মো ফেরদৌস আলম

অসীম শিশুর খেলার ফড়িং

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

মো: ফেরদৌস আলম
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ফড়িং উড়ছে। উড়ে উড়ে এখানে ওখানে বসছে। শুকাতে দেয়া কাপড়ের ওপর বসছে। ছোট নিচু গাছের ওপর বসছে। বসছে বড় গাছের ওপরও–কিন্তু তা সুমনের জন্য নয়। সে ছোট। পাঁচ বছরের ছোট এক মানুষ। তার জন্য ফড়িং কাছাকাছি উড়ে উড়ে আনন্দ ছড়ায়। ফড়িং দেখতে দেখতে দুয়েকটা ধরে ফেলে সুমন। ফড়িঙের ডানা দুটি ধরে দৌড়ে বেড়ায়। কখনো সুতো দিয়ে বেঁধে ঘুড়ির মতো উড়িয়ে দেয় ফড়িং। এতে সুমনের আনন্দ প্রচুর। কিন্তু সে জানে না ফড়িঙের কীসে আনন্দ! আনন্দের আতিশয্যে প্রায় ফড়িং মরে যায়। তখন সুমনের আনন্দ থমকে যায়। দুঃখ লাগে। মানুষের মৃত্যুর সাথে মিলিয়ে নেয় ফড়িঙের মৃত্যু। কখনো কখনো মৃত ফড়িংকে কবর দেয় মাটি খুড়ে। আজও একটা ফড়িং মরে গেল। সুমনের খুব দুঃখ হলো। এর কবর দেবে সে। উঠোনের এক কোণে মাটি খুড়লো লোহার পেরেক শাবলের মতো ব্যবহার করে। বাঁশের মতো কবরের ছাউনি দিতে কিছু নারিকেল পাতার শলাকা নিল। ফড়িংটাকে গর্তে রেখে তার ওপর শলাকা  ছড়িয়ে দিয়ে মাটি চাপা দিল। এসব সে দেখেছে, মানুষের মৃত্যুতে করা হয়। তবে সে মানুষের মৃত্যু খুব ভয় করে। সাদা কাফন পরিয়ে যখন মানুষের প্রাণহীন দেহ কবরে নামানো হয় তখন তার প্রাণ ভয়ে আঁতকে ওঠে। তার শিশু প্রাণ মৃত্যুর ভয়ে এতোই অস্থির হয়ে ওঠে যে সে রাতে ঘুমাতে পারে না–একা একা তার ভয় লাগে। অন্ধকারে সে শিউরে ওঠে।

ফড়িঙের কবর দিয়ে সুমন খেলা ভঙ্গ করবে এমন সময় তার অসুস্থ দাদাজান এই কাণ্ড খেয়াল করেন। তিনি রেগে গিয়ে ‘দূর হ শয়তান’ বলে ওর সুমনের দিকে ঝাড়ু ছুড়ে মারলেন। সুমন বুঝতে পারে না যে, ফড়িং কবর দেয়ায় দাদা এত ক্ষেপেছেন কেন! ঝাড়ুটা পাশ দিয়ে একরকম উড়ে গেল। সুমন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দৌড়ে পালালো। মা বলে, অসুস্থ কারো সামনে কবর নিয়ে খেলা করা অলক্ষুণে। সুমনের মতো দাদাজানও কি মৃত্যুকে ভয় পান? সুমন মানুষের মৃত্যুকে ভয় করে কিন্তু ফড়িঙের মৃত্যুকে নয়। কিন্তু দাদাজান ফড়িঙের মৃত্যুকেও ভয় পেয়ে রেগে যান! এরকম ব্যবহারে সুমন দাদাজানকে ভয় করতে শুরু করলো। সহজে কাছে যায় না। কেন ভয় করে? দাদাজানের মৃত্যুভীত প্রাণকে কি উপলব্ধি করে সুমন? নাকি দাদাজানের মধ্যে মূর্তমান মৃত্যুকেই দেখতে পায়? সুমন ভয়ের কোনো উত্তর জানে না। ছোট হওয়ায় ভয়কে জয় করার উপায়ও করতে পারে না। মানবশিশু কতটা অসহায়! মানুষকে আল্লাহ দুর্বল করেই সৃষ্টি করেছেন। মুরগীছানাও সকালে জন্ম নিয়ে বিকেলে হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু মানবশিশু তা পারে না। অনেক অসহায় সে! না, সুমন ততোটা অসহায় নয় এখন। পাঁচ বছরে সে অনেক বড় হয়েছে। সে দৌড়াতে পারে। কিন্তু তার খুব ভয়। এ ভয় জীবনের ভয় নয়–মৃত্যুর ভয়! জীবন তাকে অতোটা গভীরভাবে ভাবায় না। হেসে-খেলে তার দিন কাটে। কান্নাও আছে–অবুঝ কান্না। সে হয়তো জীবন সম্পর্কে ভাবে না। জীবন হেসে-খেলে কাটবে কিনা তা তার ভাবনা নয়। সে ভাবে, বড় হলে আর ভয় থাকবে না!



সুমন তার বিহ্বল প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকে। যখন খেলায় মত্ত থাকে তখন ভয়কে ভুলে যায়। বিভিন্ন ভাবনা থেকে বিভিন্ন ধরণের খেলা সে খেলে। বড়দের জীবনকে কল্পনার প্রলেপ দিয়ে খেলা। ফড়িঙের কবরও সুমনের একটা খেলা। এক সুতীব্র চিৎকারে সুমনের ঘুম ভাঙ্গে রাতে। কত রাত? কীসের চিৎকার? অতিথি সমাগমের কারণে মা-বাবার পাশে শুয়েছিল আজ। উঠে বসে দেখে কেউ নেই পাশে। একা অন্ধকারে তার ভয় লাগছে। ক্রমে স্পষ্ট হলো এ চিত্কার বুকফাঁটা কান্নার। কার কান্না? কীসের এ কান্না? সুমন ঠিক করতে পারে না কিছুই। ভয়ে ভয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে সে। সামনের ঘরে এসে তার সকল ভয়, সকল সংশয় থমকে দাঁড়ায়। ঘুম ভেঙে তার মনেই হয়নি এমন কিছু ঘটতে পারে। মনে না হওয়ার কারণ–ঘুম থেকে জেগে অতীত বিস্মৃত ছিল সে। রাত পোহালেই ইদ। সন্ধ্যায় ইদের চাঁদ দেখার আনন্দ মিলিয়ে গেছে গভীর অন্ধকারে। চিরপরিচিত মানুষদের কান্না দেখে ক্রমেই ঘুমের ঘোর কাটে সুমনের। দাদাজান সাতদিন যাবৎ খেতে পারেন না। মৃত্যু! দাদাজানের মৃত্যু! দাদাজান আর নেই। নিথর দেহ ছেড়ে চলে গেছেন। রুদ্র মাতম চারিদিকে। দাদাজানের জবান বন্ধ হয় তিনদিন আগে। ধাতব একটা থালা পেটাতেন প্রয়োজনে। আজও পিটিয়েছেন। মৃত্যুভয়ে। জীবনের প্রয়োজন আজ অপূরণীয়। সবাই উঠে এসে তাকে ঘিরে বসেছিলেন। ধীরে ধীরে জড় দেহে পরিণত হলেন তিনি। কান্নার রোল দেখে সুমন হতবিহ্বল! চারিপাশের দুনিয়ায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দাদাজানের মৃত্যুর সময় রাত প্রায় দেড়টা। কর্তাব্যক্তির মৃত্যুর সময় নাকি পরিবারের ভবিষ্যত্ নির্দেশ করে। সে সময় যদি সন্ধ্যা হয় তবে সামনে গভীর রাত। সে সময় যদি সকাল হয় তবে সামনে উজ্জ্বল দিন। আর দাদাজান মারা গেলেন মধ্যরাতে। এখন অন্ধকার। সামনে অন্ধকার, পেছনেও অন্ধকার। তবে খুব অল্প সময়ের অন্ধকার। তারপরেই উজ্জ্বল আলোর দিন। শুধু দিনই নয়, ইদের দিন। সেরকম কিছু হোক। দাদাজানের এই সংসারে যেন ইদ নেমে আসে।

সুমন ইতস্তত এখানে ওখানে দাঁড়াচ্ছে। হাথিনায় (বারান্দা বিশেষ) দাদাজানের দেহখানি রাখা আছে। বড়রা বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলছে। একটা বড় প্রজাপতি উড়ে এসে এখানে ওখানে বসছে। তারা বলছে, রূহ এসেছে! পানি দাও একে! সুমন অবাক হয়। কী বলছে এরা! সুমনকে দাদাজানের নিথর চেহারাখানি দেখাতে ডেকে নেয় একজন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সুমন দেখল। দাদাজানের ঠোটের ওপর শিশিরবিন্দুর মতো ঘাম জমেছে। এ কি মৃত্যুভয়? মৃত্যুকষ্ট? নাকি চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়ায় এ উষ্ণতা? এ মৃত্যু কি অপরিহার্য? হ্যাঁ, এর থেকে কারোই রেহাই নেই। সবাইকেই একদিন ছেড়ে যেতে হবে এ সংসার। এভাবে একদিন চলে গেছেন দাদাজানের পূর্বপুরুষেরা। চলে যাবে উত্তরাধিকারীরাও। সুমনকেও চলে যেতে হবে! কোথায় যাবে সে? অন্ধকারে তার খুব ভয় লাগে! সুমন ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়। সমবয়সীদের কাছে ঘেঁষেও ভয় কাটে না। ওদের কি ভয় লাগে না? সুমন জানে না।

দেখতে দেখতে রাত ফর্সা হয়ে এলো। আজ ইদ। কিন্তু সবাই মৃত্যুতে মুহ্যমান। আশেপাশের কোনো ঘরেই আজ ইদের সেমাই-ফিরনি রান্না হয়নি। সুমন তাও সকালে আলমারি থেকে তুলে রাখা জামা নিয়ে গায়ে দেয়। দাদাজানের মৃতদেহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। সুমন ঘুরে ঘুরে ঘরের দিকে আসে। উঠানে মশারি টাঙ্গানো হয়েছে। ওর ভিতরে দাদাজানকে গোসল করানো হবে। শেষ গোসল! সুমন যখন ফড়িংকে কবর দেয় তখন সে অবশ্য ফড়িঙের গোসল দেয় না। সুমন আস্তে আস্তে দূরে সরে যায়। এক সময় দাদাজানের খাটিয়া প্রস্তুত করা হলো। আতর-লোবানের ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সুমনের নাকে ভয়মিশ্রিত এ ঘ্রাণ যেন মৃত্যুরই ঘ্রাণ! ঘোষণা হলো, বড় ইদগাহে ইদের নামাজের পরেই দাদাজানের জানাজা পড়া হবে। মানুষ ইদের আনন্দের পাশাপাশি মৃত্যুভয়ও কি উপলব্ধি করবে? ইদের নমাজ ও জানাজা শেষে সবাই যাবে জীবনের আহ্বানে। দাদাজানের জন্য বাড়ির দক্ষিণ দিকের কবরস্থানে ঘর করা হয়েছে। তিনি যাবেন জীবনের সব দায় মিটিয়ে। তাকে মাটির ঘরে রেখে আত্মীয়স্বজন সবাই চলে যাবে। তিনি থাকবেন একা। বড় একা। কেউ নেই। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা–কেউ না। নাতি-নাতনি না। সুমনও না।



দাদাজানের খাটিয়া নিয়ে যাওয়া হলো বড় ইদগাহে। ছোট বলে সুমনকে সঙ্গে নেয়া হলো না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সে দেখছে। তার বাবাও খাটিয়া কাঁধে নিয়েছেন। বাবার খাটিয়া জানাজার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন ইদগাহে। সেখানে ইদের নামাজও পড়বে সবাই। সুমনের বাবাও পড়বেন। বাবা হারানোর দুঃখ নিয়েই পড়বেন ইদের নমাজ। তারপরে জানাজা। দুই নমাজের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন তিনি? দুই নমাজেই অতিরিক্ত তকবির ধ্বনি দেয়া হয়। ইদের নমাজে ছয়বার। জানাজার নমাজে চারবার। দশবার তাকবির ধ্বনিতে ইদের নমাজ ও জানাজা পার্থক্য করা কি সম্ভব হবে আদৌ? অনাত্মীয়ের কাছে ইদের নমাজের পর জানাজাতেও আনন্দের রেশ থাকবে হয়তো! আর স্বজন হারানো মানুষের কাছে জানাজার আগে ইদের নমাজও হবে মাতমের। আল্লাহ মানুষকে সুখ দুঃখ দুই-ই দিয়েছেন। সুখের সাথে আছে দুঃখ। দুঃখের সাথে সুখ।

ইদের নমাজ ও জানাজা শেষে সবাই ফিরে আসে। সুমনের দাদাজানও আসেন স্বজনদের কাঁধে খাটিয়ায় চড়ে। সুমন তাদের পিছুপিছু কবরস্থানে যায়। ভয় লাগছে তার। এ তো ফড়িঙের কবর নয়। দাদাজান ফড়িঙের কবরে ভয় পেয়েছেন, সুমন তাতে ভয় পায় না! কিন্তু এখন দাদাজানের কবরে সুমন ভয় পাচ্ছে। দাদাজান ভয় পেয়েছেন কি না, সুমন তা জানে না। দাদাজান ভয় পেলেও আজ সুমনের মতো দৌড়ে পালাতে পারবেন না। তিনি আজ মৃত ফড়িঙের মতো। কিছুই করার নেই। অসীম শিশুর খেলায় সে আজ ফড়িং। দাদাজানের মৃতদেহ কবরের মধ্যে রেখে বাঁশের ছাউনি দেয়া হলো। তার ওপর কলাপাতা বিছিয়ে মাটি দিচ্ছে সবাই। মাটি দেয়া শেষে আরো চাপ দিয়ে সমান করে দেয়া হলো কবর। মাটির ঘরের শেষ কাজটুকু হচ্ছে। সুমন হঠাৎ এক দৌড়ে অনেক দূর চলে গেল। তার ভয় লাগছে। দিনের আলো তাকে নির্ভরতা দিতে পারছে না! প্রচণ্ড ভয়। চারিদিকে ভয়! ছুটে ঘরে চলে এলো সে। আজ ইদ। কিন্তু ভয়ের অন্ত নেই সুমনের। দাদাজান যখন মারা যান, সেই মধ্যরাতের মতোই তীব্র অন্ধকার সুমনকে ঘিরে ধরেছে। সে আর কোনোদিন ফড়িং ধরবে না। দিবে না কবর। অমানিশা দূর হয়ে একদিন সুমনের মনেও ইদ আসুক। দাদাজানের সংসারকে ইদের আনন্দে ভরিয়ে তোলাই সুমনের জীবনের ভয়কে জয় করার হাতিয়ার। পরমানন্দ নিয়ে সেও একদিন চলে যাবে এ সংসার ছেড়ে।


লেখাটি শেয়ার করুন

৪ comments

Leave a Reply