সাদা পাতায় জীবনরেখা
সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।
স্কুল যাওয়ার অভ্যাস গ্রামে থাকতেই হয়েছিলো।
কেতুগ্রামের মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন, এটা কি? আমি বললাম অ য়ে অজগর আসছে ধেয়ে।
আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন, এটা কি?
আমি ভাবলাম, আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন, এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।
ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গি ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি,আর,জি,আর, খেমকা হাই স্কুলে ভরতি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।
এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।
মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।
গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।
আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভরতি র পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন, বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে।
আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভরতি হয়ে গেলাম।
সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার। নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে। আমার টোনা মাসিকে টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন। কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে। সাবধান খুনীর দল, একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা। ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ। শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি। নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়।
শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।
মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও
তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে। সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। । শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়। বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে। কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু লোক ব্যাঙ্গের সুরে বলে, বুড়ো ঢ্যামনার ভিমরতি হয়েচে। সখ দেখো এখনও রঙীন জামা পড়ে। ব্যায়াম করে। মেয়েদের সঙ্গে কতা বলে।
একটু হাসি ঠাট্টা করলে বলবে, মিনসে, ঘাটের মরা এখনও দুধ তোলা রোগ গেলো না।
সব স্বপ্ন দেখা বন্ধ রেখে বুড়ো সেজে থাকলেই সম্মান পাওয়া যায় বেশি। নিজের মনে গুমরেওঠে যত স্মৃতি। শেয়ার করার কেউ নেই। তারপর মরে যাওয়ার পড়ে অন্তিম কাজ, নির্লজ্জ ভুরিভোজ।
তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক।
আমার দুই বোন। তিন ভাইঝি। বোনেদের নাম রত্না স্বপ্না। রত্না হলো কন্যারত্ন। সব অভাব অভিযোগ তার কাছে এসে থমকে পড়ে অনায়াসে। আর অপরের উপকার করতে স্বপ্নার তুলনা মেলা ভার। ভাইঝিরা তানুশ্রী, দেবশ্রী,জয়শ্রী। এরা বড়দার মেয়ে আর মেজদার মেয়ে পৃথা, ছেলে ইন্দ্র। এরা সকলেই আমার খুব প্রিয়। বাবুর মেয়ে তিন্নি আমার ছেলে সৈকত।
রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই। কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যায়
অচেনা বলয়, মাকড়সার জালের মতো জটিল। সবাই এত অচেনা অজানা রহস্য ময়। বুকটা ধকধক করছে, হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে, চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো। এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা। আর আমি একা নই, কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়…
আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ, ডিম, মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া, সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল, ডাল, মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল, ডাল, গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা, মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর, গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো। আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো। একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো।
আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা, হোবলো, ক্যাবলা, লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম, বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন, ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটো।
বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন, আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো, আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম। সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাংগীত শোনাতো।
সম্পর্কে দাদু হলেই তো আর বুড়ো হয়ে যায় না। দাদুর যখন চল্লিশ বছরের তখন মায়ের বিয়ে হয়েছিলো। দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা, বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক। গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস, আই মিনে আয়। সুদপে,রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো। আবার কোনো মাসি বলতেন, আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা, জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিমধ্যে গীতু, মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে। আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।
তারপর সংসারের টানা পোড়েন। রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম, দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন, জানি না ভাই। তবে।। মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়, তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো, তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন, মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই, দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।
অনেক বছর অপেক্ষা করেছি, দাদুর কথা শুনবো ওপাড় থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত।
আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশিদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন।
তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি,খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে।
আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি।
ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে।
বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায়। দুঃখ শেষে আনন্দ । আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসা র নামই জীবন। নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল। তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর। সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয়। তারা যে মায়ের, মাসির আদরের আঁচল। তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয় ।
যতবার আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে। ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে। রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে। জীবনে জ্বর হয় বারে বারে । সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে। বারে বারে জীবনযুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসা র আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী। আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারীরূপী দেবির রক্ষাকবচ। সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী। তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জাভূষণ। পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন। তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন। তারা অবশ্যই প্রণম্য। তাদের জীবন সার্থক। এই পৃথিবী সকলের স্বাধীন ভাবে বিচরণের স্থান হোক। হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক দুর্বল মানসি।
আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি। যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ, দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশু বলতো, দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি । ভেজে খাওয়া যাবে।
বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে। তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে।
একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না।
আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।
আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি?
বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়।
বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে?
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে।
ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলেুু উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।
বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।
তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মাল পত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।
আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গিরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে।
তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।
বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের,শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পরলে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন, বিশু, আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা, গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানে আর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম,
তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী।
, খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো।
বেলে, তে চোখো, চ্যাঙ, ছিঙুরি, গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে।
পাঁকাল, গুঁতে, কৈ, মাগুর, ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে।
বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণ যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার মা বলতেন,ছোটো থাকাই ভালো রে, সংসার অসার। মা বলতেন,
এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছি
মরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ…
স্বজন বন্ধুরা বলবে. আর কত সময় লাগবে শেষ হতে…একটু দ্রুত করো ভাই…
তবে কিসের এত অহংকার…
কেন এত লোভ … ভালোবাসায় কৃপণতা
কে ধনী… টাকায় চিতা সাজালেও পরিণতি একই…
কৃষ্ণধনে ধনী যেজন
নিজ ধামে ফেরে সেজন…
লক্ষ্মীপুজো এলেই মা বলতেন কোজাগরির অর্থ।
তিনি বলতেন, কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মা আমাদের নিয়ে, কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রি পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রি পুজো, শিবলুনের মেলা, উদ্ধারণেরপুরের মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন।
পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নিচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা, রুনু, শংকরী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্,গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।
পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনে আছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।
বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যার ইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দেকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী।
কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত, ভব, ভম্বল, বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল, শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দু’হাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।
শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউ এলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছে উঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো না, ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না। সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়।
আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো। পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি। হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ। পায়ে হেঁটে। গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কয়ার। জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর। বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরী কে। তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো। অমিত রান্না করতো খুব ভালো। পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম । ও শেফ হতে চেয়েছিলো। অনিন্দিতা বলে বান্ধবী টা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু সব স্বপ্ন গুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো ।
অই বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে । রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে । অসীম গান করে, বিচ্ছু একতারা বাজায়। অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে। হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..
ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে। এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে। ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে। হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা। কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি। এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে। রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে। ভালো থেকো বাল্য অনুভব। চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ ।
আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু। দু’দিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে। রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি, শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু। চেনা আত্মীয় র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা । হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া, বেনেপুকুর। ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া ,পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা। এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে। তারপর ষষ্টিতলা, মঙ্গল চন্ডীর উঠোন, দুর্গা তলার নাটমন্দির। এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা। গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা। এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না।কেঁয়াপুকুর, কেষ্টপুকুরের পাড়। তারপর বাজারে পাড়া, শিব তলা ,পেরিয়ে নাপিত পাড়া। এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে। সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা, তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা। কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা। এখন সব কিছুই যান্ত্রিক। মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয়। মুখে হাসি নেই। বেশ জেঠু জেঠু ভাব। সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি। আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া, কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া। সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা, কলা বাগান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই । পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই। শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ ।
এই গ্রামে ই আমার সবকিছু , আমার ভালোবাসা, আমার গান।
ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো । পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় । বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল ।
তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে । কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না। তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী, ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না। শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না। পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই। জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন। মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে। আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত, ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ, ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে ।
এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন । তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে…