অবশেষে
অনিক সরকার।।
[হলে নিজের রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে আমি একটা ডায়েরি পাই। অনেক পুরাতন ডায়েরি। এ ধরনের জিনিস আজকাল দেখতে পাওয়াই যায় না। হয়ত কোনো উপহার বা পুরষ্কার হিসেবে কেউ ডায়েরিটি পেয়েছিল। ডায়েরিটিতে কোথাও কোনো নাম নেই, তবে ভেতরে অনেকটা লেখা ছিল। রুমের সবাইকে জিজ্ঞেস করেও এর লেখকের কোনো হদিস পাওয়া গেল না। অনেকটা আগ্রহের বশে সেদিন রাতে ডায়েরিটা খুলে বসলাম। খুব বেশি লেখা নেই, অচেনা কাউকে কিছুটা জানা যাবে এই-ই ভেবেছিলাম। লেখকের হয়ত প্রতিদিনকার তারিখ দিয়ে লেখার অভ্যাস ছিল না, অথবা ইচ্ছে ছিল না। তাই কোন গল্পের মত করে শুধু লিখেই গেছেন। কোথাও কোথাও আবার কয়েকটা পৃষ্টা বাদও দিয়ে গেছেন। ধারণা করলাম যে, নতুন ডায়েরি লেখার পোকা হয়ত মাথার মধ্যে কামড়েছিল, তাই চেষ্টা করেছিল। এরকম চেষ্টা আমিও আগে করেছি, লেখা আমার আসে না। ভাবলাম এমন চেষ্টার জন্য সাধারণ ডায়েরি ব্যবহার করতে পারত, এত মূল্যবান একটা ডায়েরি কেন। পরে অবশ্য তার উচিত জবাব পেয়েছিলাম।
পড়া শুরু করলাম; লেখকের হাতের লেখা পরিষ্কার, তবে লেখার অর্থ প্রথমে বুঝতে পারলাম না। রাত বাড়ার সাথে সাথে বোঝার দক্ষতাও হয়ত বৃদ্ধি পায়। যতই বুঝছি ততই আমি জড়িয়ে পড়ছি, শেষে কি হল এখনি বলবো না। তবে সে রাতে চারবার ডায়েরিটা আমার পড়া হয়ে গেল, কোন কোন পাতা আট-দশ বার করেও। সবারই আমার মত অবস্থা হত কি না জানি না, হয়ত এই বয়সের যারা তাদেরই শুধু হয়। সকলেই তো ভালোবাসে, কতজন বুঝতে পারে- এই যা, আবার নিজের কথা ঢুকিয়ে দিচ্ছি। আর না, এখন সেই ডায়েরির লেখাগুলোই কথা বলবে। আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না, অন্যের ডায়েরি সবাইকে পড়ানোর পিছনে একটা বড় কারণ আছে। কারণটা পরে শুনবেন, আগে পড়ে এবং বুঝে দেখুন। আগেই বলেছি লেখা জিনিসটা ঠিক আমার আসে না, তাই ডায়েরির লেখাই তুলে দিচ্ছি…]
গত কয়েকদিন যাবত কি হয়েছে আমার বুঝতে পারছি না, এমন কিছু কখনো আমার সাথে ঘটে নি। আমি নিজেকে ঠিক চিনতে পারছি না, বুঝতে পারছি না আমি কি করছি, আর কেনই বা করছি। সকালে উঠে মনে হয় পুরো দিন বৃথা যাবে। খাওয়া দাওয়া করতে পারছি না, রুচি নেই। অনেক ক্ষুধা নিয়ে খেতে গিয়ে দেখি গলা দিয়ে কিছুই নামছে না। নিজেকে সবসময় ছোট মনে হয়, চাইছি সকলে আমার দিকে দৃষ্টি ফেরাক, আবার কেউ এসে কিছু জিজ্ঞেস করলে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছি। ক্লাস করতে ইচ্ছে করেনা, আবার ঘুমাতেও ইচ্ছে করেনা। রাতের বেলা যেন অনেকটা অনিচ্ছের সাথেই ঘুমিয়ে পড়ি।
আমি আমার সব কিছু মাকে জানাতে ভালোবাসি। বর্তমান অবস্থার কথা তাকে জানাতে সাহস পাচ্ছি না। সবচে’ বড় সমস্যা বোধহয় এটাই। আমি কাউকে ঠিক মন খুলে সমস্যা গুলোর কথা জানাতে পারছি না, কিংবা চাইছি না কেউ জানুক। আসলে নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি, কাউকে এখনকার অবস্থা বলে বোঝাতে পারবো বলে মনে হয়না। নিজে নিজে এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছি, আপাতত কোনো আশার আলো দেখতে পাইনি। সামনে পাবো এমন কোন আশাও নেই। আশাহীন, ভরসাহীন, বিশ্বাসহীন হয়ে দিন কাটাচ্ছি, কাটাচ্ছি না বলে পার হয়ে যাচ্ছে বলা বরং ভাল।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা তো নয়। ভার্সিটিতে উঠার পর তিন বছর বেশ মজা করতে করতেই পার করে দিয়েছি। থার্ড ইয়ারের শেষে খেয়াল হলো আরে, অনার্স তো প্রায় শেষের দিকে। পড়াশোনার দিকে মন দেব কখন? ফাইনাল ইয়ারে তাই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলাম। যে করেই হোক এবার মন দিয়ে পড়া শোনা করতে শুরু করেছিলাম। মাঝখান থেকে কোত্থেকে কি উটকো ঝামেলা আবার মাথার মধ্যে এলো রে বাবা! না পারি কইতে, না পারি সইতে। নিজেকেই মাঝে মাঝে বোঝানোর চেষ্টা করি, ফলের মধ্যে এই যে, আরো ডিপ্রেসড হয়ে যাই। বোঝানো শুরু করার আগে রাতে ভাত খাবো না হাল্কা কিছু খাবো, এই নিয়ে দোটানায় ছিলাম, কিছুক্ষণ বোঝানোর পরে দেখি খাওয়ার ইচ্ছাই চলে গেছে। তখন কি আর করা, বিছানায় এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ি।
কোনো কারণে মন বিষন্ন হয়ে গেলে তার প্রতিকার হয়ত সম্ভব, কারণ ছাড়া মন বিষন্ন হলে আসলে কি করা উচিত এ নিয়ে আমার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই। এক পর্যায়ে কাছের বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ কমে আসলো। রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মন খারাপ, দুপুরে মন খারাপ, রাতে মন খারাপ, তারপরে ঘুম। দূর ছাই। এমন জীবনও মানুষের হয়!
এই সব কিছুর মূলে কি অই মেয়েটা? নিজেকে এতটা হারিয়ে ফেলছি শুধু আরেকজন মানুষের জন্য! আরে ধুর! এমন হয় নাকি। এসব তো সিনেমা-নাটকে চলে, বাস্তবে ঘটে নাকি! এইসব দিনে নিজের কাছে চিঠি লিখার মত এই ডায়েরি লেখাই যেন একটু শান্তি দিচ্ছে। যাক একটা কাজে মন দিই তো আগে।
চলছে এমনি দুরবস্থা, এর মধ্যেই আবার…।
এক মিনিট। এতটা কাকতালীয় ব্যাপার কিভাবে ঘটতে পারে। কালই মেয়েটার কথা মাথায় এল, আজ আবার তাকে দেখতে পেলাম। তবে কি এটা কোনো ইঙ্গিত। হতে পারে অবচেতন মনে মূল সমস্যাটাই এড়িয়ে চলতে চাইছি আমি। হতে পারে এটাতেই লুকিয়ে আছে মন খারাপের রহস্য। বুঝতে পারছি না কি করব! যে মেয়েটার সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানি না, তাকে নিয়ে মাথা ঘামানো কি ঠিক হবে?
আগে তো কোনো বালাই ছাড়াই ছিল মন খারাপ। এখন তো দেখি নতুন উপসর্গ। সারাদিন শুধু অই একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরছে। মেয়েটা কিছুতেই দেখি একা থাকতে দিচ্ছে না। কতদিন যে ভুগতে হবে!!
কি কুক্ষণে যে মাথার মধ্যে মেয়েটার কথা এল। আর কি কুক্ষণেই না আবার দেখতে পেলাম। আমাদের মন অজুহাত তৈরি করতে ভালবাসে। কোথায় ছিলো মন খারাপ, আর কোথায় সেই মেয়ে। ক্রস করবে কিভাবে রে ভাই…? নিজেকে বোঝাও বন্ধু, নিজেকে বোঝাও।।
জানি না মাথার বাইরেও শরীরের আর কোন অঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে কি না। থাকলেও মাথা কি তাকে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাধা দেয়। অন্য অঙ্গ বলতে তো আসলে কোন অঙ্গ নয়, মন। মন নামক বস্তুটি কি সবসময় যুক্তির বিরুদ্ধেই কথা বলে, নাকি যুক্তির বাইরে কিছু করতে চাইলে আমরাই মনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করি! কে জানে,তবে বরাবর আমি শুনে এসেছি যে মনের কথা শুনে চলতে হবে।
যে কথাটা আমি যুক্তি দিয়ে মেনে নিতে চাইছি না, আমার ভিতর থেকে কেউ আমাকে সেটাই বার বার মেনে নিতে বলছে। যুক্তি মানুষের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী, বাস্তব জীবনে যুক্তির কোন বিকল্প নেই। তবে আমি যেন উপদেশের চেয়ে সাহচর্যই পছন্দ করি বেশি। যে সাহচর্য দিচ্ছে সে হল অন্তরতর। তার ডাক শুনতে বিলম্ব হতে পারে, তবে উপেক্ষা করা যায় না। অতি তীক্ষ্ণ নয় সে ডাক, তবে বিরামহীন। মধুর কণ্ঠ যাকে বলে এ সে নয়, বরং মায়াবী।
মানবো না, মানবো না করেও শেষে মনের কথাই মেনে নিতে বাধ্য হলাম। আমি এখন জানি আমার সমস্যাটা কী, জানি এর উৎপত্তি কোথায়। শুধু জানি না এর শেষ কোথায় হবে, কীভাবে হবে। আমার মনের অস্থিরতাটা এখন কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আছে। ধীরে ধীরে আরও কমে যাবে আশা করি। যাক তাহলে আর নিজে থেকে কোন কঠিন কাজ করতে হবে না। আমি তো ভেবেছিলাম শেষে না বাধ্য হয়ে মেয়েটাকেই খুঁজে বের করতে হয়…
[ ডায়েরির এ অংশে কয়েকটা পৃষ্টা ফাঁকা রাখা আছে, কি যে তার মনে ছিল কে জানে। এরপরে লেখা…]
অস্থিরতা দূর করতে ডায়েরি লেখার কথা হয়ত শোনা গেছে, তবে স্মৃতি মন্থন করতে ডায়েরি লেখা- এটা আমার কাছেই হাস্যকর লাগছে। মগজের স্মৃতি গুলোরও আজকাল সাহচর্য প্রয়োজন!তবে কাজটা বোকা বোকা লাগলেও সিদ্ধান্তটা আমার কাছে ভাল মনে হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে আজই সব শেষ করবো, এই বিষন্নতা, এই অবসাদ, এই দোটানা- সব মুছে ফেলবো মন থেকে। কত কাজ আমার- সবার আগে পাস করে তো বের হতে হবে, এরপর শুরু করতে হবে যুদ্ধ। এমন মারাত্মক পরিস্থিতিতে এসব শুধুই আমাকে পিছিয়ে দিচ্ছে। তাই বাস্তব জীবনের যুদ্ধের আগে নিজের সাথে জেতাটা জরুরি। ঘরের সমস্যার সমাধান না করে তো বাইরের সমস্যায় মনোযোগ দিতে পারব না।
তবে স্মৃতিচারণ, এ হবে শুধুই স্মৃতিচারণ। আর কিছু নয়। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ- নিজের কাছেই। এমনকি বর্তমান অবস্থার সাথে কোন যোগাযোগও এড়িয়ে যাব, সজ্ঞানে। এরপরই এই চ্যাপ্টার ক্লোজ।এমনটাই করতে হবে, অনেক ভাবনা চিন্তার পরে এই সিদ্ধান্ত।
হা হা! সব গল্পের শেষ নাকি হয় বর্তমানে। আর আমি নিচ্ছি উলটা পথ। আমার গল্প শেষ হতে যাচ্ছে অতীতে, যেখানে এর শুরু। আমি চাইছি না, গল্পটা তার নিজের গণ্ডির বাইরে বের হোক। আমি চাইছি না এর একটা শেষ দেয়ার অজুহাতে এতে আবার জড়িয়ে যেতে। তাই কিছুক্ষন অতীতে ডুব দেব, যাতে হঠাত ভুলে যাওয়ার একটা সান্তনা থাকে। ন্যায়বিচারের মতো। একেই হয়ত বলে টাইম ট্রাভেল। অতীত, বর্তমান এবং পুনরায় অতীত।
তাকে প্রথম দেখেছিলাম বোধহয় ওর ডিপারট্মেন্টের বাইরে। তখন যদিও জানতাম না যে ওর ডিপারট্মেন্ট কোনটা, পরে জানতে পারি। সে সময়টার একটা বর্ণনা দিই। আমি তখন সদ্য প্রথম বর্ষে। ভার্সিটিতে উঠার পর সব কিছুই ভালো লাগতে শুরু করেছে। ভাইদের র্যাগ ভালো লাগে, ক্যান্টিনের বাজে খাবার ভালো লাগে, স্যারদের দেড় ঘন্টার বোরিং লেকচারগুলো ভালো লাগে- এমনকি বন্ধুরা যখন আমার নাম ভুলে যায় তখনও ভালো লাগে, হাসিমুখে নিজের নামটা সেই বন্ধুকে আবার বলে দেই।
তবে সবচেয়ে ভাল বোধহয় লাগতো ক্লাসের পরের আড্ডা নামক ঘোরাঘুরিটাকে। আমি ছিলাম ঘরকুনো ছেলে, বন্ধুদের সাথে আগে তেমন বেড়াতে যেতাম না। এখন সুযোগ পেয়ে মনে হয় আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। বন্ধুদের সাথে ঘোরার পরও আমার তেষ্টা মিটতো না, এরপরেও একাই ঘুরে বেড়াতাম অনেকক্ষণ। তেমনই একটা বিকেলে হয়ত ওকে দেখেছিলাম।
দেখে হঠাত থমকে দাঁড়াই। বন্ধুরা সাথে থাকলে হয়ত চোখেই পড়ত না, হয়ত কথার স্রোতে ভাবনা উড়ে যেত। কিন্তু এখন কেউ নেই বলেই ভাবনা তার কাজ করার সুযোগ পেল। তবে সুবিধা করতে পারল না। বুঝতে পারছি মেয়েটার মুখে দৃষ্টি আকর্ষণের মত কিছু আছে, এই কী আছে আর খুঁজে বের করতে পারলাম না।
ওদের ডিপারট্মেন্ট আমাদের থেকে খুব একটা দূরে নয়। বরং ক্যান্টিন একটাই হওয়ায় হঠাত হঠাত ওকে দেখতে পেতাম। মাঝে মাঝে চিনতেও পারতাম না। তবে অই যে বলছি, ভাবনারা সুযোগ পেলেই কাজে লেগে পড়ত। একদিন হুট করে তারা সফলতা পেল। এই সামান্য জিনিসটা খুঁজে পেতে আমার এত সময় লেগেছিল ভাবলে আমি আজও অবাক হয়ে যাই। ওর চোখ! ওর চোখগুলো!!
সাধারণত সুন্দর চোখের বর্ণনায় সবাই ‘আয়তচক্ষু’ শব্দটাই বেশি ব্যবহার করে। হরিণীর ন্যায়, কাজলকালো, পদ্মলোচনা- এসব শব্দও ব্যবহৃত হয় প্রায়ই। তবে এসব কিছুই হয়ত সেই চোখের বর্ণনায় যাবে না। সত্যি বলতে অনেকের কাছে প্রথম দেখায় সেই চোখ অন্যরকম নাও লাগতে পারে। আমার কথা ভিন্ন, যে সময়ের কথা বলছি সেটা অন্যদের কথা ভাবার সময় ছিল না। আমার দেখা সেই চোখজোড়া তখন ছিল আমার বিস্ময়। সেই চোখে ফুটে উঠত ওর প্রতিটা অনুভূতি।
মানুষের অনুভূতি বোঝার নাকি অনেক উপায় আছে। ওকে দেখার পর আমি নতুন উপায়ের খোঁজ পেলাম। অবাক হয়ে যেতাম, কীভাবে একজনের হাসি, নিশ্চেষ্টতা, অমনোযোগিতা আর উৎসাহ ফুটে ওঠে তার চোখের অভিব্যক্তিতে। কালের অথবা নিজের খেয়ালে কখনো তাকে অনুসরণ করার কথা মাথায় আসেনি। তাই সময়ের ক্ষুদ্রতায় ওর কষ্ট বা বিরক্তির অনুভূতি দেখা হয়ে ওঠেনি। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমার যে অবচেতন মন অই চোখজোড়ার পিছু পিছু ছুটে বেড়াত সে নিশ্চিতভাবেই এগুলোর সার্থক অভিব্যক্তি দেখেছে। হয়ত জীবনের চলার পথের যে নূন্যতর কষ্টগুলোকে আমরা কিছুতেই এড়াতে পারিনা সেই মায়াভরা চোখদুটিতে তারা তাদের প্রকৃত অবস্থান খুঁজে নিত। এগুলো সকলকে বলা যায় না। শুধু নিজেদের গোপনীয়তার কারণে নয়, যথাযোগ্য শব্দের অভাবেও বটে। নিজের মনে এগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে দিনের পর দিন পার করে দেয়া যায়, তবে বিপত্তি ঘটে সেগুলোর সাকার রূপ দিতে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। তাই হয়ত এমন সুনিপুণভাবে তাদের প্রকাশের সম্ভাবনায় সবচে’ অভিভূত হয়েছিলাম আমি।
তবে আশ্চর্যের কথা, যে চোখের কারণে আমার ভেতরে এতটা কিছু হয়ে যাচ্ছিলো তাদের বর্ণনা দিতে আজ আমি অপারগ। হয়ত তখনো পারতাম না। তখন শুধুই এদের বিচরণ দেখে বিস্মিত হয়ে যেতাম, বদ্ধ স্থানের মাঝে ওদের অবাধ ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারতাম না। শারীরিক বর্ণনার ভাষা খুঁজতে না যাওয়া আমি বলবো আমার জন্য শাপে বরই হয়েছে। নতুবা মিথ্যে ভাষার খোঁজে যদি আমি তখন এমন বিড়ম্বনায় পড়তাম তবে সেই সত্য অনুভূতিগুলি হয়ত আমার কাছে সত্য হয়ে ধরাই দিত না।
হ্যাঁ, এটা বলাই যায় যে, আমার জন্য তো সেটাই ভালো হতো। তবে ভালো-মন্দের বিচার বোধহয় পৃথিবীতে এভাবে হয় না, নতুবা নিজেদের জন্য সব ভালো খুঁজতে গিয়ে আমরা নিছক অর্থহীন কিছু কিছু ঘটনাকে বাদ দিয়ে দিতাম। এতে জীবনে সফলতা আসতো কি না বলতে পারিনা, তবে অবশ্যই জীবন থেকে কিছুটা জীবনীশক্তি হারিয়ে যেত।
তবুও যেন আমার অস্বস্তি কাটছে না। এতদিন ধরে চোখদুটি দেখেই গেলাম শুধু, ওদের কোনো রূপই কি তবে আমার ভাষার উপযুক্ত নয়? তবে একটা উপমা আমার মাথায় এসেছে। যখন নিজে থেকে কিছু দিতে পারছি না তখন অন্যের উপমা ধার করতেই হয়। যে আক্ষরিক বর্ণনা আমি দিতে চাইছি এই উপমা হয়ত তা দেবে না, তবু জীবনানন্দের এই উপমাই হয়ত সেই চক্ষুদ্বয়ের একমাত্র পরিপূর্ণ বর্ণনা-
“ সবচেয়ে সুন্দর করুণ “
এরপরে মনে হয়না আর কোনো আক্ষেপ থাকা উচিত।
এখানেই লেখা শেষ করলে মনে হয় সুন্দর হতো। তবে আমি আরও কিছু লিখতে চাই।
নিজেকে এরপর থেকে আচ্ছন্নের মত মাঝে মাঝেই তার খোঁজ করতে দেখেছি। একে ভালোবাসা বলবো না ( যদিও আমার কথাবার্তায় তাই মনে হওয়া উচিত, আমি নিজেও এই সন্দেহ নিয়ে অনেকদিন ছিলাম), বরং মোহ বলতে পারি। কারণ এই এতটা সময়ের পরিক্রমায় কখনো নিজের পরিচয় দেয়ার বা তার সাথে পরিচিত হওয়ার কোন মনোবাসনা হয়নি। আমি দূরে থেকেই শুধু দেখে যেতে চেয়েছি। ভালোবাসলে হয়ত এতটা দূরত্ব সহ্য হয় না ( নাকি তাও হয়?)।
তবে মোহ একসময় দুর্বল হয়ে আসে, চলমান ঘটনাপ্রবাহ এর তীব্রতাকে কমিয়ে দেয়। তবুও মাঝে মাঝে ওর শারীরিক উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে এই মোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠত, উঠে। কখনো একে জোর করে ভুলে যাওয়ার কথা মাথায় আসেনি। অত ভয়ংকরভাবে এগুলো সামনেও আসেনি। এখন আসছে। এখন মনে হচ্ছে স্মৃতি ভুলে যাওয়া ভাল। যত তাড়াতাড়ি ভোলা যায় ততই ভালো…
—–
[ শেষ কখনো কখনো শুধু শুরুর আভাস দেয় মাত্র। অই যে বলে না, শেষ হইয়াও হইলো না শেষ…। মানে? -মানে আরও লিখা আছে, এবং অবশ্যই কিছু পৃষ্টা বাদ দিয়ে লেখা]
বহুদিন পর পূর্বের আমিকে দেখে ভাল লাগলো। তারিখ দিয়ে আগে লিখতাম না, আজও তাই। এর পেছনে কোনো কারণ ছিল না, তবে একটা ভাল দিক লক্ষ্য করলাম। আগের লেখাগুলোকে গতকালকের বলেই মনে হয়। শুধু কালি কিছুটা বসে গেছে। তবে আমার তো জানা, কত মাস পরে এই ডায়েরি খুঁজে পেলাম। এর চিহ্নস্বরূপ কিছু পেজ ফাঁকাই রেখে দিই। প্রত্যেক মাসের জন্য এক পাতা করে; যে সময়ে দিন গেছে, তবে দিনলিপি লেখা হয়নি।
[গুণে দেখেছি মোট সতেরোটা পাতা ফাঁকা রাখা হয়েছে!]
চোখের সামনে থেকে দূরে রাখতে ডায়েরিটা লকারে রেখে দিয়েছিলাম। আজ এসে মনে হচ্ছে তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। সময় সবচে’ বড় ঔষধ। ধীরে ধীরে সব ব্যথা কমিয়ে দেয়, সারিয়ে দেয় বলতে পারছি না। কারণ ব্যথার স্মৃতিও যথেষ্ট কষ্ট দেয়, যে স্মৃতি জমা থাকে মস্তিষ্কে- মৃত্যুর আগে যার মৃত্যু নেই। তখন এটা বোঝার মতো পরিপক্বতা ছিলো না, আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে কিছুটা হয়েছে। কতটুকু হয়েছে জানি না, তবে হয়েছে; আরও হবে আশা করি।
ডায়েরি তালাবদ্ধ করে ভুলে যাওয়ার উপায়টা কাজে দেয় নি। এরপরেও সেই চোখগুলো দেখেছি, তারপরে আবার, আবার। একসময় ভোলার বিষয়টাই ভুলে গেছি। বুঝতে শিখেছি, যা সুন্দর তাতে কারো একচ্ছত্র অধিকার থাকেনা। চোখের জন্য যেমন স্পষ্ট দূরত্ব নামক একটা নূন্যতম দূরত্ব আছে, মানুষের জন্য আছে সৌন্দর্য অবলোকনের স্পষ্ট দূরত্ব। সুন্দরকে নিজের করে পেতে হবে- এমন মনোভাব শুধু আক্ষেপেরই জন্ম দেয়। আসলেই কি কখনো তাকে নিজের করে পাওয়া যায়?
তবে হ্যাঁ, যতটা নিরাবেগ মনে হচ্ছে কথাগুলো বলে, ততটা হয়ে যাইনি এখনো। হতে পারবো বলে মনেও হচ্ছে না। আক্ষেপটা নেই, তবুও আকাঙ্ক্ষা এখনো আছে। এখন আর আগেকার মতো চাইনা যে চোখদুটো আমার দিকেই শুধু তাকিয়ে থাকুক, চাই দূর থেকেও তার অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা দেখতে পারি। চাই না সেই চোখে আমার বিরহে কোনো বেদনা ফুটে উঠুক, চাই সেখানে বিরহের অনুভূতি যাতে সারাজীবন একই রকম অম্লান থাকে। চাই না সেখানে ভালবাসা সংকুচিত হয়ে থাকুক, বরং সেই ভালবাসাটুকু যাতে বিস্তৃত হয়ে যায় সবদিক পানে। চাই তো যে সারাজীবন যাতে সেই চোখজোড়া খোলাই থাকে, জানি তা হওয়ার নয়; শুধু এতটুকু আশা- সেই চোখগুলো যখন বন্ধ হবে তাতে না পাওয়ার আক্ষেপ থাকলেও যেন অবিশ্বাসের অনুরণন না থাকে। যতটা বিস্ময়ের সাথে তারা জীবনকে দেখছে, জীবনের শেষ অমোঘ সত্যটুকু যেন সেই বিস্ময়ের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত না হয়।
অনেক হলো। এখন বাস্তবে ফিরে আসি। হে হে। এই ডায়েরি আর অন্ধকার কোটরে বদ্ধ রইবে না, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। আমার পড়াশোনাও শেষের দিকে। হয়ত আরো অনেকদিন বাঁচবো, সামনে পড়ে আছে বিস্তৃত কর্মজীবন। কতটুকু সাফল্য-ব্যর্থতা আসবে জানি না, তবে হঠাত কদাচিৎ কাজের ফাঁকে সেই চোখগুলো অতীত ঠেলে উঁকি দেবে হয়ত। জীবনের এক অদ্ভুত সময়কে মনে করিয়ে দেবে তার সাথে। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে বুড়োদের আড্ডায় নিছকই সাধারণ কোন কথায় আনমনা হয়ে যাবো হয়ত। কারণ তখন আমার সুদূর স্মৃতির সমুদ্র থেকে সময়ের স্রোত পাড়ি দিয়ে বর্তমানের বালুবেলায় ভেসে উঠেছে দু’টি চোখ। তাদের অভিব্যক্তি পড়ার চেষ্টা করতে করতে অজানিতেই প্রশ্ন করে বসবো- জীবনটা আসলে কী, বলুন তো ব্রাদার??