বিজ্ঞাপনের ‘জেন্ডার রিভিউ’ এবং কিছু পেটি-বুর্জোয়া আলাপন!!
ফাইয়াজ ইফতি ।।
ফিফথ সেমিস্টারের ‘জেন্ডার এন্ড মিডিয়া’ কোর্সে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের জেন্ডারড্ রিভিউ করতে হয়েছিলো।
ডায়াসে দাঁড়িয়ে – কোন বিজ্ঞাপনটা সেক্সিস্ট, কোনটা ডাবল মিনিং কথাবার্তা বলছে, কোনটায় জেন্ডার সেনসিটিভিটি নেই ইত্যাদি নিয়ে চার পাঁচ মিনিট জ্ঞানগর্ভ বুলি কপচিয়ে; নিজ নিজ গড় একটা মার্ক হাত করে বসে থাকা টাইপ ব্যাপার স্যাপার আরকি।
তখন হয়তো জোশে জোশে সবই প্রবলেমেটিক মনে হয়েছিলো, তারপর ক’দিন পরে ভেবে দেখলাম – দুই চারটা ব্যাতিক্রম বাদ দিলে বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনই আসলে নির্দোষ।
বিজ্ঞাপনগুলা তো আসলে দিনশেষে একটা শিল্প মাধ্যম, আর শিল্প মানেই হলো আয়না। বিজ্ঞাপন যা দেখাচ্ছে তা আমি-আপনি, আমাদের সমাজের চিত্র ছাড়া আর কিচ্ছু না।
আপনার মুখে ফোঁড়া উঠলে আপনি আয়নারে দোষ দিতে পারেন না, আয়না ঐটা দেখাবেই, সেটাই তার ফাংশন! ধরেন প্রত্যেক পুরুষের ওয়াইল্ডেস্ট ফ্যান্টাসি থাকে, “যেই মেয়ে সামনে আসবে সেই মেয়েই নিমিষে পটে যাবে” – টাইপ। তাই বিভিন্ন ডিয়োডরেন্ট আর সেন্টগুলো যে তাদের বিজ্ঞাপনে দেখাচ্ছে একটা সেন্ট মাখার সাথে সাথে মেয়েরা এসে, “হাই হ্যান্ডসাম, হাই হ্যান্ডসাম” – বলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, সেটা অবাস্তব মনে হলেও আমাদের বাইরের কিছু নয়। আপনি এটাকে অবাস্তব বলতে পারেন কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক কখনোই নয়। এটাকে প্রবলেমেটিক মনে হওয়ার মানে প্রবলেমটা বিজ্ঞাপন নয়, প্রবেলমটা ভোক্তাদের মাথার ভেতরে ঘুরা ফ্যান্টাসির!
পৃথিবীর সবচাইতে বোকাচন্দ্র ব্যাক্তিটাও এটা বিশ্বাস করবে না – “একটা ডিও লাগানোয় হাজার হাজার মেয়ে পটে যাবে,” অথচ এই টাইপ বিজ্ঞাপন বানানোয় কিন্তু ঠিকই ডিও-র বিক্রি বেড়ে যায়। কারণ স্বীকার করুক বা অস্বীকার, ভোক্তা নিজের ফ্যান্টাসিটুকুই বিজ্ঞাপন খুঁজে পায় আসলে।
ফেয়ার এন্ড লাভলীর কেইসটাই ধরেন, ওদের এত এত সমালোচনা কেন হলো কয়েকদিন আগে? ওরা ‘লাভলী’ মানেই ‘ফেয়ার’ হতে হবে এমন স্টেরিওটাইপ প্রমোট করছে, ক্রীম মেখে চাকুরী পেয়ে যাওয়ার মত অবাস্তব জিনিস দেখাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আপনাকে আমাকে যদি বলা হয় বুকে হাত রেখে বলুন – আপনি মনে মনে স্বপ্ন দেখেন একটা কুচকুচে কালো মেয়ে আপনার জীবনে আসবে…আপনি বলতে পারবেন? নাকি আমি বলতে পারবো?
শেষ কবে একটা শ্যামলা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন বলুন তো? দুই চারটা দক্ষিণ ভারতীয় নায়িকা আর হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের কাজল চোখের শ্যামলা মেয়ে ছাড়া আদৌ জীবনে আপনার চোখ ফর্সা রঙের বাইরে আর কাউকে খুঁজেছে? সারাদিন দুধে আলতা নায়িকা-মডেলদের উপরে ক্রাশ খাবেন আবার বিজ্ঞাপন খুলে ফেয়ার এন্ড লাভলী শব্দটাতেও খুঁত ধরবেন, দুটো তো একসাথে হয় না বাডি! সমস্যা তো আমার আপনার মাইন্ডসেটের।
আমরা কথায় কথায় বলতে পারবো, “আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী,” আর সেই সেইম মটো ফলো করে ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রীম মাখিয়ে ফর্সা করে; মেয়েকে চাকুরী পাইয়ে দিচ্ছে জিনিসটা আমাদের কাছে অবাস্তব মনে হবে কেন?
সবকিছু বাদ দিয়েও এটা বলেন, ফেয়ার এন্ড লাভলী নাম বদলিয়ে ‘গ্লো এন্ড লাভলী’ হয়ে গেছে, তাতে কার কি আসলো গেলো?
একজন, স্রেফ একপীস পাবলিক এমন দেখান তো – যারা গ্লো এন্ড লাভলী কিনতে গিয়ে ভাবছে এটা মেখে রোদে বের হলে খোমা-টা ভিন ডিজেলের চান্দির মত চকচক করবে(!)? যারা কিনছে তারা ফর্সা হওয়ার আশায়-ই তো কিনছে, নাকি? তাহলে বিজ্ঞাপন কি দোষটা করলো?
আমার আপনার এক্সপেকটেশন থাকবে নারী রান্নাঘরে কাজ করবে, একা হাতে ঘর বাহির দুইটাই সামলাবে, সুপার ওম্যান টাইপ আচরণ করবে, বিজ্ঞাপন আমার আপনার এক্সপেকটেশনটুকুই পর্দায় দেখালেই সেক্সিস্ট, ইনসেনসিটিভ? সমস্যা টা কখনোই বিজ্ঞাপনের নয়, সমস্যাটা আমার আপনার ভিতরেই ‘ইন বিল্ট’। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় বিজ্ঞাপনগুলোকে বরং ধন্যবাদ দেয়া উচিত ! আমাকে আপনাকে এত নগ্নভাবে আর কয়টা জিনিস উপস্থাপন করতে পেরেছে বলুন তো?
সবার শেষে যেটা বলতে চাই, যারা বিজ্ঞাপনের সেনসিটিভিটি নিয়ে খুব প্রতিবাদ-টতিবাদ করেন তারা হয়তো জানেন না, এসবে কোম্পানিগুলোর আসলে কিচ্ছু যায় আসে না। আলোচনা সমালোচনার প্রথমদিকে ওরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থেকে স্রোতটা বাড়তে দিবে, কারণ নেগেটিভ মার্কেটিংও দিনশেষে মার্কেটিং পলিসি-ই! তারপর একটা শুকনো দুঃখপ্রকাশ এবং বিজ্ঞাপন অপসারণের মধ্য দিয়ে – “খেল খতম, পয়সা হজম!”
এখন যে নানান বিজ্ঞাপনে দেখেন পুরুষকেও অকেশনালি রান্নাঘরে দেখাচ্ছে এই জিনিসটা আসলে আপনাদের বিজয় না। এখন এই ‘মাগ্যির’ বাজারে স্বামী স্ত্রী দুজনকেই কাজ করতে হয় পেট চালানোর জন্য। তাই দিনশেষে বাধ্য হয়েই পুরুষকেও অকেশনালি টুকটাক রান্নাঘরে ঢুকতেই হয়, বিজ্ঞাপন সেটাই দেখাচ্ছে।
বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য সেনসিটিভিটি প্রচার কখনোই নয়, বরং আয়নার মত করে আমাদের নিজেদেরকে দেখানো, কারণ বিজ্ঞাপনে নিজেকে খুঁজে না পাওয়ার আগে পর্যন্ত নিজের মাঝে ঐ পণ্য কেনার চাহিদা তৈরি হওয়া সম্ভব না। তাই বিজ্ঞাপনের নয়, পরিবর্তন কিছুতে আনতে হলে সেটা আমাদের নিজেদের ভেতরেই সবার আগে আনা দরকার।