সুদীপ ঘোষাল

এক নারী ও রাজার কাহিনী: দ্বিতীয় পর্ব

উপন্যাস
লেখাটি শেয়ার করুন

সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।

 

সংসারে কর্তব্য করে যায় এক জাতীয় মানুষ। তারা নিজের আবেগ,ভালোবাসা বিসর্জন দেয় সকলের জন্য। আর এক জাতীয় মানুষ তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার ক’রে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। সন্তু এবার বাড়ির কাছে চলে এলো। খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় সকাল দশটায়।

মা খুব খুশি সন্তুর। বিয়েতে ভালো পাওনা। চাকরী পাওয়া ছেলে। কুড়ি ভরি সোনা।

সন্তুর বিয়েতে কলিগরা সবাই এসেছে। মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোনে পাপিয়ার গলা। বলছে,বজ আমার বিয়ে সন্তুদা। তুমি ভালো থেকো। সন্তু ফোনটা কেটে দিলো। কেউ শুনতে পেলে অসুবিধা হবে। মনকে শক্ত বেড়ি পরিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলো। বিয়ে হয়ে গেলো। শেষ রাতে অর্ধেক চাঁদের আলোয় সন্তু পাপিয়াকে দেখলো বাগানের মধ্যে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। আজ বিয়ের পরদিন। কালরাত্রি। বৌয়ের মুখ দেখতে নেই।

ফুলের শয্যায় কাঁটা। বৌ জয়ার শরীর খারাপ। সন্তুর বন্ধুরা পরের দিন বললো,নতুন অভিজ্ঞতা কেমন হলো? সন্তু বললো,ভাগ্য প্রসন্ন নয়। অপেক্ষায় আছি। বন্ধুরা হতাশ।

তারপর খাড়া বড়ি থোর,থোর বড়ি খাড়া।  মামূলী জীবন। চাকরী। দিন কাবার। রাত। ভোর।রান্না।চান।জপ।খাওয়া।সাইকেল। অফিস।

মা বললেন,বোনেদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি
দুই বোনের একই দিনে বিয়ের ঠিক করেছি। তুমি লোন নাও।বৌমার গহনাগুলো দাও।মায়ের কথা অনুযায়ী সব কিছি হলো। জয়া সব সোনা দিয়ে দিলো। দুটো ননদের বিয়ে হলো।

বড় ভাই লন্ডন চলে গেলো সবাইকে ফেলে। ভালো চাকরী পেয়েছে। ছোটোভাই গ্রামেই একটি মেয়েকে প্রেম করে বিয়ে করলো। ভালো চাকরী পেয়ে কলকাতায় চলে গেলো। সন্তু খুশি। মাও খুশি। মা বললেন,সবাই ভালো থাকলেই ভালো। মা কিন্তু সন্তুর কাছেই থাকলেন। স্বামীর ভিটে তার কাছে স্ব র্গ। আর কোথাও তার ভালো লাগে না।

সন্তুর এখন এক ছেলে ও দুই মেয়ে। মাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রুমকি ও ঝুমকি দুই মেয়ে। রুমকি এখন ক্লাস টেনে পড়ে আর ঝুমকি সেভেনে। দুজনেই এক গৃহশিক্ষ কের কাছে পড়তো। রুমকি সেন্ট আপ হলো। কিন্তু ঝুমকি আ্যনুয়াল পরীক্ষায় ফেল করলো। সন্তু আর জয়া খুব বকাবকি করলো। বললো,সারা বছর পড়বি না, তাহলে ফেল করবি না তো কি? গৃহশিক্ষক বললো,যা, গলায় দড়ি দেগা। ফেল করে বসে আছে। ঝুমকির মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। বাড়ির সবাই জানে কিন্তু কেউ একবারও তাকে ডাকলো না। ঝুমকি ভাবলো,কেউ আমাকে চায় না। ভালোবাসে না। সে শুনতে পেলো কে যেনো বলছে গলায় দড়ি দিয়ে মর। সব ঠিক হয়ে যাবে। কে বলছে? সে ভাবলো ঠিকই বলেছে। আমি খারাপ মেয়ে। গৃহশিক্ষক অজয় আমার যৌনাঙ্গে আঙুল দিয়ে রক্তাক্ত করে বলেছিলো। পড়াশোনা তোর হবে না। এইসবই হবে। গলায় দড়ি দেগা। অজয়ের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেয়েছিলো। কাউকে বললে, প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলো। সেদিন তার দিদি ছিলো না। দিদিকেও হয়তো ভয় দেখিয়েছে।আবার ভাবছে, আমি মরে গেলে ওই মাতালটা আরও অনেক মেয়েকে মারবে। কিন্তু ওর বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। বাবা, মা পর্যন্ত আমাকে ডাকলো না। আমার খিদে পেয়েছে। একবারও ডাকলো না। ভাবতে ভাবতে তার ওড়নাটা গলায় গিঁট দিলো। খুব লাগছে। তারপর মাটির ঘরের কড়িকাঠে, ওড়নাটা, পেঁচিয়ে নিলো চেয়ারের ওপর উঠে।তারপর চেয়ারটা লাথি দিয়ে সরিয়ে ঝুলে পরলো। তারপর ভাবছে। কেন করলো এই কাজ। খুব ভুল করলো। মা বাবার মুখ মনে পরলো তার।

সন্ধেবেলায় সন্তু এসে জয়াকে বললো,মেয়েটা খেয়েছে?ঘর খুলেছে?
জয়া বললো,জানিনা, যাও তুমি দেখো।

ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়েটা ঝুলছে। সন্তু ভাবে, এই সময় মা থাকলে ভালো হতো। মা ছোটো ভাইয়ের বাড়ি কেন গেলো?
সন্তুর শরীর কাঁপছে থর থর করে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।

জয়া দেখতে এলো স্বামীকে, ধপ করে একটা আওয়াজ শুনে। এসে দেখলো,সন্তু অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। জয়া দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে, ঝুলছে। বাড়ির আশেপাশে যারা ছিলো তাদের চিৎকার করে ডাকলো জয়া। লোকজন এলো।দরজা ভাঙলো। মৃতদেহ নিয়ে চলে গেলো দাহকাজে।

সন্তু আর জয়া দুবছর রাতে ঘুমোতে পারে নি। একটা অপরাধবোধ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। হয়তো তাদের ভুলে মেয়েটা অভিমানে চলে গেলো অকালে। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলো সন্তু।

জয়া ভাবে তার জন্মকালের কথা। মায়ের মুখে শুনেছে,জন্মমাত্রই তাকে মৃত মনে করে বাড়ির লোকজন ফেলে দিয়েছিলো বাঁশতলায়। আঁতুড় ফেলার জায়গায়। বাগ্দীবুড়ি দেখতে পেয়েছিলো জ্যান্ত মেয়েটাকে।হাত, পা নড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলো কোলে। খবর ছড়িয়ে পরলো গ্রামে। তখন বাড়ির লোক এসে নিয়ে যায় মেয়ে। বাগ্দীবুড়ি নাম রেখেছিলো জয়া। ও তাদের বাড়ি এসে বলেছিলো,ও জীবন জয় করেছে। তাই ওর নাম জয়া। তারপর জয়া বড়ো হলো। কালো মেয়ে আলো রূপ নিয়ে ভরতি হলো স্কুলে। পড়াশোনায় খুব ভালো। অন্যদের থেকে আলাদা। নীরব শিল্পীর মতো তার স্বভাব। সবাই ভালো বলতো তাকে। তারপর কলেজে ভরতি হলো। কিন্তু কলেজে পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হলো। তিন সন্তানের জননী হলো। কাজ হলো হাঁড়ি ঠেলা। আত্মীয়স্বজনের কাছে ভালো হবার ব্যর্থ  চেষ্টা। কম বয়সে শিখলো অনেক। শক্তি জাগ্রত হলো শরীরে,মনে। সহজ পথে চলা শুরু হলো। তেল মাখানো কথাও বন্ধ হলো। শত্রু বাড়লো। তবু সে বললো,কুছ পরোয়া নেহি।

একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব কঠিন কাজ হাসিমুখে করতে পারে। দশভূজা দুর্গা। স্বামীর অফিসের রান্না,ছেলে মেয়েদের স্কুল পাঠানোর পরে বাসনমাজা,কাপড়কাচা ও আরও কত কি? দুপুরবেলা বই নিয়ে  বসে ঘুমে ঢুলে পরতো জয়া। আবার কোনো কোনো দিন ভাবনার সাগরে ডুব দিতো অনায়াসে। মনে পরতো কিশোরীবেলার স্কুলের পথে আলপথের ধারে ক্যানেলের জলে রং বেরংয়ের মাছের কথা। গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতো বায়েনবুড়ো কত মাছ। বায়েন বুড়োর কাছে চেয়ে একটা বোতলে ভরে রাখতো জল। আর তাতে সাঁতার কাটতো ছোটো ছোটো তেচোখা মাছ। পুকুরের ধারে বসতো বুড়ি গিন্নির ছাই দিয়ে বাসন মাজা দেখতে। কি ভালো যে লাগতো। মনে হতো দিই বুড়ির বাসন মেজে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারে নি কোনোদিন। সন্ধেবেলা সিধুকাকা পড়াতে আসতো। আমরা মেয়েরা সুর করে পড়তাম একসাথে। তারপর খাওয়ার পরে শোওয়ার পালা। ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুনতাম পুরোনো দিনের কত গল্প। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পরতাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে। জয়া এইসব ভাবতো আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতো ঘাটে। স্বামী,ছেলে,মেয়েরা চলে আসতো জয়ার স্বপ্ন নীড়ে।  আবার শুরু হতো সংসারের ঘানিটানা কলুর বলদের মতো। দুঃখ,সুখের অপূর্ব মিশ্রণে বয়স কাঁটা এগিয়ে চলে টিক টিক শব্দে।


সন্তু মেয়ের বিয়ে দিলো। তারপর গ্রাম ছেড়ে চলে এলো কোয়ার্টারে। গ্রামের বাড়িতে সবখানে ভেসে উঠতো মৃত মেয়ের মুখ। তাই এই সিদ্ধান্ত। কোয়ার্টারে সন্তুর মন হাঁপিয়ে উঠতো। অফিসে ছুটি পেলেই চলে যেতো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সেখানে বড়ো মেয়ের মুখ দেখে ভুলে যেতো মৃত মেয়ের মুখ। আর দুই মেয়ের মুখের আদলে দুবছর পরে ঘর আলো করে এলো নাতি। মেয়ের পুত্রসন্তানের মুখ দেখে সন্তু ও জয়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো।

নাতি ও মেয়ে এসে দুমাস, তিনমাস করে থাকতো কোয়ার্টারে। এবার মন শক্ত করে সন্তু ফিরে এলো গ্রামের বাড়িতে। কোয়ার্টারে তার মন ভারী হয়ে যেতো। নিজেকে হারিয়ে ফেলতো বারে বারে। এবার গ্রামে এসে পুরোনো বন্ধুদের মাঝে সন্তু জীবন খুঁজে পেলো। সব কিছু স্বাভাবিক হলো।

এক নারী ও রাজার কাহিনী: তৃতীয় পর্ব


লেখাটি শেয়ার করুন

One thought on “এক নারী ও রাজার কাহিনী: দ্বিতীয় পর্ব

Leave a Reply