আরমান হোসাইন অন্তর

মানবিক প্রেম

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

আরমান হোসাইন (অন্তর)।।

 

দুপুর ২:১০ মিনিট।

ঠিকঠাক না খেয়ে আপন বিরাট ব্যস্ত হয়ে উঠলো বাইরে যেতে। ৩টায় তার হাসপাতালে থাকতে হবে। সম্ভবপর আগেভাগে গেলে উত্তম। রক্ত দেয়ার আগে বিশ্রাম নেয়াটা কোথাও লিখিত নাহলেও আপনের জন্য শতভাগ প্রস্তুতিতে উপযুক্ত।

তাড়াহুড়োয় নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গেলো আপন। রোগীর আত্মীয়ের সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে কাঙ্খিত কাজে পা বাড়ালো। রোগীর এই আত্মীয় আপনের পছন্দনীয় এক ক্লাসমেটের দুঃসম্পর্কের ভাই।

বিল্ডিংয়ের গায়ে সাইনবোর্ডে ঝোলানো পুরো হাসপাতাল খুঁজে একজন মাত্র নার্সকে পাওয়া গেলো। তিনি আবার ল্যাবের টেকনিশিয়ান। সুতরাং রক্ত আপন দিবে, রোগীও আছে কিন্তু নেয়ার লোক নাই।

এদিকে রোগীর অবস্থা খুব একটা ভালো না৷ কি যেন রোগের কথা বলল অন্তত ১৭ ব্যাগ রক্ত লাগবে। আপন ৪ নম্বর। স্বভাবতই আত্মীয় উদ্বিগ্নতায় ডাক্তার–নার্স খোঁজাখুঁজি করলো। তারপর আপনকে বলল, “একটু বসেন। উনি এসেই ডাকবে।”



যাক তবে। আপন একান্ত আপন মনে খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর ল্যাবের সেই টেকনিশিয়ান আসলো। আত্মীয়কে ডেকে রক্তদাতাকে ভিতরে যেতে বলল। আপন এগিয়ে গেলো। অথচ আপনকে দেখেই সে নার্স রুদ্রমূর্তি ধারণ করলো! আপনকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার ওজন জানেন তো?”

আপন বুঝতে পারলো সেবিকা কোথায় ইঙ্গিত করেছে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সরাসরি ইঙ্গিত স্থলে বলল, “নিয়মিত রক্ত দেই আমি।”

নার্স নমনীয় না হয়ে কেমন সন্দেহপ্রবন হয়ে উঠলো। বলল, “রক্ত দেন ঠিকাছে। এখন কত ওজন আপনার?”

আপন বীরদর্পে জানান দিলো, “৫৫ কেজি।”

এবার সে নার্স খানিক বিরক্ত হল। কপালে বিরক্তির ভাঁজ নিয়ে বলল, “রক্ত নেয়া যাবে না। অন্য কাউকে আসতে বলেন!”

রোগী আপনের বিশেষ পছন্দনীয় সুন্দরী ক্লাসমেটের আত্মীয়। রক্ত না দিতে পারাটা তার জন্য মান হানিকর। সে নরম গলায় বলল, “দেখেন, আমি নিয়মিত রক্ত দেই। ওজন কমবেশি হোক, আমার সমস্যা নাই। আপনি নিতে পারেন।”

এই শুনে নার্স ক্ষেপে উঠলো। কিন্তু শান্তস্বরে বলল, “বেশি বোঝেন কেন? নেয়ার হলে নিয়ে নিতাম। ওনার (রোগী) রক্ত লাগবে না, লাগবে প্লাটিলেট। ৬০ কেজির নিচে নেয়া যাবে না।”



একে তো মেয়ে, তার ওপর শান্ত–ভদ্র ব্যবহার, চাইলেও উচ্চবাচ্য করতে না পেরে কি করা যায় তাই ভাবতে লাগলো। রক্ত লাগুক আর প্লাটিলেট লাগুক আজকে দিয়ে যেতেই হবে। এদিকে রোগীর ভাই মোটামুটি চিন্তিত হয়ে পরেছেন। চাইলেই মুহূর্তে রক্তদাতা জোগাড় করা যায় না। কিন্তু আপনকে চিন্তার বিষয় বুঝতে দিতে চাইছেন না। আপন তাই আগ বাড়িয়ে বলল, “রক্ত কি আজকেই লাগবে?”

রোগীর ভাই মোটামুটি ইতিহাস টেনে দুঃখিতস্বরে বলল, “প্রতিদিন এক ব্যাগ করে লাগে।”

আপন ‘ঠিকাছে’ বলে বাইরে চলে গেলো। কি করা যায়, কাকে পাওয়া যায় এইসব ভাবতে ভাবতে এক বন্ধুকে স্মরণ হলো। সাথে সাথে ফোনে যোগাযোগ। বন্ধু পরম মানবিক। শুনে আসতে রাজি হলো। কিন্তু কিছু সময় চলে যাবে তার পৌঁছোতে। তাও সে আসুক।

রোগীর ভাইকে জানালো রক্তদাতা আসছে। একটু সময় লাগবে, এই আরকি। সে ভাই ইতঃস্তত পূর্বক জিজ্ঞেস করলো, “ওনার ওজন কত…? মানে ঠিকাছে তো?”

আপন অভয়ের সুরে, “ও মেশিনে উঠলে, মেশিন ভাঙ্গবে।” বলে হেসে দিলো। রোগীর ভাইও নিশ্চিন্ত হলো। কিন্তু তুলনামূলক কম সময়েই সে বন্ধু এসে গেলো। কিন্তু এখানে আবার রক্তদাতা আসলেই রক্ত নেয়া হয় না। নার্স আপার সময় হলে তবেই রক্ত দেয়া যায়।

তাড়াতাড়ি নার্স আপাকে সম্বোধন করতে চললো রোগীর ভাই। নার্স প্রায়শই ল্যাবে ব্যস্ত থাকে। আপন দেখলো নার্সকে ডাকা মাত্রই সে ছুটে আসলো। ডোনার জোগাড় হওয়ায় সেও বোধহয় খানিক উৎকণ্ঠা নিয়ে ডোনার দেখতে এসেছে।

আপন কিছুটা অপরাধী, কিছুটা অভিমানী আবার কিছুটা হাসি হাসি মুখ নিয়ে বসে আছে রক্ত নেয়ার কক্ষের সম্মুখ বরাবর। নতুন রক্তদাতা চলে গেছে রক্ত দিতে। ক্রস-ম্যাচ হবে, তারপর রক্ত নেয়া হবে। যে নার্স তাকে আজ বেইজ্জতি করেছে, আপনের দীর্ঘদেহী রক্তদাতা বন্ধুকে দেখে সে নার্স আপার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল তা ভাবতে চাইলো আনমনে।



এরমধ্যে রক্ত ক্রস-ম্যাচিং এর জন্য চলে গেছে। আপন খানিক নির্ভার হলো। হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় চারপাশ দেখে বিজয়ী ভঙ্গিমায় আবারও বসে পড়লো। খানিকক্ষণ সময়ই তো। একটু পরই নার্স আবার ডাকবে, তার একটু পর চলে যাবে।

কিন্তু খানিকক্ষণ যে কতক্ষণে হয়, আপনের ভাবনায় ছিল না। ক্রস-ম্যাচ করার পর থেকে রোগীর ভাই সহ আপনের বন্ধু বারংবার নার্সকে রক্ত নেয়ার জন্য বললেও নার্স ভ্রুক্ষেপহীন সময়ক্ষেপন করতে লাগলো। তার কিছুক্ষণ পর অপেক্ষায় রোগীর সে ভাইকে পাশের চেয়ারে ঘুমাতে দেখে মেজাজ চড়াও হয়েছিল ঠিক কিন্তু নার্সের সাথে উদ্যত আচরণের ফলাফল যে ভালোর চেয়ে ঢের খারাপই হবে। তাই এ-ব্যাপারে আর এগোতে পারলো না আপন।

অপেক্ষার পর অপেক্ষায় সন্ধ্যার কিছু আগে আপনের বন্ধুকে ডেকে নেয়া হলো। এবং আপন চূড়ান্ত বিজয়ের সন্নিকটে এসেছে বলে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চাইলো। ক্লান্তিতে তখনও রোগীর ভাই নিরবচ্ছিন্ন ঘুমে চেয়ার লেপ্টে আছে।

কিন্তু এবারও আপনের ভাবনাকে ব্যর্থ করে নার্সের রক্ত নেয়া আর শেষ হলো না। এবার আপনও ঘুমিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু দায়িত্বহীনতা প্রকাশের লজ্জা থেকে বাঁচতে হাতে–পায়ে ঠেলে জেগে রইলো। ভেতরে আপনের বন্ধু পেলো নার্সকে, রোগীর ভাই পেলো ঘুমকে। নিঃসঙ্গ আপন নার্সের প্রতি রাগ আর ক্ষোভ পুষতে লাগলো। ভাবতে লাগলো, নার্সকে আজ কিছু বলতেই হবে। নয়তো সে প্রতিনিয়তই সবার সাথে এমনটা করবে।

বাইরে মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। অথচ তখনও রক্ত দেয়া হয়নি। অজ্ঞাত কারণে ক্ষোভ থেকে আপন কিছুটা নমনীয় হতে চললো। ভাবলো, নার্সকে কড়া কথা বলা যাবে না। শত হলেও সে মানুষের উপকারই করে।



আপন নার্সকে মনে করতে চাইলো। “আরেহ, তারাহুরোয় তাকে ঠিকমতো দেখাই হলো না। রক্ত দেই বা না দেই, অন্তত পরিচয় হওয়া যেতো..” বলে একাই ভাবতে লাগলো নার্সের সাথে অন্তত কথা বলে আসা উচিত হবে। নয়তো অমানবিক মনে করতে পারে!

এদিকে সে মহীয়সী নার্স যেন সময়ের ইজারা নিয়েছে। মাগরিব শেষে এশার সময় হয়েছে অথচ বন্ধুর খবর নাই। রক্ত আসলে কার লাগছে আর কারটা কে নিচ্ছে, এই নিয়ে ফের বিরক্তির সীমানা অতিক্রম করলো আপনের। এবং তার কিছুক্ষণ পর মাত্র ১০০ এমএল প্লাটিলেট দিয়ে মুখে দাঁত ভাঙা হাসি নিয়ে বের হলো আপনের বন্ধু।

বেশ। অবশেষে কাজ হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফুঁকে চলে আসার সময় আপনের ইচ্ছে হলো নার্সকে একটু অস্বস্তিতে ফেলতে। খানিক বিরক্ত করতে! রোগীর ভাই ও তার বন্ধুকে বাইরে রেখে শেষবারের মতো হাসপাতালে ঢুকলো আপন। সোজা নার্সের সেই কক্ষে গেলে নার্স পরম স্নেহময় কণ্ঠে বলল, “আপনি যাননি এখনো?”

আপনের ভেতরটা নড়েচড়ে গেলো! নার্স সম্পর্কে আপনের ভাবনা মুহূর্তেই উল্টে গেলো। তবু উস্কানী দিয়ে সে বলল, “চলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার কথা মনে পড়তে আবার ফিরে আসলাম।”

কথা শুনে নার্সের চোখদুটো চকচক করে উঠলো। কিন্তু বলল না কিছু। সুদৃষ্টি পেয়ে নার্সকে বিরক্ত করতে আপন ফের বলল, “কিভাবে যাই বলুন। আসলে, আপনাকে ভালো লেগে গেছে।”

তবুও নার্স কিছু বলল না। যেন আরো কিছু শোনার পায়তারা তার। আপনও বদ্ধপরিকর, অযথা যে সময়টা আজ নার্স নষ্ট করেছে, প্রতিশোধ হিসেবে নার্সকে বিব্রত করতেই হবে। খানিক বাদে আপনই তাই আমতা আমতা করে মাথা চুলকানো ভঙ্গিতে বিরক্তির ইঙ্গিতমূলক বহিঃপ্রকাশ করে বলল, “আপনাকে না ভালবেসে ফেলেছি!”

আপন যেন নার্সের মনের কথাটাই বলল। যেই না বলল, অমনি নার্স আপনের হাত ধরে ফেলল। বক্রো হাসি হেসে বলল, “আরে আরে, কই যাও..। আমিও তোমারে ভালবাসি!”



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply