জয়িতা ভট্টাচার্য

ডানা

মুক্তগদ্য
লেখাটি শেয়ার করুন

জয়িতা ভট্টাচার্য,
গড়িয়া, কলকাতা।

 

জলভরা মেঘের গুম গুম আর আকাশে চারকোল পেন্ট, ক্যানভাসে  কোনোটা প্যাগাসাস, মিলনুন্মুখ নারী পুরুষ, দানব অথবা দৈত্যের ঘোরাঘুরি। আমার সামনে একটা চওড়া নদী, অতল। ওপার দেখা যায় না। শ্যাওলার ফ্রেমে ঘাট, ওখানে  বাঁধা আছে একটি ফুটো নৌকো। আমাকে এই নৌকায় পার হয়ে যেতে হবে ওপারে।
ময়দানে একা ক্যাপ্টেন যার স্কোরবোর্ডে শূন্য। অনিবার্য পরাজয় স্থির হয়ে আছে। ঝড় উঠেছে, যেন দর্শকের অট্টহাসি বেকায়দায় হেরো খেলোয়াড়কে।
দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকার খাদের পাশে, পতনের কথা সবাই জানে।
সতের বছরের একটি ফুটন্ত যুবতী বা আধা কৈশোর প্রবেশ করে ধ্বংসের আঙিনায়। মাথা ভরা সিঁদুর, হাতে ল্যাটা মাছ সে ভয়ে ভয়ে ধরে আছে পায়ের পাতা ডুববে এবার ফুটন্ত লালচে দুধে, ভয়। ভয়ানক ভয়।
মিলনের ফুলশয্যার রাত কেটে যায় কথায় কথায় নানা প্রয়াসে, দক্ষিনের জানলা দিয়ে শীতল রাতের বাতাস ক্রমশ লালচে হয় পূবের জানলায়। প্রেম কাকে বলে জানে না মেয়ে। সঙ্গম পটিয়সি নয় সে। সে গাছে চড়তে পারে, সে বিলের ধারে বসে বাঁশি শোনে, স্কুলের মাঠে বন্ধু র সঙ্গে আইসক্রিম ভাগ করে খায় একই কাপ থেকে, সে বালিকা বয়সে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে বিষবৃক্ষ। তার প্রেমিক শ্রীকান্ত র বন্ধু ইন্দ্রনাথ।
এখন শুধু জল পড়ে চোখে নীরবে কিছু অচেনা মানুষের মাঝে। ওরা মুখোশ পরে ছিল। ওরা ছদ্মবেশী ছিল। মা ,বাবা, ছোট্ট ভাইটাকে ছেড়ে কখনও থাকেনি সে।


জৈবিক ক্রিয়ার মাদকতার পর জানাজানি হয়ে যায় ছেলেটির দণ্ড কঠিন হয় বটে তবে শিরদণ্ডটি নেই। ভুয়ো কাগজ আর মিথ্যা কমিটমেন্টের অতুলনীয় অভিনয়ে সে বিবাহ করে ফেলেছে এক সরল মেয়ে কে। প্রতারণা করেছে ছাপোষা মা আর বাবার আরো সরল একটি প্রায় কিশোরীর জীবন।
আইনগত ভাবে বিবাহটা “নাল ন ভয়েড” হওয়ার কথা। কিন্তু অমন ত অনেক কথাই থাকে বিচারের বইতে। সামাজিক অনুশাসন বলে নারী হবে অবনত।কম্প্রোমাইজ এণ্ড কম্প্রোমাইজ এণ্ড কম্প্রোমাইজ …
মেয়েটি ক্রমশ তার গুণধর স্বামীর নানা গুণ টের পায়, শশুরবাড়ি র বিদ্রুপ সহ্য করে। স্বামীর সন্দেহবাতিক মানে ভালোবাসার নামান্তর একথা শুনে ফেরে মা- র বাড়ি থেকে।
সেইসব দিনে নেই কোনো মোবাইল, মেয়েটি যায় মেয়ে কলেজে, গোপনে নজর রাখে পতিদেবতাটি।
আদরিনী হঠাৎ দরিদ্র সংসারে অনাদরে। প্রতিদিন শাশুড়ির ragging চলে।
প্রথম ঝড়ে সাঁকো নড়বড়ে। মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ, দেহের ওপর নিরলস ব্লেডের কাটাছেঁড়া, অশ্রু জলের প্লাবন শেষে থমথমে দিন আসে যেদিন উঠে দাঁড়াবে এক পূর্ণ যুবতী। ততদিনে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, রাজনীতি, আবার পড়া এবং আবারও পড়া। পড়াশোনা শেষ হলেই যেন দুঃস্বপ্ন ফিরে আসবে।
মস্তিষ্ক উপদেশ দেয়, আছে যখন কাজে লাগুক। তামসিক কাজটুকু করুক। ব্যবহার করা যাক প্রজননে। মাতৃত্ব যাকে দেবে এক সোনালী আলোর পথ, দেবে আত্মবিশ্বাস, দেবে শক্তি যা আগে সে পারেনি এখন সে পারে।
এক একটি রাতে টুপটাপ খসে পড়ে শিশিরের মত শাশুড়ি ও শশুর একদিন। ততদিনে তারা শিবির বদলে পুত্রবধূর। টাকার স্বাদ বড় মিঠে যে!
ট্রেড ইউনিয়ন করা কম্যনিস্ট শশুরের মুখে ও কাজে নানা বৈপরীত্য, ঘরে ও বাইরে।
মেয়েটি এখন যুবতী দিদিমণি।
চাকাটা ঘুরছে। চাকার তলায় পিষ্ট হচ্ছে  রক্ত মাংস আর ঘামের সঙ্গে মন এবং স্বপ্নেরা।
মেয়েটি নারী হয়ে ওঠে। ক্রমে  স্ত্রী ও মাতৃত্বের  বেড়াজাল ডিঙিয়ে যেতে চায়।
ব্যবধান বাড়ে জলে আর আগুনে। নদীতে চরা পড়ে।
শেকড়ে গলদ। পোকা ধরে নিঃশব্দে দাম্পত্যে।
শব্দরা আসে মনের ঘরে আর ফিরে যায় অভিমান করে। কাগজ কলম মুখ ভার করে থাকে। আর কতদিন!
করতে হবেই কিছু। মনে মনে ভাবে মেয়েটি।
পেটের অন্ন সংস্থান আর ছেলে মানুষ করার জন্য জন্ম হয়নি তার। নিজের সঙ্গে ছলনা নিজেকে প্রবঞ্চনা আর কতদিন!
তাই একদিন আবার বৃষ্টি আসে। কলম আর কাগজের দেখাশোনা হয়।
সে তার ভাঙা চোরা গাড়িখানা  নিয়ে চলে ব্যতিক্রমী পথে, “The road not taken” যে পথ এড়িয়ে চলে সকলে, পাথর বিছানো ক্যাকটাস আর অনাঘ্রাত বুনো ফুলের একা পথে প্রবাহিত নদী।
বেকার ও অলসজীবন ও নেশা, বউয়ের চরিত্র গবেষণা ছাড়া আর কাজ নেই তার। তবুও ঘষটে ঘষটে চলে চাকা। তারপরেও পতি পরমেশ্বর শুরু করে নানা অসামাজিক কাজ মেয়েটির অজ্ঞাতে। এক অসুস্থ মলিন আলোয় বড় হতে থাকে দুই সন্তান। তারা ভর্ৎসনা করে মায়ের এই মিছে ঘর- কন্না খেলার ভানকে।তারা সাহস জোগায়। সে নিজেও ভাবে এবার খোলোস পাল্টে ফেলবে।
ভয় আর সমাজের রক্ত চক্ষু, নিন্দা আর সমালোচনা উড়িয়ে দেয় খোলা মাঠে কালবোশেখির ঝড়ে একদিন।
আসে প্রতিরোধের ঢেউ, অভিশাপ, কলঙ্কের সতর্কতা কিন্তু মেয়েটি এখন দৃঢ় প্রত্যয়, কঠিন সেগুন গাছ। সে আকাশ দেখে। সেখানে সোনালী চিল। মুক্ত স্বাধীন নীলাকাশ।
এবার নারীটি স্বয়ম্ভর এবার সে আগুনে পুড়ে ইস্পাত।
নতুন পদক্ষেপ রাখে আত্মবিশ্বাসী এক নারী জীবনের পথে, একা এবং মুক্ত। ডানা মেলে সীমানা ছাড়িয়ে নীলিমায়।



লেখাটি শেয়ার করুন

২ comments

Leave a Reply