মিলনের পথে: দ্বাদশ পর্ব
সুদীপ ঘোষাল,
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ।
যদি একবার অরিন্দম তাকে যাত্রা দেখতে যেতে বলে তাে খুব ভাল বাড়ী থেকে বাবা, মা, দাদা ও বৌদিকে প্রণাম করে তাড়াতাড়ি গােপালবাপুর বই। এসেছে। যাত্রা করতে যাওয়ার পূবে অরিন্দম গোপাল বাবুর কাছে আর একম দিয়ে নেয়।অরিন্দম এসেই দেখে অপরূপা সামনের বারান্দায় একটা চেয়ারে সে কি মনে করে অপরূপাকে জিজ্ঞাসা করল আপনি আমাদের যাত্রা দেখাতে যাকেন। অপরূপা জানতাে অরিন্দম ও তার মধ্যে যেন কোথায় একটা বলেন সে ধীরে গড়ে উঠেছে। অরিন্দমকে তার শুধু ভালাে লাগে তাই নয় ভালাে। কিন্তু অপরূপা একজন গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা ছিল। সেদিন সে অরিনের অভিনয় দেখে সেইদিন থেকেই সে তার প্রেমে পড়ে যায়। সুদর্শন সান্যালের পরিচয় আপনারা জানেন।
একজন ভালাে অভিনেতা বলে তার মনে গর্বের অন্ত ছিল না। সে দেখতে ভালো হলেও অন্তরটা তার ভালো ছিল। যেদিন থেকেঅরিন্দমের যাত্রা গানের নাম প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে সেইদিন থেকেই কেন অরিন্দম তার প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেনে তেন প্রকারেণ অরিন্দমের ক্ষতিই যেনতার প্রধান কাজ। সবসময় সে তার বদনাম করে বেড়ায়। অপরূপা অরিন্দমকে পরীক্ষা করার জন্যে প্রঘমে বললাে, না আজ শীরটা। ভালাে নেই। আজ বােধহয় যাওয়া হবে না। অরিন্দম এই প্রথম অপরূপার হাতে হাত দিয়ে দেখলাে তার উত্তাপ স্বাভাবিক। অপরূপার দুষ্টুমি বুঝতে পেরে সে চলে যাচ্ছিল।
অপরূপা ডাকলাে, শােন অরিদা আমি যাব, তােমার সঙ্গে যাবাে। অরিন্দম এতটা প্রস্তুত ছিল না। আপরূপার মুখে ‘তুমি আমি শুনে যেন অপূর্ব অনুভূতিতে তার মন শিউরে উঠলাে। অরিন্দম বললাে, তাহলে আমরা প্রথম দলের যাত্রাই দেখতে যাবাে। অপরূপা এতে খুব খুশী হলাে।কারণ সে যাত্রা প্রেমিকা। বর্ধমানে ক্লাবের ছেলেদের কাছে পরের যাত্রাদলে প্রধান অভিনেতা হিসাবে পরিচি দেওয়াতে তারা অরিন্দমের ও অপরূপার সকল রকম সুব্যবস্থা করে দিল। তবে ব্যবহার খুবই ভালাে লাগলাে অরিন্দমের। তাদের সঙ্গে এসেছে আর একশ ) হলাে অরিন্দমের বন্ধু সুব্রত ব্যানার্জী। অরিন্দম যেন এক অন্য জগতে চলে গিয়েছে। বামদিকে অপরূপা আর এ বন্ধুবর। অপরূপাকে একটা নিজের করে পাওয়ার জন্য সে কতকাল নিজেই জানে না অরিন্দম।
প্রথম দলের যাত্রা শেষ। এবার ‘রূপা অপেরার যাত্রা। তাই অরিন্দম বলে অামি “তা হলে। আর অপরূপা পাশে আর একজন ভদ্রমহিলা যিনি ক্লাবের সম্পাদকের কন। অপম সেই ভ্র মহিলাকে অপরূপাকে একটু সঙ্গদান করার কথা বলে।এ দলে তাহলে এসেছে। সুদর্শন সান্যাল গোপালবাবু বললাে, দাদা অপককে দেখছি না তো গেল কোথায়? গােপালবাবু বললেন, অপরূপা অরিন্দমের খেআগে এসেছে। দাদা মেয়েকে একা একা ছেড়ে দেন। সুদর্শন বললাে গােপালবাবু প্রেমের সুরে বললেন, নিজের চরকায় তেল দাও তাে। ইতিমধ্যে অরিন্দম ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। সুব্রতও সঙ্গে আছে। সুব্রত সুশনকে মােটেই দেখতে পারে না। সে বরাবর বলতাে ঐ লােকটি একটি ধুরস্কর। খােপালবাবু অরিন্দমকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন যে অপরূপা কোথায় আছে? অরিন্দমের কাছে সব কথা শুনে গোপালবাবু কাজে লেগে গেলেন কারণ তিনি অরিন্দমের কথায় নিশ্চিন্ত হন।
যাত্রা শুরু হলাে একের পর এক দৃশ্য এগােতে লাগলাে। কিন্তু আশ্চর্য্য যতবারই অরিন্দম যায় দর্শকরা হাততালিতে ভরিয়ে রাখে মঞ্চের আশপাশ। কিন্তু শেষ দৃশ্যে অরিন্দম মৃত্যু শখ্যায় যে অভিনয় দক্ষতা দেখানাে তা দেখে প্রতােক দর্শক বিহলচিত্তে রুখে মুহ্যমান হয়ে পড়লাে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ অরিন্দমকে পুরস্কার স্বরূপ দিলেন একটি ছোট্ট শিশু। আর একবার দর্শকদের হাততালি বেজে উঠলাে। যাত্রা শেষ হওয়ার পরক্ষণেই অরিন্দম ফিরে এলাে অপরূপার কাছে। অপরূপা অরিন্দমকে দেখে লজ্জাসরম ভূলে গিয়ে তাকে দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরলাে আর বললাে, তুমি এরকম আর কোনদিন করবে না। অরিন্দমের আনন্দে চোখে জল এলাে, সত্যিই পৃথিবীতে তার মূল্য আজ অনেক। সে তাকিয়ে দেখলাে চারপাশের দর্শকমণ্ডলী তখনও তাকে দেখবার ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবলাে আজ যাত্রা করে সে যে সুনাম পেল যে অভিনয় দক্ষতা দেখাতে পারলাে তা শুধু অপরূপার প্রেরণা আর গোপাল বাবুর নির্দেশনার পরিপক্ক মিষ্ট ফল।গোপালবাবু আজ আবার অরিন্দমকে যাত্রাশিল্পের কথা বলেন, বিশ্ব শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র (১৯০৭-৭৬) হাতে যাত্রা বিকশিত হয়ে পৌরাণিক পালার পাশাপাশি ঐতিহাসিক, লোককাহিনীভিত্তিক ও সামাজিক পালায়।পেশাদার যাত্রাদলের আবির্ভাবে যাত্রা হয়ে ওঠে গ্রাহ্য শিল্পমাধ্যম। আধুনিক নগর জীবণে যেমন থিয়েটার, গ্রামীণ জনপদে তেমনি ‘যাত্রা’ এখনো অন্যতম বিনোদন-মাধ্যম হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
স্থূলতা, গ্রাম্যতা ও অশ্লীলতার অভিযোগ এবং নানা নেতিবাচক ধারণা সত্ত্বেও যাত্রার প্রভাব ও বৈভবকে অস্বীকার করা যায় না।’ বাংলা শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই যাত্রার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন যাত্রায়।মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরীশ চন্দ্র ঘোষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল ব্যক্তি জীবনেই যাত্রা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, তাদের সাহিত্যকর্মেও ছিল যাত্রার উজ্জল উপস্থিতি।যাত্রাশিল্পী ও গবেষকরা মনে করেন, যাত্রা কেবল বিনোদন মাধ্যম নয়, লোকশিক্ষার বাহনও। নিরক্ষতার অনগ্রসর সমাজে যাত্রা পালন করছে ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয়ের ভূমিকাও।
রাজাবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির বাসিন্দা যাত্রাশিল্পী কল্পনা ঘোষ (৫২)। শৈশব থেকেই যাত্রার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পুরো জীবনের অভিজ্ঞতা-স্মৃতি বলতে যা কিছু, তার সবই যাত্রাকে ঘিরেই।সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে অনুষ্ঠিত একটি যাত্রা উৎসবে অংশ নিতে এসে এ প্রতিবেদককে জানালেন এ শিল্পের নানা সমস্যার কথা। যাত্রাশিল্পী কল্পনা ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, শিশুকাল থেকে যাত্রাপালায় অভিনয় করছি। এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে ৩ ছেলে মেয়ে মানুষ করেছি। ভালবেসে এখনো ধরে রেখেছি যাত্রাভিনয়। বর্তমানে তরুণরা আর যাত্রাভিনয়ে আসতে চায় না। তরুণরা এগিয়ে আসলে এ শিল্পের উত্তরণ ঘটতো। এটি একটি ভাল মাধ্যম। এখানে শেখার অনেক কিছু রয়েছে।
প্রাচীন শিল্পমাধ্যম যাত্রার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয় ব্রিটিশ শাসনামলেই। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবি উচ্চারিত হওয়ায় ব্রিটিশ শাসকরা বন্ধ করে দেয় মুকুন্দ দাশের স্বদেশী যাত্রা।পাকিস্তান আমলেও যাত্রাশিল্পটি রক্ষনশীল ও মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ে। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ’র নির্দেশে বন্ধ করা হয় রূপবান যাত্রা। যাত্রাশিল্পীদের অভিযোগ, ১৯৭৫’র পর স্বাধীন দেশেই বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় যাত্রাকে নিয়ে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। ১৯৯২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যাত্রা বন্ধে সরকারি আদেশ জারি করা হয়। বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট যাত্রাশিল্পী মিলন কান্তি দে এই শিল্পের চলমান সংকট প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে জানান, যাত্রানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়, তার জন্য যাত্রাশিল্পীরা দায়ী নন।
একশ্রেণীর ভূঁইফোড় ও বিকৃত মানসিকতার প্রদর্শকরা এর জন্য দায়ী। এরা কেউ পেশাদার যাত্রা প্রদর্শক না। আমরা একাধিকবার বলেছি, অশ্লীলতা যাত্রাশিল্পীরা করে না, কেউ করলে আমরা প্রশাসনকে তাৎক্ষণিক অবগত করি তা বন্ধ করার জন্য। তারপরও পুরো দায়ভার এ শিল্পকেই বহন করতে হচ্ছে।তিনি জানান, ‘একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে। নানা সময়ে এ শিল্পকে বন্ধ করে দেয়ার যে অপচেষ্টা হয়েছে তা মূলত: বাংলা সংস্কৃতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস।সরকারের কাছে আমরা এ শিল্প রক্ষায় নানা সময়ে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা আবেদন জানাই।
বর্তমান সরকার আমলে যাত্রাশিল্পের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি প্রণীত হলে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমরা মনে করি।’মিলন কান্তি দে মনে করেন- যাত্রাশিল্পকে আরো বিকশিত রূপ দিতে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত নাট্যকাররা তেমন ভূমিকা রাখছেন না। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত নাট্যকাররা যাত্রাপালা লেখেন, আমাদের নাট্যকাররা যাত্রাপালা লেখেন না।এখানে তাই ভালমানের পালা রচিত হচ্ছে না। এ শিল্পের সামগ্রিক বিকাশের পথে এটিও একটি বড় বাধা হিসেবে দেখেন মিলন দে।