সেইসব বিকেলের গল্প
মাহমুদ নেওয়াজ জয়।।
বিকেলে বসে আছি একাকী। এখন আমার অবসর জীবন। হাতে তেমন কাজ নেই। তাই বসে বসে পত্র-পত্রিকা পড়ি। টেবিলের পাশের জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকাতেই বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে চলা নদীটির দিকে চোখ পড়ল। দারুণ খরস্রোতা ছিল এককালে, আজ আর নেই। আমি যেন ফিরে গেলাম এই বিকেল থেকে বিশ বছর আগের এক মায়াময় বিকেলে।
তখন মনীষা আমার পাশে ছিল। আমি তখন এই নিভৃত মফস্বলে নয়, বরং পাহাড়ঘেরা এক স্থানে বাস করতাম। সেখানে পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভেসে যেত সারি সারি মেঘ। সূর্যাস্তের সময় আকাশের গায়ে মেঘেরা আবির মাখিয়ে দিত। সেসব দিনগুলোর বিকেলে কিংবা এমন আবির ছোঁয়ানো সন্ধে নামার মুখে মনীষাকে নিয়ে আমি চলে যেতাম পাহাড়ের নিচে বয়ে চলা নদীটির ধারে। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি বসে থাকতাম। স্বপ্নময় সেই মুহূর্তগুলো কত যে দ্রুত কেটে যেত, টেরও পেতাম না।
নদীর জলে মনীষার প্রতিবিম্ব তৈরি হতো, তার দীঘল কালো চুল যেন নদীর কালো জলের সাথে মিশে একাকার হয়ে যেত। তার হরিণের মতো কালো চোখদুটো অপলক চেয়ে থাকত আমার দিকে। নদীর ধারে ফুটে থাকা বুনো গোলাপের ঝাড় থেকে গোলাপ তুলে গেঁথে দিতাম তার খোঁপায়। কখনো কখনো আমার হাত ছড়ে যেত। সে গভীর মমতায় অশ্রুভরা চোখে তার শাড়ির আঁচল থেকে কিছুটা ছিঁড়ে আমার হাতে বেঁধে দিত। তার হাতের স্পর্শে যেন আমার ব্যথার অনেকটাই উপশম হয়ে যেত। তার হৃদয় ছিলো মমতায় পূর্ণ, তার দিকে তাকিয়ে থেকে আমি জয় গোস্বামীর মতো ‘এক পৃথিবী’ লিখতে পারতাম। আমার কোলে মাথা রেখে সে সলাজ নয়নে জানতে চাইত, ‘ কখনো আমায় ছেড়ে যাবেনা তো? ‘
আমি দৃঢ় আশ্বাসে ‘ না ‘ বলে গভীর আবেগে তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করতাম। তার মাঝে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। রবি ঠাকুরের সেই কবিতার মতো, ‘ তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার/ জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার। ‘ সে আমাকে দিয়েছিল এমন ভালোবাসা যা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত অন্য কোন জগতে। তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত গভীর আবেশে, আমাকে দূরে রাখত জাগতিক সব চিন্তা-ক্লেশ থেকে। কিন্তু তবুও সব তো আর মানুষের পরিকল্পনামাফিক হয়না। কিছু স্মৃতি সারাজীবনের মতো হৃদয়ে দাগ রেখে যায়।
‘কী বাবু, অমন উদাস হয়ে কী ভাবছেন? ‘ চাকর রঘুর কথায় আমার সম্বিত ফিরল। বিশ বছর আগের সেই স্মৃতি থেকে যেন এইমাত্র ভ্রমণ করে বর্তমানে ফিরলাম। তবুও সেই পাহাড় ঘেরা বন, সেই বুনো গোলাপ, খরস্রোতা নদীর সেই কালো জল, মনীষার সেই মায়াভরা ছলছল চোখ- সবকিছুই এখনো ফিরে আসে আমার স্মৃতিতে, আমার আর মনীষার অপূর্ণ প্রেমস্মৃতির সাক্ষী হয়ে।
One thought on “সেইসব বিকেলের গল্প”
অসাধারন।