধু আমাদেরকে গল্প কান দিয়ে শুনিয়েই যেতে চান না বরং তিনি গল্পটা আমাদের চোখের সামনে দেখাতে চান।
আচ্ছা এবার আবার গল্পতে যাই । গল্প পড়তে গিয়ে কি আমাদে মনে প্রশ্ন জাগে না হঠাৎ সমর্ত বানু কিসের জন্য এমন শর্ত দিয়ে তৈমুরকে বিয়ে করতে চাইলেন?

শহীদুল জহির গল্পটির মেয়ে চরিত্রের নামটার দিকে একটু ভালো করে লক্ষ করি, সমর্ত বানু, এর অর্থ শক্তিমান, ক্ষমতাধর নারী। সম্পূর্ণ গল্পে সমর্ত তাঁর নামেরই পরিচয় দেয়। সমর্ত তাঁর ভালোবাসা সুরত জামালের প্রতি সকল টান দূরে রেখে সে তৈমুরকে বিয়ে করেই মূলত তাঁকে হত্যা করার জন্য এবং তা তৈমুরকে সে বিয়ের আগেই জানিয়ে দেয় যে তাঁকে সে বিষ দিয়ে হত্যা করবে। তৈমুর সেই রাতে যখন তাঁর প্রথম শর্ত ভঙ্গ করে তাঁকে ধর্ষণ করে মূলত সে সেই প্রতিশোধটাই  নিতে চায়। সে রাতে সমর্ত বানু যে মূল্য দিয়েছিলো সেই মূল্য সমর্ত চল্লিশ বৎসর ধরে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে তৈমুরকে রেখে আদায় করে। শহীদুল জহির বিশয়টাকে এভাবে তুলে ধরেছেন, “যৌবন এবং পৌঢ়ত্বের পরে বার্ধক্যের দিন গভীরতর হয় – সমর্তের ডান হাতের মধ্যের আঙ্গুলে পরা একটা আংটি চামড়া এবং মাংসের ভেতর গেড়ে বসে থাকে অথবা হয়তো বুড়া হয়ে যাওয়ার পর এটা ঢিলা হয়ে আসে- তথাপি তৈমুর আলি চৌধুরীর দিন কাটে পানিতে সমর্তের হীরার আংটি ডুবিয়ে তৈরী করা বিষ খেয়ে মরা অথবা না মরার খেলায়।” এভাবেই তৈমুর মৃত্যুর বেঁচে থাকার যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে থাকে, আর যন্ত্রণাই হয়তো সমর্ত বানু চান।

এখন স্বভাবত প্রশ্ন জাগতে পারে চল্লিশ বছরে একদিনও কি তৈমুর বিষ খায় না কেন? সে কিভাবে প্রতিদিন সকালে সঠিক গ্লাসটাই বেছে নেয়? হীরার আঙ্গটি কিংবা বিষের ব্যাপারটা কি সম্পূর্ণই ভাঁওতাবাজি?
আমাদের এই প্রশ্ন গুলোর উত্তরের ক্ষেত্রেই শহীদুল জহির জাদুবাস্তববাদের কৌশল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে প্রয়োগ করেছেন।
আমার কাছে যতটুকো মনে হয়, সমর্ত তাঁর মায়ের কাছ থেকে পাওয়া হীরের আংটি পেয়েছিলোই মূলত নিজেকে রক্ষা করার জন্য। গল্পের ভেতরে সমর্তের মা, মগ রমণী অংমেচিং ব্যাপারে রহস্যময় কথাবার্তা কিছুটা বলা হয়েছে। লেখক এখানে বেশ কিছু কথা অস্পষ্ট রেখেছেন। শহীদুল জহির গল্পের এই অস্পষ্টতা পছন্দ করেন। অংমেচিং যখন পটকা মাছ খেয়ে মারা যায় কিন্তু সমর্ত এবং তাঁর বাপ একই মাছ খেয়েও বেঁচে থাকে তখন অংমেচিং মারা যাওয়ার আগে তাঁর মেয়েকে কানে কানে কিছু কথা বলে যায় এবং এই হীরের আংটিটি দিয়ে যায়। যাদুকরী, রহস্যময়ী মগ রমণী মারা গেলেও তাঁর দুশ্চিন্তা হয় তাঁর বালিকা মেয়ের জন্য, মা ছাড়া একটা মেয়ে এই পৃথিবীতে কতটা অসহায় সেটা সে জানতো তাইতো সে তাঁকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যই এই আংটিটি দিয়ে যায়।

এখন কথা হলো, প্রতিদিন একটা গ্লাসে বিষ আরেকটা গ্লাসে পানি থাকলেও তৈমুর কিভাবে সে প্রতিদিনই পানির গ্লাসটাই বেছে নেয়? এখানে শহীদুল জহির জাদুবাস্তববাদের ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করেছেন। একদিন দুইদিন কিংবা এক মাস সঠিক গ্লাস বেছে নেয়াটা সম্ভব কিন্তু চল্লিশ বছর ধরে একইরকম করাটা অসম্ভব মনে হতে পারে আর এই অসম্ভব ব্যাপারকেই বাস্তবের সাথে মিশিয়ে এক ধরণের জাদু বাস্তবতা তৈরী করেছেন।
এখন আংটিটা  সমর্তের ছেলে যখন বিক্রি করতে চায় তখন জহরী তাতে হীরা পায় না বরং এটাকে কাচ বলে। এর ব্যখ্যা কি হতে পারে? আগেই বলছি অংমেচিং তাঁর মেয়েকে, সমর্তকে বালিকা থাকতে এই আংটি দেয় তাঁর আত্মরক্ষার জন্য। যখন তৈমুর আলি মারা যায় তখন ইতিমধ্যেই সে বৃদ্ধা হয়ে গেছে। আর তাঁকে ধর্ষণ করার প্রতিশোধও সে নিয়ে ফেলেছে। এখন সে তাঁর হাতের আংটি খুলে ছেলের কাছে দিয়ে দেয়। আর আমার কাছে মনে হয় তখনি সেই আংটির কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে যায়, অথবা ছেলে যখন তাঁর মায়ের আংটি বাজারে বিক্রি করতে যায় তখনই সে আংটি একটা রহস্যময়, জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন আংটি থেকে  একটা কাচের আংটিতে পরিণত হয়ে যায়। জাদুবাস্তবতায় এটা অসম্ভব কিছু না।

সর্বশেষ আমরা দেখি সমর্ত বানু তৈমুর আলির মৃত্যুর পর আলি কদম চলে যায়। এতো বছর পরেও সে তাঁর ভালোবাসাকে ভুলে নাই। সমর্ত হয়তো তৈমুর আলিকে বিয়েই করেছিলো এই ভেবে যে প্রতিদিন পানি আর বিষের গ্লাস দিলে একদিন তো তৈমুর বিষের গ্লাস বেছে নিবে, চারদিন, পাঁচদিন, দশদিন কিংবা একমাস বা সর্বোচ্ছ দুই মাস এর বেশি তো লাগবে না, এর ভেতরেই সে বিষ পান করবে আর সমর্ত তাঁর প্রতিশোধ নিতে পারবে। তারপরেই সে চলে যাবে আলি কদম নিজের ভালোবাসার কাছে। কিন্তু কে জানতো এজন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে চল্লিশটি বৎসর, জন্ম দিতে হবে ১২টা সন্তান। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সমর্ত সুরত জামালকে ভালোবেসে যায়, অপেক্ষা, প্রতীক্ষার যন্ত্রণাকে বুকের ভেতর লালন করে সে অপেক্ষা করতে থাকে প্রিয় সেই মুহুর্তের জন্য যখন সে চলে আসবে আলি কদম। আমার চোখে এই গল্পটা ভালোবাসার একটা গল্প।


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply