
উৎসব
সায়ন্তন সৈকত রায়।।
“যখন নামিবে আঁধার…. কার লেখা বই না…?” চার্জার লাইটটি জ্বালাতে জ্বালাতে ভাবলো অনুপ। ইদানীং এই এক সমস্যা হয়েছে, হঠাৎ হঠাৎ কোন সুর মাথার ভেতরটায় নাড়া দিয়ে বাজতে থাকে কিন্তু ধরা দেয় না। মনে পড়ে না কোন গানে শুনেছিল সুরটি। কিংবা কোন মিষ্টি চেহারার মেয়ের ছলছল চোখ, কোন সিনেমার দৃশ্য তাও মনে পড়েনা। স্বপ্নে পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র পেয়ে যেমন সোজা প্রশ্নেরও উত্তর মনে আসেনা তেমনি এই গান, দৃশ্যও ঠিকমত ধরা দেয় না যেন।
“হালা লাইট নিচের দিকে ফেলি রাখছস কা,উপরে মার!”, তাপসের কর্কশ চিৎকারে অনুপের ভাবনার কথাগুলো অবরোধকালীন রাস্তায় চলা গাড়ির ইটের আঘাতে চুরচুর করে ভাঙা কাঁচের মতই ভেঙে গেল। সন্ধ্যার অন্ধকার আরো গাঢ় করে উপরে চার্জার লাইটের আলো ফেলল সে। আসছে দুর্গাপূজার জন্য পাড়ার ছেলেরা গেট বানাচ্ছে। গতকাল থেকে কাজ আরম্ভ হয়েছে। শহর হিসেবে অত বড় নয় ভারতের সীমান্তঘেঁষা ফেনী। তাই শহরবাসীরা দুয়েকটা পাকা বিল্ডিং আছে এমন গ্রামগুলোকেও শহরের অংশ ভেবে আত্মতৃপ্তি নেয়। শহরে তিন চারটি হিন্দুপাড়া আছে সেই ত্রিপুরা রাজার শাসনামল থেকে। সীমান্ত পেরুলেই তো ত্রিপুরা। আর দুর্গাপুজোগুলো হয় হিন্দুপাড়াগুলোতে আর রং লাগে পুরো শহরে। সেই রং ছড়ানোর কাজের একটি অংশে অনুপরা ব্যস্ত। গতকাল থেকে কাজ আরম্ভ হয়েছে। যদিও প্রতিবছর আরো ছয় সাতদিন পর কাজ আরম্ভ হয় কিন্তু এবার ঘটনা অন্যরকম। মাস্টারপাড়ার কোন এক মেয়ে টুসকুকে বলেছে,”এবার এমপি আর ডিসি আমাদেরকেই সেরা মণ্ডপের পুরষ্কার দিবে।”
টুসকু চমকে উঠে বলেছে,”কেন? কেন?”
টুসকুর বিচলিত হবার কারণ সে মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা না, সে বাঁশপাড়ায় থাকে। বাঁশপাড়ার সম্মানে তার সম্মান, বাঁশপাড়ার অপমানে তার অপমান। তো ঐ মেয়ে বলেছে,”আমরা এমন এক গেইট বানাবো না,দেখে ওরা প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে যাবে। প্রথমে মুগ্ধ হলেই হলো, বাকিটা আরো পাগল করে দেবে।”
এই “মহান কৌশল” সম্বন্ধে জেনেই টুসকু বাসায় ছুটে এসেছে দ্রুত, এসেই তার দাদাকে সবিস্তারে এবং আরো ভয়ানক করে সবকিছু বলেছে, আর তার দাদা কিনা বাঁশপাড়ার ছেলেছোকড়াদের ইভটিজিং হতে বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণসহ যাবতীয় সব কাজের নেতা তাপস রক্ষিত, তাই বাঁশপাড়ার মর্যাদা রক্ষায় গেটটা সেরকম “গর্জিয়াস” হওয়া চাই বলে পুরো পাড়ার ছেলেদের শান্তি গতকাল থেকেই নষ্ট করে দিয়েছে। মেয়েদেরও শান্তি নষ্ট হতো, কিন্তু তারা টুসকুকে তেমন পাত্তা দেয়না তাই তারা ঢিলেমি করেই ভিতরের পুজোমণ্ডপের কাজ করছে।
“কীরে অনুপ,তোদের ‘ইশটাইলিশ’ গেইট কখন হবে?”, অনুপ উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বামপাশে তাকিয়ে সালমাকে দেখতে পেলো। সন্ধ্যার অন্ধকারে মনে হচ্ছে সালমার শাড়িবৃত শরীর থেকে আলো বের হচ্ছে। আরে আজ মনটা এমন ভাবুক হয়ে যাচ্ছে কেন, ভাবলো অনুপ। “কীরে,কথা বলছিস না কেন?”, সালমা আবারো বলল।
“তুইই বা এতো ফটফট করছিস কেন,নিজের কাজে যা!”, উপরে বাঁশের উপর কাপড়গুলো বাঁধতে বাঁধতে বারেক বলল। অনুপ দু’জনের মুখের দিকে তাকাল। সালমা কণ্ঠটা আরো হাসি হাসি করে বলল,”হ্যাঁ, আমরা মেয়েরা তোদের মত আলসে তো! গিয়ে দেখ যা,অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ। আর তোরা কালকে থেকে…” এটুকু বলেই সালমা হিহিহি করে হাসতে লাগল। আলোকময় মুখে এরকম হাসি মানায় না, অনুপ তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে ভিতরের দিকে মণ্ডপ দেখার চেষ্টা করলো। জয়া…জয়শ্রী..জয়ী…সে কি আছে ওখানে?
জয়া! জয়া! জয়া! জয়া! -জবাফুলের মতন এক নাম….
“হিপ হিপ হুররে!” “হিপ হিপ হুররে!” সমবেত চিৎকারে অনুপের যেন চমক ভাঙলো। সবাই ওর আশেপাশে। চার্জার লাইটটিও ওর হাতে নেই। কার কাছে যেন। সবাই গেটটা দেখছে। “আরে গেট কখন হয়ে গেল…সবাই কখন নামল…!”
সেতো ঘুমোয়নি, তবুও এতকিছু চোখ এড়ালো কী করে! ভেবে পেলোনা অনুপ। এ কী ঘোরগ্রস্ততা! আজ দুপুরে যেই জয়া আজাদদের বাড়ির শ্যাওলা পড়া দেয়ালের শ্যাওলা কেটে ইট দিয়ে লিখেছিল, “ভালবাসি!”। তারপর থেকে..তারপর থেকেই অনুপের মনে হচ্ছে…কী মনে হচ্ছে..কী…হঠাৎ ফতুয়াতে টান পড়তে পিছনে তাকাল অনুপ। আর আশপাশ তাকিয়ে দেখল সবাই চলে গেছে আর সেই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। অনুপের অবাক হওয়া উচিত যদিও কিন্তু আগে ফতুয়া কে টানলো দেখা যাক। একটা ছেলে, সারা গায়ে কোন পোশাক নেই বলেই মনে হয়, ভালমত তাকালে অন্ধকার ভেদ করে ওর ময়লা নেংটিমতন পোশাকটি দেখে বুঝা যায় যে ছেলেটি দিগম্বর নয়। বাচ্চাদের ব্যাপারে অনুপের একটি বিশেষ মনস্তত্ত্ব আছে। তার মনে হয় যে বাচ্চা ট্যা ট্যা করে কাঁদে সে দেখতে সুন্দর হলে, গোলগাল হলে মনে হয় সা রে গা মা করছে। কিন্তু জীর্ণ পেটফোলা নাকে সর্দি ঝরা নীরব শিশু চুপচাপ চেয়ে থাকলেও থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে হয়। এই ছেলেটি দ্বিতীয় শ্রেণীর। অনুপ তাই বিরক্ত হল স্বভাবতই।
খেঁকিয়ে বলল,”কী চাই!”
ছেলেটি এধরনের কথাভঙ্গির সাথে হয়তো অভ্যস্ত তাই না চমকে বলল, “পুজা কোনদিন হৈতে আরম্ভ হইবো?”
“কেন তোর তাতে কি?”
“বলেন না!”
অনুপ একটু ভয় পেলো। জঙ্গি দলের চর নয়তো। হাস্যকর ভয় পাওয়া যদিও, কিন্তু…বিরক্তিও বাড়ছে। তা চাপা দেয়ার কোন চেষ্টা না করেই বললো,”গেটের ব্যানারে লেখা আছে,দেখস না!”
ছেলেটি পিটপিট করে কতক্ষণ আবছা অন্ধকারে উপরে দেখলো তারপর ফিক করে হেসে বললো,”আমি কি বিলাই নি যে রাইতে দেখুম।”
“বাব্বা,এই ছেলেতো বিড়ালের রাতে দেখার কথাও জানে”, ভাবলো অনুপ। চর হলেও হতে পারে। মুখে বললো “পুজা সাতাইশ তারিখ।”
ছেলেটি করগুণে হিসেব করে বললো,”আরো পাঁচদিন! ” বলে বড়মানুষি চালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
“তোর এতো আগ্রহ কিসের?”, অনুপের সন্দেহ একদম পাকাপোক্তই হচ্ছে যে ছেলেটি কোন জঙ্গিসংগঠনের চর কিনা। সন্দেহ আর হাস্যকর নয়, দেশজুড়ে যা হচ্ছে। কিছু ভাল লোক না থাকলেতো পুজোই করতে পারতোনা ওরা। অনুপের প্রশ্নের উত্তরে ছেলেটি বললো,”কন কি ভাইয়া!”, হঠাৎ খুশিতে তার দাঁতগুলো দেখা গেলো,”পুজা আইলেইতো বাপ মা ভাই আমার বেকের ইনকাম বাড়ে!”
একটু মজা নেওয়া যাক–ভেবে অনুপ বললো, “কেন, তোদের পুরো গুষ্টি পকেটমার নাকি?”
“আস্তাগাফিরুল্লাহ্!”, বলে ছেলেটি নিজের দু’গালে টুক করে চড়ের ভঙ্গি করে,”তওবা তওবা, আমরা মেহনতি কাম করি!”
নোংরা নেংটিমতন কাপড় পরা ছেলের আত্মসম্মানবোধ দেখে তো অনুপ কৌতুকবোধ করলো। বলল,”তুই লেখাপড়া করিস?”
“হ, রেললাইনের স্কুলে”
কলেজের কিছু ঘরের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানো ছেলে আছে,তারাই রেললাইনের বাচ্চাগুলোকে পড়ায়। অনুপকেও ওদের ক্লাসের মাসুদ ডেকেছিলো। অনুপ বলেছিল,”এমনিতে কম বেতনের একটা মাস্টারির চাকরি খুঁজতে জীবন শেষ, খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে ফ্রি মাস্টারি করব!”। কিন্তু শিক্ষা যে মাসুদরা ভালই দিচ্ছে তাতো বিড়ালের রাতে দেখার বিষয়ে টোকাইয়ের মতন ছেলেটার জ্ঞান দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনুপের ছেলেটার নাম জানতে ইচ্ছে হলো। বললো,”তোর নাম কিরে?”
“মান্না!”, বলেই ছেলেটা চিত্রনায়ক মান্নার অকালমৃত্যু যে ষড়যন্ত্র, এরকম আলোচনা ফাঁদতে বসলো। অনুপ তাকে থামিয়ে আবার বললো, “তোর বাপ মা ভাইয়া এরা কী করে রে?”
“বাপে তো রিকশা চালায়, মায়ে বাসার কামকাজ করে আর ভাই চটপডি বেচে!”, বলেই সে কেমন আনমনা হয়ে যায়, “এই কয়দিন খুব টাইনাটুইনা চলতে হইবো”।
তার হতাশ কণ্ঠস্বরকে উড়িয়ে দিয়ে টিটকিরির স্বরে অনুপ বলল, “কীসের টাইনাটুইনা? তোর বাপেরা যে ডাকাত, ট্রাংকরোড থেকে মহিপাল নেয় বিশ টাকা করে!”
“বাপের ঠ্যাং ঐদিন বড় কাটা কাডসে ভাইয়া! আর মায়ে দিনরাত প্যানপ্যান এটার দাম সেটার দাম কইয়া। হের এক বাসার কাজও ছুটি গেসে। ভাইয়েও একশ টাকা কামাইলে খাইদাই ঘরে আনে ধরেন ত্রিশ টাকা!”
একটু থামে সে,”পুজা আইলে বাবা কষ্টমিষ্ট করি রিকশা চালাইলে কিছু হইবো আরকি, মাও…..” বলে সে হঠাৎ চুপ করে যায়।
“কী,তোর মা কী করবে?”
“না কিসু না।”, হঠাৎই যেন আপাতবাচাল মান্না চুপ করে যায়, তারপর কথা ঘুরাতেই হয়তো গলার আওয়াজ অস্বাভাবিক বড় করে বলে,”আজ ভাইয়ে কত্তগুলা বেলুন আনি দিসে, আমিতো খুশি। ভাবসি আমার লাইগা। ওমা কয়, এগুলা আমার ন, এগুলা বেচন লাইগবো!”
“তাহলে তোর মনখারাপ?” অনুপ জিজ্ঞেস করল।
“না না, টাকা তো পামু। ঈদের ব্যবসা একদিন, পুজার ব্যবসা চাইরদিন আর খিচুড়ি তো যখন তখন খাওন যায়, খালি এই কয়টা দিন…..”
অনুপের হঠাৎ তার ছোটবেলার এক গরিব সহপাঠীর কথা মনে পড়লো। সে সরদারবাড়ির বড় ছেলের ঘড়ি চুরি করাতে স্কুলছাড়া হয়েছিল। আগেও নিয়মিত এটা সেটা হারাচ্ছিলো, সবটার দায় নিয়ে বেচারা বেদম মারও খেয়েছিলো। সে যখন স্কুলে আসতো তখন স্কুল ছুটির পরও বাড়ি যেতোনা। স্কুলের বাগানে যখন যে ফল ফলতো তা খেতো বসে বসে আর বলতো, “বাড়িতে ভাত নাই, গিয়া কিরুম? খাডা নি খামু!”। পড়ালেখার বড় শখ ছিলো আবার ছেলেটার। কী যেন নাম ছিলো ওর…. কী জানি…স্বরে অ দিয়েই তো…! অনুপ বামপকেটে হাত ঢুকালো। কিছু দেয়া দরকার মান্নাকে। দুইটাকার কয়েন ছাড়া কিছু নেই ওটায়। ডানপকেটটা অনেক ফোলা কিন্তু সেখানে সব পূজার আমন্ত্রণ লিফলেট। সকালে পাঁচশো টাকা পকেটে ছিলো। তিনশো লিফলেটে,পঞ্চাশ করিম স্যারকে খাওয়ানো, দশ দশ বিশ রিকশাভাড়া আর বাকিটা…..জয়া! আজ সারারাত জয়ার সাথে স্বপ্ন স্বপ্ন কথা বলবে তাই মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড হয়েছে টাকাগুলো। মান্না অনুপকে পকেটে হাত ঢোকাতে দেখে আশান্বিত হয়েছিল, কিন্তু তার উদাস অন্যদিকে তাকানো দৃষ্টি দেখে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা সহজভাবে মেনে নিয়েই যেন অদ্ভুতকণ্ঠে বললো, “ভাইয়া যাই!”
অনুপ তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবলো,”টাকা টাকা টাকা টাকা টায়া টয়া জয়া জয়া জয়া জয়া জয়া…”।
পকেটে বাম হাত ঢুকিয়ে দুই টাকার কয়েনটি শক্ত করে ধরলো সে। যেন ঐ কয়েনই জয়া। বাড়ির পথ ধরলো সে। জয়াকে কল করতে হবে। অনেক কথা বলতে হবে। এই ছেলেটার গল্প কি করা যায়, জয়া কি কষ্ট পাবে,জয়াকে কি বানিয়ে সে বলবে ছেলেটাকে সে তিনশো টাকা দিয়েছে, জয়া অভিভূত হবে। আরো ভালবাসবে। ফোনে স্মুচ শব্দের স্ফুরণ ঘটিয়ে চুমু খাবে প্রতীকীভাবে।
আচ্ছা, মিথ্যে বলা যায়তো এই দেবীপক্ষে….?