মিলনের পথে: শেষ পর্ব
সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।
গোপালবাবু আজ অরিন্দমকে বলছেন আগে তো যাত্রাদলের নারী পাওয়া যেত না তখন পুরুষ মানুষই নারী সেজে যাত্রাদল অভিনয় করত। পুরুষরা কিন্তু নারীর অভিনয় কম যেত না তারা বেশ সুন্দর অভিনয় করত। এমন অনেক পুরুষের নারীর ভূমিকায় অভিনয় করেই নাম হয়েছে যাত্রা জগতে। তিনি আরও বলেন, নারীদের মঞ্চে আগমনের আগে যে সকল পুরুষ-অভিনেত্রী এদেশে ছিলেন তাদেরকে ‘রানী’ বলা হত। সেই রানীদের মধ্যে রেবতীরানী, হরিপদ বায়েন, নিতাইরানী, সুদর্শনরানী, সুধীররানী, ছবিরানী প্রমুখের অভিনয় দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
যাত্রা-গবেষক গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের ধারণা যাত্রার জন্ম তৃতীয় শতকে। ডক্টর হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য মনে করেন যে দ্বাদশ শতকের আগেই যাত্রার জন্ম হয়েছে। দ্বাদশ শতকেই যাত্রার জন্ম এমন মতের সমর্থক প্রবোধবন্ধু অধিকারী, ডক্টর আশ্রাফ সিদ্দিকী, নাট্যকার মমতাজদদীন আহমেদ প্রমুখ। পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে এবং সাহিত্যিক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে করেন পঞ্চদশ শতকের আগেই যাত্রার জন্ম। নাট্যব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরী অবশ্য পঞ্চদশ শতককেই যাত্রার জন্ম বলে চিহ্নিত করেছেন। ডক্টর সুরেশচন্দ্র মৈত্র, গবেষক কপিলা বাৎসায়ন, ডক্টর সুশীলকুমার দে, নাট্যকার মন্মথ রায়, নটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস, ডক্টর প্রভাতকুমার দাস, ডক্টর প্রভাতকুমার গোস্বামী, ডক্টর মণীন্দ্রলাল কুণডু, ডক্টর সৈয়দ জামিল আহমেদ প্রমুখের ধারণা বিশ্লেষণ করলে যাত্রার জন্ম ষোড়শ শতক বলে প্রতীয়মান হয়।
নাট্যকার জিয়া হায়দার বলেছেন,- ‘অষ্টাদশ শতক থেকে, সম্ভবত তার আগে থেকেই ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদল গড়ে ওঠে’। ডক্টর সেলিম আল দীন বলেছেন,-‘অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে যাত্রা কথাটার অর্থ সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই মূলত যাত্রা নাট্যাদি অর্থে পরিচিতি লাভ করে’। সেলিম আল দীনের এই মত মানলে যাত্রা এই আাধুনিককালের শিল্পআঙ্গিক বলে ভাবতে হয়। কিন্তু সেটি সম্ভবপর নয়। নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় তো বলেছিলেন,- ‘…এসব থেকে নিঃসংশয় হয়ে বোঝা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই নিয়মিত কৃষ্ণযাত্রার অভিনয় হতো এবং ভারতের সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছেই তা জনপ্রিয় ছিল’।
এখানে আর সংশয় থাকে না। দ্বাদশ শতকের কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’কে যাত্রা-নাট কিংবা নাটগীত হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ষোড়শ শতকের প্রথম দশকে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর কৃষ্ণলীলার অভিনয়কে যাত্রাগান মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। যাত্রার জন্ম নিয়ে সকল অভিমতকে আমলে নিয়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, উৎসব-অর্থে যাত্রা-র উন্মেষ প্রাচীনকালে কিন্তু অভিনয়কলা-অর্থে যাত্রা-র উন্মেষ ষোড়শ শতকে, গ্রামীণ আসরে বা চাঁতালে। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা চাঁতাল বা আসর থেকে উঠে আসে বাঁধামঞ্চে। অষ্টাদশ শতকের পর থেকে যাত্রা উৎসব কিংবা গীতাভিনয়ের আবরণ ঝেড়ে পরিণত হয় স্বতন্ত্র এক অভিনয়কলায়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশেই যাত্রা-র চলন, বিকাশ এবং প্রবাহ। আমরা জানি, যাত্রা-র জন্ম এই সমতটে। অর্থাৎ আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই যাত্রা-র জন্ম। যাত্রা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি। যাত্রা শুরুতে ছিল দেববন্দনার অংশ, কালে তা পৌরাণিক উপাখ্যান বয়ানের মাধ্যমে লোকশিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। চারণকবি মুকুন্দ দাসের হাতে যাত্রা তার বিষয় ও উপস্থাপনার গুণে রূপান্তরিত হলো ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে। পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার দে যাত্রাপালায় নিয়ে এলেন কাল্পনিক ইতিহাস, লোককাহিনী, জীবনী এবং সাম্প্রতিক সমাজিক উপাদান। যাত্রা হয়ে উঠলো সামাজিক বিনোদনের বিশাল মাধ্যম। এসব এখন জানা যায় ইন্টারনেট, গুগুলের মাধ্যমে। অনেক গ্রন্থ পাঠ করতে হয়। অরিন্দম বলে আপনার সাধনাকে কুর্ণিশ জানাই।
পরিশেষে আজ গােপালাবাবু তার একমাত্র কন্যা অপরূপার জন্মদিনের আয়ােজন করেছেন বিপুল আয়োজনে । আজ তিনি সকলের সম্মুখে অরিন্দম ও অপরূপার বিবাহের ঘােষণা করবেন অরিন্দমের বন্ধু সুব্রত সকল ব্যবস্থার দায়িত্বে। | অপরূপার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন আজকে। আজ অরিন্দম তার একেবারে নিজস্ব হবে। সারাদিন সে কল্পনার জাল বুনে চলেছে। আজ সে বাধাহীন উচ্ছাসে আনন্দিত। কখনও গাইছে কখনও নাচছে। বনের ময়ূরী বর্ষার জলে সিক্ত হয়ে যেরূপ পেখম তুলে নৃত্য করে সেই আনন্দের নৃত্যে। সন্ধ্যা সাতটার সময় অরিন্দম তার পিতামাতাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে গােপালবাবুর গৃহে উপিস্থত হলো। গোপালবাবুর ব্যবহারে এবং বিনম্র আচরণে তারা খুব আনন্দিত হলে আরও খুশী হলেন অপরূপাকে দর্শন করে। | সানাই বাজিয়ে উদ্বােধন করা হল আসরের। গান গাইলেন গােপালবাবু এবং তার
– আজ মিলনের পথে নেই কোন বাধা। জীবনের দিন আজ এসে গেছে রাজা।
অরিন্দম গানের মধ্যে ডুবে যায় কল্পনার সমুদ্রে। গােপালবাবু তার ফ্রেন্ড, অফার এ গাইড। সেই গােপালবাবব কন্যাকে সে আজ বিবাহ করতে চলেছে। একটা কথা অনুষ্ঠানের শেষে গোপালবাব অরিন্দমকে এবং অপরূপাকে ্পূর্ব পাশে নিয়ে তাদের আসন্ন বিবাহের পাকা কথা ঘােষণা করলেন। হাততালি বেজে উঠলাে। আজ অপর্ণার বিবাহ বিবাহ সিউড়ি শহরের বিখ্যাত পরিবারের প্রভাত ঘােষালের ছােটো পুত্র বাবুর সঙ্গে।সব সাজানো এবং শরণার্থীদের আপ্যায়ন কগ্রান্ত ব্যয় খরচ অশোক এবং শােভন দুই বন্ধুতে দায়িত্ব নিয়েছে। বরপক্ষ থেকে কোনাে দাবা নেই। তবু অশােকের পিতামাতা কন্যাকে সাজিয়ে দিয়েছেন। শোভনের ‘আজকে অন্য রূপ। সারাদিন সে আজ ব্যস্ত।
এমনকি বাথিকার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেনি। অশোক আহ্বান করছে। অশােকের নিজে। মাসী, পিসী ব্যতীত আছেন শােভনের বাড়ীর সকলে। অপর্ণার বাবা হিসাবে বীথিকা এবং তার পিতামাতা আর অরিন্দমের ভাবী শশুর এবং বধু হিসাবে গােপালবাবু এবং অপরূপা। অরিন্দম আজ চুড়িদার পাজামা পাঞ্জাবী আর অপরূপা লাল বেনারসী পড়ে এসেছে। যেন বিবাহের পূর্বে একবার মহড়া দিয়ে নিচ্ছে। অপর্ণার বান্ধবী বীথিকা আর দেবীকা দুজনেই কনে সাজাতে ব্যস্ত। এদিকে সুরেন্দ্র ক্যাটারার লাভপুর থেকে এসেছে। তাদের কাজকর্ম প্রায় শেষ। করে ফেলেছে। তাদের খাবার দাবারের আয়ােজন প্রায় শেষ। এখন বাকি শুধু বরের আগমন। বর এসে গেছে, বর এসে গেছে বলে চেঁচাতে লাগলাে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা।
