সৌমিত্র চৌধুরী

খোলস

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

সৌমিত্র চৌধুরী,
কলকাতা, ভারত।

 

গোলাপি সাইড ব্যাগ হাতড়ে চাবির গোছা বের করলো পারমিতা। ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। কালো চামড়া দেওয়া গোল রিং-এ সাত-আটটা ছোটবড় চাবি। সবচেয়ে বড় চাবি জোরার সাথে মানানসই দুটো ঢাউস তালা। বাইরের বড় গ্রিল-গেটে নিখুঁত বৃত্ত এঁকে ঝুলছে। ভিতরের ছোট গেটে একটা মজবুত বিদেশি তালা। বাড়ির নক্সা কাটা সেগুন কাঠের দরজার ল্যাচে দুটো। শোবার ঘর আর ছাতের দরজায় একটা করে তালা।

গেটের তালা গুলোর দিকে পলক তাকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল অনিরুদ্ধ। অক্ষত তালা যথাস্থানে অনি-পারমিতার জিম্মায় থাকা সম্পূর্ণ একতলা বাড়িটা তাহলে তালা চাবির ভরসায় সুরক্ষিত।

ভবিষ্যতে বাড়িটা হয়ত একতলা থাকবে না। অনির ভাই অমিতাভ কলকাতায় বদলী হয়ে এলে একতলার উপর আরেকটা ছাদ তুলবে। তখন বাড়ির দেখভাল চলবে যৌথ প্রচেষ্টায়। বাবা-মার সাক্ষাতে তেমনি কথা হয়েছিল। অমিতাভ সপরিবারে যতদিন না-আসছে, কথা মতো পারমিতা-অনির জিম্মায় আছে গোটা বাড়ি।

দ্রুত কব্জি ঘুরিয়ে বড় গেটের তালা খুলে ফেলল অনি। রাস্তার ভ্যানরিক্সায় সব্জিয়ালার কাছ থেকে চটপট একটু আলু আর একটা ফুলকপি কিনে নিল পারমিতা। সাইকেলে ছুটন্ত দুধওয়ালার কাছ থেকে দুধের প্যাকেট। অনির পেছন পেছন সদ্য কেনা পন্য আর ভারি ট্র্যাভেল-ব্যাগ হাতে গুটি গুটি এগোল পারমিতা। দুটো ছোট কিট ব্যাগ হাতে বিল্টু, তার পেছনে খালি হাতে চোখ কুঁচকে মেঘা।



ছোট গেটের চাবির শেষ তিনটে নম্বর সাত। ওই চাবিটা সনাক্ত করে তালায় দুবার চাপ দিতে দিতে অনিরুদ্ধ বলল ‘একটু নারকেল তেল দিয়ে রেখো।’  পারমিতা ‘হুঁ’ বলে গলা তুললো, ‘তাড়াতাড়ি কর, তোমার বাথরুম যাওয়া দরকার বলছিলে।’

মাথা নেড়ে এক ঝটকায় পর্দা সরিয়ে ঘরের দরজায় ডবল হ্যাচ বোল্টের দুটো দামি তালা খুলল অনি। দরজার পাল্লা একটু ফাঁক করতেই পরিস্কার পাথুরে মেঝেয় কৃপণ আলো চুইয়ে পড়লো। কিছু একটা ঠাওর করে ‘বাপরে’ বলে লাফিয়ে দরজা বাইরে থেকে টেনে ধরল অনি। মুহূর্তে ঘামে ভিজে উঠলো গোটা শরীর। শিরদাঁড়ায় শিহরণ।

বিল্টু তার বাবাকে সরিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল ঘরে। পারমিতা ছেলেকে টেনে ধরল। মেঘা ফুঁপিয়ে কাঁদছে তখন, ‘আমাদের সব কিছু কি চুরি হয়ে গেছে?’ বিজ্ঞের মত বিল্টু মাথা নাড়াল, ‘চুরি হলে তো তালাগুলো ভাঙা দেখতিস।’

গ্রিল বারান্দায় উঠে এসে অনির হাত ধরল পারমিতা। বলল, ‘এত ঘামছ কেন? বাথরুমের জানালা ভেঙে সব চুরি হয়ে গেল নাকি!’

নিরুত্তর অনি। ডাইনে-বাঁয়ে মাথা দোলাল। ওর বিস্ফারিত চোখ। শীতের সকালে ঘামে জবজবে শরীর। ভয়ার্ত অনির দিকে তাকিয়ে গলা কেঁপে উঠলো পারমিতার, ‘বাঘ ভাল্লুক ভূত টুত দেখলে নাকি?’

উত্তর নেই অনির মুখে। দরজায় পিতলের বড় ল্যাচটা টেনে বারান্দার গ্রিল ধরে তখন কাঁপছে অনি। পারমিতার বুকে আশঙ্কায় ঢিব ঢিব। অনি কী জিনিষ দেখলো ঘরে? সাহসী মানুষটার গলা শুকিয়ে কাঠ! হাজার কিলোমিটার ডিঙিয়ে বাড়ি ঢুকতে পা কাঁপছে!

বিপদ আন্দাজ করে অনির হাত শক্ত করে চেপে ধরল পারমিতা। এত সুন্দর একটা সফল ভ্রমণের রেশ কাটতে না-কাটতেই বিপদ! সকলের সাধ আহ্লাদ মিটিয়ে বেড়ানোর ঝক্কি সামাল দিয়ে হঠাৎ কোন্ ঝামেলায় ফাঁসল অনি?

আগেও দুবার অফিস থেকে এলটিসি নিয়েছিল অনিরুদ্ধ। লিভ ট্র্যাভেল কনসেসন। চার বছর অন্তর দেশের যে কোন প্রান্তে বেড়াবার সুযোগ। ষোল বছরের চাকরি জীবনে প্রথমবার শিলং আর দ্বিতীয় বার গোয়া ঘুরে এসেছে। দু-বছরের বিল্টুকে কোলে নিয়ে বৃষ্টিতে মাথা ঢেকে চেরাপুঞ্জি দেখতে হয়েছিল। গোয়া বেড়াবার সময় বিল্টুর ছ-বছর আর মেঘার দুই। পরের টার্মে আর বেড়ানো হয়নি। দু-বছরের ব্যবধানে বাবা-মার মৃত্যু। সুস্থ্য বাবা পার্কে হেঁটে এসে ধপ করে সোফায় বসে বললেন, ‘মাথা ঘুরছে’। তারপর হাত-পা এলিয়ে একেবারে অবশ। সনাতন মুখার্জিকে তড়িঘড়ি নার্সিং হোমে নিয়ে যেতেই ডাক্তার পালস ছুঁয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন, ‘ব্রট ডেড। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’। বছর ঘুরতেই মাতৃবিয়োগ। ডায়াবেটিসে কিডনি কমজোর হয়ে পড়েছিল। দ্রুত শরীর ভাঙতে লাগলো। নার্সিংহোমের ঠাণ্ডা ঘরে ইনটেনসিভ কেয়ারে ক-দিন ধরে ডায়ালিসিস চললো। কিন্তু শেষমেশ মাকে বাঁচাতে পারলনা অনি।



পর পর বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে সংসারটা এখন সুস্থির। বিল্টুর ক্লাস সেভেন, পড়াশোনায় তুখোড়। মেঘার বয়স দশ, সুরেলা গলা। তবে গানের চেয়ে বেশী উৎসাহ নাচে। আর যখন তখন বেড়াতে যাবার আবদার। মাঝে মাঝে বলে ‘বাবা এবার শীতে দক্ষিণ ভারত চলো। মা বলেছে ওখানে পাহাড় সমুদ্র নাচ গান মন্দির সব দেখতে পাবো’। ক’বছর বাইরে না-গিয়ে পারমিতারও হাঁফ ধরে গেছিল। মাঝে মাঝে বলতো, ‘পাহাড় জঙ্গল সমুদ্র, যা’হোক কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি।’

বেড়ানোর প্ল্যান আগাম ছোঁকে নিয়েছিল অনিরুদ্ধ। শীত আসবার অনেক আগে আগস্টের ভ্যাপসা গরমে ক্যালেন্ডার মিলিয়ে পাকা পরিকল্পনা।

পারমিতা চাইলেও ট্যুর অপারেটরদের সাথে ঘুরতে পছন্দ করে না অনি। পারমিতাকে সাহস জুগিয়ে বলে ‘নিজেরা স্বাধীন ভাবে ঘুরবো। তোমার ভয়ের কিছু নেই। কোলকাতায় বসে মাদ্রাজ ব্যাঙ্গালুরুতে ঘর বুকিং আজকাল জল-ভাত।’

ই-মেলে যোগাযোগ করে বহু জায়গায় অনলাইন বুকিং করেছিল অনিরুদ্ধ। অবশ্য অনেক জায়গায় সেই সাবেকী কায়দায় ব্যাঙ্ক মারফত টাকা পাঠাতে হয়েছিল।

পরিকল্পনাটা সময় হাতে নিয়ে ঠিকঠাক ছকা হয়েছিল। তাই এবারের ভ্রমণ খুব সফল। আনন্দ উপচে পড়েছে সবার মুখে। মীনাক্ষী মন্দির দেখে মেঘা একেবারে পাগল। মাদুরাই ছেড়ে কোদাই ক্যানেল যাবার সময় কান্না জুড়ে দিল। কন্যাকুমারীতে ছোট স্টিমারে দুলতে দুলতে বিবেকানন্দ রকে যাওয়া বিল্টুর খুব পছন্দ হয়েছে। সন্ধ্যাবেলার বৃন্দাবন গার্ডেন দেখে পারমিতার তাক লেগে গেছিল। বিশাল পার্ক জুড়ে রকমারি জলের ধারা। গানের তালে তালে নাচছে রঙিন ফোয়ারা। অনিরও অপূর্ব লেগেছে তবে মুগ্ধ হয়ে দেখেছে সমুদ্রের ধার ঘেঁসে মাদ্রাজ-পন্ডিচেরির মসৃণ রাজপথ। ভালো লাগেনি চেন্নায়ের স্নেক পার্ক।

কিলবিলে সাপ দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে। বিল্টু মেঘা পারমিতা চোখ বড় বড় করে দেখেছে সাপের বিষ সংগ্রহ। কেমন করে গোখরো সাপের মুখ ফাঁক করে বিষ দাঁতে অবলীলায় চাপ দিচ্ছে কিছু বাগান কর্মী। একজন পর্যটক বনকর্মীদের হাত থেকে চেয়ে নিল সবুজ উজ্জ্বল একটা লাউডগা। তারপর কাচের মত স্বচ্ছ সরু সাপটার মুখে পটাপট চুমু খেল। একটু পরে সাপের চোখের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলছে, ‘আই লাভ ইউ, সো আই ফিয়ার নট। ফিয়ার ইস ফলস এভিডেন্স অ্যাপিয়ারিং রিয়াল।’

ওদিকে তাকিয়ে ভয়ে ঘৃণায় অনি রুমালে চোখ ঢাকল। বিল্টুর দু-চোখ গোল, স্বরে উত্তেজনা ‘মা লোকটার কী সাহস!’

মেঘা ফিসফিস করল, ‘কি বলছে মা লোকটা?’ বিস্ফারিত চোখে পারমিতার ধীর জবাব, ‘ভদ্রলোক বলছেন, তোমাকে ভালবাসি তাই ভয় পাই না। মিথ্যেকে সত্যি ভেবে মানুষ তোমাকে ভয় খায়।’

পনেরটা দিন চোখের পলক ফেলতে না-ফেলতে কেটে গেল। ছেলে-মেয়ের স্কুল খুলে যাবে। তাই নির্দিষ্ট শনিবারে পরিকল্পনা মাফিক করমন্ডল এক্সপ্রেসের সংরক্ষিত কামরায় উঠতে হ’ল। সফল একটা ভ্রমণপর্ব সমাধা করে অনির ভিতরটাও ডগমগ করছিল খুশিতে। কম্বল মুড়ি দিয়ে এক ঘুমে রাত কাবার। ট্রেন যখন হাওড়া ঢুকল, ঘড়ির কাঁটা তখন উপর নিচে একদম সরল রেখা। সকাল ছটার ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দামি স্নিকার পায়ে হনহনিয়ে হাঁটছে অনি। বিল্টু এক ছুটে ট্যাক্সির লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। সামান্য তফাতে অনি। নির্মেদ ঋজু শরীর। ফুল হাতা আকাশী নীল জামার উপর বুক খোলা হাফ সোয়েটার। ফুরফুরে মেজাজে দিনের কাগজটায় দ্রুত চোখ বোলাচ্ছিল অনি।



প্রথম পাতা জুড়ে রাজনীতির খবর। বড় জমায়েতে ভাষণ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। ক’মাস পর বিধানসভার ভোট। সল্টলেক সহ গোটা কলকাতায় এদল-ওদলে মারপিট চলছে। দলের লোকও একে অন্যের লাস ফেলছে। সংবাদদাতা মন্তব্য করছেন – ভয়ের জামানা চলছে রাজ্যে। দ্বিতীয় পাতায় বিদেশের সংবাদ। বালি দ্বীপের পাঁচতারা হোটেলে উগ্রপন্থী হানায় এক ডজন ট্যুরিস্টের মৃত্যু। তৃতীয় পাতায় ছবি সহ ছাপা বিস্তারিত খবর। বিধবা মহিলার বাড়ি কব্জা করতে কেষ্টপুরে দু-দল প্রমোটার চার ঘন্টা গুলির লড়াই চালিয়েছে। পরের পাতার অনেকটা সুন্দরবনে সাপের উপদ্রব নিয়ে।

কালচে সাপের কামড়ে শীতেও পটাপট লোক মরছে। কালচের কামড় নাকি গোখরোর ছোবলের চাইতে মারাত্মক। ঘরের কোণে বিছানা বালিশে ঘাপটি মেরে থাকে। কামড়ালে সামান্য জ্বালা তারপর বেহুঁশ হয়ে হাসপাতালে পৌঁছাতেই মৃত্যু। চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অ্যান্টিভেনমের নাকি খুব আকাল। পঞ্চম পাতায় বিধান নগরের বিএল ব্লকে তিনতলা খালি বাড়িতে চুরির বিস্তারিত বিবরণ।

বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো অনির। পাশের ব্লকেই তো তাদের বাড়ি। চুরি হয়নি তো? অবশ্য ছোট একতলা বাড়ি কি চোরদের পছন্দ হবে! পছন্দ হবেনা জেনেও কোন ঝুঁকি নেয় নি অনি। পাড়াতেই থানা। বড়বাবু জনার্দন কর্মকার একটু বেশী বক বক করলেও ভালো মানুষ। মায়ের শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ পেয়ে ফুল মিষ্টি হাতে বাড়ি এসেছিলেন। জনার্দন কর্মকারের হাতে বাড়িতে নজরদারির লিখিত দরখাস্ত জমা দিয়ে কলকাতা ছেড়েছিল অনিরা।

পারমিতার ডাকে ঘোর চ্যুত অনি ঘাড় উঁচু করে সামনে তাকাল। ট্যাক্সির লাইন এগিয়ে গেছে অনেকটা। বিল্টু কাউন্টারের কাছে পৌঁছাতেই খবরের কাগজ ভাঁজ করে চটপট ব্যাগে পুড়ল অনি। কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে নীল-সাদা ঝকঝকে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল। হাসিখুসি হিন্দিভাষী সুদর্শন ড্রাইভার। প্যাকেট ভর্তি পানপরাগ পুরোটা মুখে ঢেলে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল।        তখন কলকাতা জেগে উঠেছে। রাস্তায় লরি ট্যাক্সি ছোটা-হাতি ভ্যান রিক্সার ভিড়। ‘জলদি চালাও ভাই, টয়লেট লাগ গিয়া’ বলতেই বিবেকানন্দ রোডের ফ্লাইওভারের তলা দিয়ে ঢাউস পিলারগুলো ডাইনে বাঁয়ে কাটিয়ে ট্যাক্সি সাঁই সাঁই ছুট লাগলো। হাওড়া থেকে সল্টলেকের শেষ মাথায় এএল ব্লকে ঢুকল পঞ্চাশ মিনিটে।

এতক্ষন ঘরে ঢুকে হাত-পা ধুয়ে বাইরের পোশাক পাল্টে চায়ের জল চাপাবার কথা। কিন্তু গোটা পরিবার ঘরের বাইরে। ওড়নায় মুখ মুছে অনির দিকে বিস্ফারিত ডাগর চোখ মেলল পারমিতা। ভয়ার্ত স্বর। গলা খাদে, ‘কি দেখলে বল!’



তুতলে যাচ্ছে অনির কথা, ‘সা সা সা-প।’

‘বাপরে!’ ছোঁয়াচে রোগের মত অনির কাঁপুনি পারমিতাতেও ছড়িয়ে পড়ল।

ফর্সা গাল মুহূর্তে লাল। সুষুম্না কাণ্ড জুড়ে ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত। পারমিতার মুখ, কপালের দু-পাশে বিজবিজে ঘাম। পিঠে চেপ্টে গেল বাসন্তি সালোয়ার। মেরুদণ্ডের ঢাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে নামছে স্বেদ। হাঁটুতে কাঁপন। নিক্তি মাপা ছিপছিপে শরীরে দ্রুত লয়ে চলছে শ্বাস। গায়ের চাদরটা গ্রিলে গুঁজে ওড়নাটা কোমরে গিঁট দিয়ে পেঁচিয়ে নিল। ঢোঁক গিলে জিভ দিয়ে দু’ঠোঁট চাটল। বিপদের গন্ধ পাওয়া সজারুর কাঁটার মত সব কটা ইন্দ্রিয় সজাগ তখন।

হাঁপাচ্ছে পারমিতা। ‘দেখিতো’ বলে ল্যাচ খুলে দু-পাল্লা দরজা অল্প ফাঁক করল। ধীরে ধীরে পুরো দরজাটা খুলে অমিতের দিকে ফিরল, ‘সাদা মত জিনিষটা? ওটা তো খোলস!’

-গো গো গোখরো। খোলস থাকলে ওটাও আছে।

সন্তর্পণে খোলসের পাশ দিয়ে একপা দুপা হেঁটে পাশের ঘরে ঢুকে মেন সুইচ টিপল পারমিতা। ঘরের আলো জ্বাললো। নিশ্বাস বন্ধ করে দরজার কোণায় রাখা শ্বশুরমশায়ের বেতের মোটা লাঠিটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এল।

-খুব সাহস না! লাঠি দিয়ে গো গোখরো মারবে? ফঁসস ফঁসস আওয়াজ শুনলে সাপুড়েও ভিরমি খায়।’

নিরুত্তর পারমিতা। বাইরে ঘরের বাথরুমে দুটো আলো পটাপট জ্বালিয়ে চারদিকে তাকাল। এপাশওপাশ ঘাড় ঘুরছে দ্রুত। ত্রস্ত চাহনি। আস্তে আস্তে রান্নাঘর খাবার জায়গা হলঘরের আলো জ্বেলে জানালা গুলো এক এক করে খুলল। বিল্টু এক ছুটে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল। জুতো না-খুলে বাইরের পোশাকে বারান্দায় সু-র‍্যাকের উপর বসে মাঝে মাঝে চিৎকার করছে অনি, ‘সাবধান। পা পারমিতা, বিল্টু সা সাবধান।’

রান্নাঘরের জানালায় একটা দশাসই টিকটিকি দেখে ‘বাপরে’ বলে মাকে জড়িয়ে ধরল বিল্টু। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে একটা ঢোঁক গিলে সন্তর্পণে সিঁড়ি-ঘরের দরজা খুলল পারমিতা। সিঁড়িতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বিল্টুকে নিয়ে ছাতে উঠলো। মেঘা বাইরের বারান্দায় ওর বাবার কাছে। মাঝে মাঝে চিৎকার করছে মেঘা, ‘মা ভিতরে যাবো?’

গাছের উঁচু ডালের পেয়ারা পাড়বার একটা লগা রাখা ছিল ছাতে। ওটা হাতে নিল বিল্টু। মায়ের মত বিল্টুও বাড়িময় লাঠি ঠুকছে। বিছানা বালিশ তোষক বহুক্ষন লাঠি পেটা খেয়ে শুধু ধুলো ছড়াল। জলের পাম্পের সুইচ টিপে বারান্দায় এসে কয়েকবার উঁচুতে গলা তুললো পারমিতা, ‘বাথরুম পেয়েছে বলছিলে। এবার যাও।’

বারান্দায় একই রকম ভাবে দু-পা তুলে উসকো খুসকো চুলে ঠায় বসে অনি। ওর দিকে অবাক চোখে তাকালেন প্রতিবেশী অরুন বিশ্বাস। এএল ব্লকের কোনার বাড়িটার মালিক। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার। সকালের প্রাত্যহিক হাঁটা-আড্ডা ফেরত অনির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘কী, বেড়ানো ভালো হ’ল তো?’

প্রাপ্য জাবাব না-পেয়ে বিস্মিত অরুন বাবু আপন মনে বাড়ির পথ ধরলেন। এ অঞ্চলের পথঘাট নির্জন। বাড়ি ঘর কম। আশপাশের বাড়িগুলো, লোক থাকলেও, বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। অনিদের বাঁ-পাশে আগাছা ভর্তি একটা খালি প্লট। প্লটের দখল নিতে প্রায়ই মারপিট লাগে। ওই প্লটের ডানদিকে নিত্যানন্দ সেনের বাড়ি। স্ট্রোকে বিছানা নেবার পর বাড়ি তালাবন্ধ। সেন বাবু মেয়ের কাছে থাকেন। পুলিশের লোক বলে বোধ হয় ওঁর বাড়িতে চুরি ডাকাতি হয় নি।



বারান্দায় অনির কাছে এসে অরুনবাবুর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে গলায় ঝাঁজ ফুটাল পারমিতা, ‘ভদ্রলোক কী ভাবলেন বল তো? এসে থেকে পা গুটিয়ে বসে আছো? বাথরুমে যাও।’

বিল্টু আর মেঘা মুখ ধুয়ে চিৎকার করছে, ‘মা খেতে দাও।’

ব্যাগ থেকে দু’টো কেকের প্যাকেট বের করে ওদের হাতে ধরিয়ে আবার অনির দিকে ফিরল পারমিতা, ‘কাউকে খবর দিলে হয় না?’

অনির বিপর্যস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে চোখের জল চাপল পারমিতা। নিচের ঠোঁট কামড়ে ফুসফুস খালি করা একটা শ্বাস ফেলল। শুকনো মুখে বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে অনির মুঠোফোনটা ঘাঁটতে থাকলো পারমিতা। নির্ভরযোগ্য মানুষের খোঁজ করতে করতে জনার্দন কর্মকারের নম্বরটা পেয়ে একটু থামল ও। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে চটপট ডায়াল করল। দু-একবার ‘ব্যস্ত হ্যায়, ব্যস্ত হ্যায়’ শুনতে শুনতে ভারি গলার ‘হ্যালো’ ডাকটা কানে ঢুকল। পরিচয় প্রকাশ করে বড় বাবুকে ধন্যবাদ জানাল পারমিতা, ‘স্যার আপনাদের নজরদারির সুবাদে বাড়ি ঘর সম্পত্তি সব ঠিক আছে, তবে…!’

-তবে কি? সকাল দশটাতে আবার কি ক্যাচাল ঘটলো? আমি যাচ্ছি একটু পরে।

-স্যার, তাড়াতাড়ি আসবেন তো?’ সঙ্কোচের জড়িমা পারমিতার স্বরে।

-ভয় পাবেন না ম্যাডাম। বিকে ব্লকে জোর কেচাইন চলছে। প্রমোটার বাড়ির দখল নেবে আর বুড়ো মালিকও ছাড়বে না। একাই লড়ছে। মালিককে থানায় এনে একটু কড়কে দিয়ে আমি আসছি। নেতাদের চাপ। সবই তো বোঝেন!

কান থেকে ফোনটা নামাতেই খিঁচিয়ে উঠলো অনি, ‘পুলিশ এসে কি করবে? গোখরো একবার ফোঁস করলেই পেন্টু খুলে ভাগবে পুলিশ। তোমার জনার্দন…এক ছোবলেই অক্কা।’      একটু থেমে আবার বিড়বিড় শুরু করল অনি, ‘বিষধরের সাথে পারবে? বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বাড়ির কোথায় যে লুকিয়ে আছে! আজ চলো, কোন হো হোটেলে গিয়ে থাকি।

‘অনিরুদ্ধ বাবু, কী বিপদ হোল বলুন তো?’ রাস্তা থেকে হাঁক পেরে থানার বড়বাবু গট গট করে ঢুকলেন। বারান্দায় চেয়ার এনে দিল পারমিতা। অনির পাশে বসে বিপদের কাহিনী শুনে ফরেস্ট বিভাগে ফোন করলেন। কেজো গলায় বললেন, ‘আমি উঠছি, সাপ ধরার লোক এক্ষনি  চলে আসবে।’

স্বরে মধু ঢাললো পারমিতা, ‘স্যার, একটু বসুন। চা করছি, আপনি থাকলে একটু ভরসা পাই। আমার হাসবেন্ড তো ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। হঠাৎ কি যে হ’ল!’

-হুম, কোথায় আছে, খোলসটা দেখি একবার।



-ঘরে আসুন’, ভয়ের কাঁপন লাগা পারমিতার স্বর, ‘দরজা খুলতেই দেখি মেঝেতে ঠিক এভাবেই লম্বা ফিতের মত পড়ে আছে।’

-গ্রামের ছেলে আমি। সাপ খোপ দেখেছি অনেক। এটা চিতি সাপের খোলস। খোলস থাকলে সাপ থাকবে, এটা ফলস এভিডেন্স, বুঝলেন। চিতি সাপ লম্বা হিলহিলে, ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে খালি বাড়িতে সেঁধিয়ে যায়। কিন্তু বিষ নাই।

-তাইলে কোন ভয় নাই’, মেঘা লাফিয়ে উঠলো।

বড়বাবু একটু হাসলেন। গমগমে গলা, বিল্টু মেঘার দিকে তাকালেন, ‘ভয় পেয়োনা। সাপ ধরার লোক গোটা বাড়ি সার্চ করবে। বাগান ছাদ গাছ সব। কোথাও কিছু পেলে ঝট করে বস্তায় পুরে ফরেস্টে চালান করে দেবে। খুব সাহস ওদের, বুঝলে!’

সোফায় হেলান দিলেন জনার্দন বাবু। ছোট গোল টেবিলে ট্রে সমেত চায়ের কাপ রাখল পারমিতা। বলল, ‘এত ব্যস্ত অফিসার আপনি। তবু ফরেস্টের লোক আসা অবধি আরেকটু থাকুন।’

-টাইম নাই হাতে, বহু কাজ। ভোট আসছে, ঝারপিট লাগছে রোজ।’ চায়ে চুমুক দিলেন থানার বড়বাবু। ‘আপনার কথায় আর একটু নহে বসলাম। কিন্তু বিপদ কাটবে কি?’

-কী বিপদ স্যার?’  চিন্তিত মুখ পারমিতার।

-ভয়ের বিপদ।’ অনিরুদ্ধ বাবুর মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভয়।

ভয় পেয়ে গেল পারমিতা। বাইরের এক পলকা ঠাণ্ডা বাতাস পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকতেই সাপের খোলসটা নড়ে উঠলো। বিল্টুর হাত ধরে পারমিতা লাফ মেরে পিছু হটলো। ওড়নাটা ঠিক করে নিয়ে একটু ধাতস্ত হল পারমিতা। কাঁপা গলায় বলল, ‘ভয়ে তো এখনো কাঁপছে অনি! কী যে করি?’

-সোজা কথা, ভয়ের এলিমেন্টটা ভাগাতে হবে।’ গমগমে গলা বড়বাবুর।

হঠাৎ মুঠো ফোনটা বেজে উঠতেই মনিটরে তাকালেন বড়বাবু। ভারী শরীর নিয়ে ধপাস করে লাফিয়ে উঠলেন।

ইয়েস স্যার, ‘ইয়েস স্যার। এখনি আসছি।’ কাঁপতে কাঁপতে তীরের বেগে ঘর ছাড়লেন পূর্ব থানার জাঁদরেল অফিসার-ইন চার্জ।

বারান্দায় অনির কাছে এসে দাঁড়াল পারমিতা। বিল্টু আর মেঘা পাশে দাঁড়িয়ে। গ্রিলের ওপারে ফুটপাথে লাগানো দেবদারু গাছের ঘন পাতার ফাঁক গলে রোদ ঠিকরে পড়ছে অনিরুদ্ধর গালে। থম মেরে বসে আছে ও। উদ্ভ্রান্ত চোখ মুখ। বিড়বিড় করছে মাঝে মধ্যে। ঘরে একই ভাবে স্থির হয়ে আছে সাপের আঁকাবাঁকা লম্বা খোলস। ওদিকে তাকিয়ে সংসার-বৃক্ষের বলিষ্ঠ কাণ্ডটা আবার কেঁপে উঠলো।

ততক্ষণে বন দফতরের কর্মীরা পৌঁছে গেছে। চার পাশে তীক্ষ্ণ চাহনি বুলিয়ে ঘর ছাদ বাগানে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো ওরা। কিছু না পেয়ে লম্বা ছেলেটা বলল, ‘গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, ‘বাড়িতে কোন সাপ খোপ নাই।’

-যাক আপনারা বাঁচালেন।’ পারমিতা স্বরে কৃতজ্ঞতা ফোটাল

-এটা তো আমাদের কাজ।



এবার বনবিভাগের ছেলেটি অনির দিকে তাকাল। দু’পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘নাগকে ভালো বাসবেন দাদা। ভয় খাবেন না। লোকের বাড়িতে বাচ্চা কাচ্চা দলবল নিয়ে ঘাঁটি গাড়লেও সাপ  হটিয়ে বাড়ির দখল নিয়ে দেব আমারা।’

একটু থেমে আবার বলল, ‘আমার নাম অভয়। বাবার নাম ফনি নাগ, বাড়ি বীর নগর। আমাদের দলের হেড, নির্ভয়। ভয় পেলে আমাদের ডাকবেন।’

ঘোলাটে চোখ তুলে অনি মিনমিন করল, ‘খুব সাহস আপনাদের!’

সশব্দে হাসল অভয়। গম্ভীর গলা। বলল, ‘নিরীহ সরীসৃপ মাটির হাঁড়িতে ঢুকিয়ে, কখনো বস্তায় পুরে চালান করে দিতে পারি। কিন্তু…’

-কিন্তু কী?’ পারমিতার স্বরে চাপা উৎকন্ঠা।

-কিন্তু, মাস্তান প্রমোটার যদি ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে সম্পত্তি কব্জা করে? যা দিনকাল!

বেমক্কা সওয়ালে ভারি হয়ে গেল ঘরের বাতাস। মাথা বন বন করে উঠলো মাথা। বোবা বিস্ময় মুখে। অজানা ভয়ে কেঁপে উঠছে পারমিতা। পারমিতার আতঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে দু’পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল অনিরুদ্ধ।

তখন বাগানের মাটিতে খোলসটা জ্বালিয়ে দিল অভয়ের দলবল। তারপর হাওয়ার বেগে সাইকেল ছোটাল।



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply