অজ্ঞাত ব্যথা
আরমান হোসাইন অন্তর।।
ডেন্টাল বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল। দরজার ফাঁক গলে উঁকি দিতেই সহকারী মহিলা ডেকে সিরিয়াল লিখে দিলেন। আমি নিশ্চুপ দু’হাতে নাক–মুখ চেপে ধরে আছি।এবার একহাতে সিরিয়ালের কাগজ অন্য হাতে তেমনি চোয়াল শক্ত করে টিপে অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে আছি। সিরিয়াল লেখক ভদ্রমহিলা আমার অতিশয় দুর্দশা দেখে হাতের কাগজটা ডেকে নিলেন। দেখে বললেন, “যান.. এইডা ৩ নাম্বার রুম।”ডাক্তারদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অগাধ। বেয়াদবি হয় কিনা ভেবে চুপিচুপি সাদা পর্দার আড়ালে কিছুক্ষণ বেখেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ভিতরে তাদের গল্পসল্প টের পেলেও রোগী ডাকলেন না। আমিও আড্ডায় বিরক্ত করতে চাইলাম না। একবার উঁকি দিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।
সে ভদ্রমহিলা যে এতসব খেয়াল করছে, এ আমার ধারণা ছিল না। এবার উনি বিরক্তি নিয়ে শক্ত গলায় বললেন, “যান না ক্যান.. ভিত্রে লাল চেয়ারডায় বইবেন। যান!”ব্যথার যন্ত্রনায় আমি শব্দহীন, কাতর। হু, হা কিছু বলতেও পারছি না। ফের উঁকি দিয়ে অনুমতির অপেক্ষা না করে রুমে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু একি! ডাক্তার কই? সাদা এপ্রোন পড়া এরা কারা? তিনতলার এই রুমে আলো বাতাস চলাচলের উপযুক্ত জায়গা যথেষ্ট আছে।
কেন যেন সেই ফাঁকা জানালা দিয়ে আবছা কুয়াশার মতো সামান্য আলো এসে ক্ষীণ দৃষ্টিসীমার সৃষ্টি হয়েছে। সামান্য আলোয় সাদা এপ্রোন যেন পূর্ণিমার রাতে ভরাট চাঁদের মতো উজ্জ্বল লাগছে। একে তো দুধরঙা ধবধবে ফর্সা ত্বক, সাথে সাদা পোশাক— দুইয়ে মিলে নিমিষেই সমস্ত রুম চকচকে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। অবাক আলোয় আমি তেমনি নির্বাক হয়ে রইলাম। সংখ্যায় তারা পাঁচজন। এক বেঞ্চিতে সারিবদ্ধ তিনজন গা ঘেঁষে বসা। আমার নাক–চোখ বরাবর সামনে–পেছনে বাকি দুজনের অবস্থান। বেঞ্চিতে বসা প্রথমজন হাতের কাগজটি যত্নসহকারে নিয়ে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা কবে থেকে?”এতক্ষণে যে আমি অপলক তাকিয়ে আছি তা আমার বোধশক্তির বাইরে ছিল।
তারা কি তা দেখেছে, নাকি দেখেননি সে আমার ধারণার অগোচরে। তেমনি পলকহীন তাকিয়ে বড় আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিলাম, “সকাল থেকে।”অথচ তারা ভ্রুক্ষেপ করলো না। এতক্ষণে প্রেসক্রিপশনের কাগজ হাত ঘুরে অন্য হাতে চলে গেছে। সে কি যেন মনোযোগের সাথে লিখছে। আমি ভাবলেশহীন তাকিয়েই আছি!অন্যজন প্রেসক্রিপশন হাতে জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা কোন পাশে?”আমি চেতনাহীন উত্তর দিলাম, “বাম পাশে, নিচে..”এবার সোজাসুজি যিনি বসে আছেন।
তার পেছনের জন। বয়সে বোধহয় তিনিই আমার পাশাপাশি কিছু হবেন। চোখে চশমা। সুন্দরীদের এই এক সমস্যা। তারা বেশিরভাগ চোখে চশমা পড়ে। ত্বকের সৌন্দর্য যেন চশমায় পূর্ণতা পায়। এযাবতকাল এই চশমার দিকেই তাকিয়ে দেখছিলাম। যদিও চশমার ফ্রেম সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখি না। তবুও, ওই চশমায় জীবন বাজি রাখা যায়..তিনি কিছুকাল বোধহয় আমার দিকেই দেখলেন। আমি ভয়ে, লজ্জায় অসার হতে চললাম।
কেন এসেছি এখানে, কোথায় কখন কিসের ব্যথা— সব ভুলে পারলে ছুটে পালাই! ততক্ষণে সে ডাক্তারনি আমার মুখোমুখি! আচমকা আতংকিত আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। হঠাৎ সেই গল্পের শব্দ নিবে গেলো। পৃথিবীতে যেন কেউ থাকে না। কেবল এই ডাক্তার আর আমি ছাড়া!ডাক্তার সাহেবা কি এক যন্ত্র নিয়ে বড্ড স্নেহময় কণ্ঠে বললেন, “দেখি কোথায় আপনার ব্যথা?”তার ব্যথার জিজ্ঞাসায় সত্যই আমার ব্যথা দ্বিগুণ হয়ে উঠলো! তবু চোখ খুলি না। চোখ খুললেই যদি ব্যথারা চলে যায়? গল্পের শব্দের মতো ডাক্তারও যদি উধাও হয়? তবে যে চিরন্তন এ ব্যথাতেই আমার সজ্জা হবে!
এসকল ভাবনায় আমি ভয়ে সংকুচিত হতে হতে জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। ব্যথার কথা বেজায় ভুলে গেলাম। এরইমধ্যে আরেকটু কাছাকাছি চলে এসেছেন এলিয়েন ডাক্তার। হয়তো খানিক উৎসাহ নিয়ে সে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “দেখি, হা করেন..”আমি অসামাজিক ভাবে হা করে চোখ খুলে ফেললাম। এবার হা করতে বলায় আমি লজ্জায় চোয়াল শক্ত করে বসলাম। চোয়ালের নিকটবর্তী হয়ে তির্যক দৃষ্টিতে আমায় দেখলেন। এবার আমিও কিছু শক্তি সঞ্চয় করে আড়চোখে দৃষ্টি কেবল তার চোখে রাখলাম অমনি সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেলো! বিনা মেঘে বজ্রপাত যেমন দুনিয়া আন্দোলিত করে, তেমনি আচমকাই অসম্ভব কোন শক্তি আমার সামর্থ্য রোধ করলো!বুকে হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরতে পরতে বললাম, “বুকে.. বুকে ব্যথা আমার!”
২ comments
কিছু শব্দ মিসিং 😑
শেষটা অসাধারণ।