বরকে কোলে করে তুলে বরাসনে বসালাে শােভন। বাবু ও শােভনের পরিচয় হতে বেশী সময় লাগলাে না। অপর্ণার আর একটি দাদা হিসাবে অশােক তাকে পরিচয় করিয়ে দিল। সুন্দর ব্যবহারে শােভন অভিভূত। অপর্ণার যােগ্য বর বাবু ঘােষাল। শােভনের মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলাে। আজ অনেকদিন পর সে বিশ্বজয়ের মানসিকতা অর্জন করেছে। এমনিতে শােভন খুবই প্র্যাকটিক্যাল কিন্তু আজকের দিনে সে ভাবের আবেশে নিমজ্জিত। | দেবীকা ও বীথিকা মিলিতভাবে অপর্ণাকে প্রেজেন্ট করলাে একটি সুন্দর হারমােনিয়াম। অরিন্দম প্রেজেন্ট করলাে একজোড়া সােনার চুড়ি। গােপালবাবু দিলেন একটি দেওয়াল ঘড়ি। কিন্তু শােভনের প্রেজেন্ট সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়। এক গােছা সাদা ফুলের তােড়া। অশােক আজ খুব কম কথা বলছে। শােভন এর কারণ বুঝতে পারছে না। কিন্তু অশােক আজ বেশী কথা বলতে চাইছে না। ভাবাবেগের ফলে হয়ত মনের বাসনা ভাষা হয়ে বেরিয়ে যেতে পারে।
সে আজকে শােভনকে সারপ্রাইজ দিতে চায়। তাই সে শােভনকে এড়িয়ে চলছে। অশােক যখন দেবীকাকে আজকের সারপ্রাইজের কথা বললাে তখন থেকে দেবীকার মন ঠিক নেই। এ ব্যাপারটি বীথিকাও লক্ষ্য করেছে। সে বারবার দেবীকাকে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। কিন্তু সঠিক কারণ বুঝতে পারেনি।যাইহােক বিবাহ কার্য সমাপ্ত হওয়ার পর বর কন্যা ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে সকলের সম্মুখে অশােকের পিতা অশােক এবং দেবীকার বিবাহের কথা ঘােষণা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আসরে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলাে। শােভন ও বীথিকা হতভম্ব, বিহ্বল হয়ে পড়েছে। তাদের মুখে কোনাে ভাষা নেই, শুধু পরস্পরের প্রতি দুজনের মৃদু হাসির ঝিলিক। | ঘােষণা পূর্বের পরেই শােভন অশােকের পিঠে সজোরে আঘাত করে তাকে আদরে সিক্ত করে তুলল। শােভনের চোখে অশ্রু অশােকের চোখে পড়ল শােভনকে অভয় দিয়ে অশাের আর একবার তার সঙ্গে কোলাকুলি করল। আজ তাদের বন্ধুত্বের দৃঢ় বন্ধন হল।
এ বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরেও অটুট থাকবে। রাত্রিতে যখন সবাই নিদ্রাচ্ছন্ন কেউ ঘরােয়া আসরের গল্পে মত্ততখন কিন্তু শােভন এবং বীথিকা অশােকদের দোতলা ছাদের উপর ঘনিষ্ঠ ভাবে বলে তাদের সুন্দর অবকাশ যাপন করছে। ছাতে পূর্ণিমার আলাে উদ্ভাসিত। বীথিকা তাজমহলের রাগী সেজে বসে আছে। আর সম্মুখে শােভন কল্পনা প্রবণ শিল্পীর মতাে যেন তুলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আজ অপর্ণার বিবাহ হয়ে গেল। অশােক ও দেবীকা বন্ধনে আবদ্ধ হল। কিন্তু শােভন বীথিকার পরিণতি কি হবে? তাদের মিলনের পথে যেতে আর কত পথ অতিক্রান্ত করতে হবে। বীথিকা তার বান্ধবী অপর্ণার কাছে জেনেছে কি পরিমাণ ভালাে সে শােভনকে বেসেছে। শােভন কিন্তু অন্য মানসিকতা নিয়ে তাকে দেখেছে তাও জানে। কিন্তু বীথিকা তার ভালােবাসায় শ্রেষ্ঠ পাত্র শােভনকে কিন্তু তিরস্কার করতে ছাড়ে না। সে শােভনকে জানায় ভালােবাসা কোনদিন কোনাে বাধা মানে না।
জলের স্রোতের মত এগিয়ে চলে। কিন্তু শােভন কি করে বােঝাবে বীথিকাকে কোন চোখে সে দেখে? সে যে তার মনের গহন বনের অধিবাসী। তার প্রত্যেকটি অণু পরমাণু শােভনের জন্ম জন্মান্তরের চেনা। বীথিকা বিহীন শােভন জল ছাড়া মাছের মত এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবে না। তবে তার কি ব্যবস্থা হবে? বীথিকা এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না। কেবল শােভনের বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে। শােভন বীথিকার মিলনের পথে আর কোনাে বাধা নেই। শােভন বীথিকার জীবনে শান্তি আসুক আর সারা পৃথিবী শান্তির পরিবেশ গড়ে তুলক।।