সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম

যে গল্পগুলো ভাবতে শেখায়

বুক রিভিউ
লেখাটি শেয়ার করুন

সোহায়েব বিন ইসলাম সিয়াম।।

 

রিভিউ :

 

ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, “ভাবো, ভাবো। ভাবা প্রাক্টিস করো।”

শাহাদুজ্জামান একই কথা অন্যভাবে বললেন, “মানুষ যখন ভাবে তখন তাকে সুন্দর লাগে”।

তিনি শুধু এটা বলেই ক্ষান্ত হলেন না, পুরো একটা বই উপহার উপহার দিলেন আমাদের – ‌যেটা আমাদের ভাবতে শেখাবে।

কথা বলছি, “কয়েকটি বিহ্বল গল্প” বইটা নিয়ে। লেখক শাহাদুজ্জামান এর ছোটো গল্প সংকলন। চিকন বই। ১৪ টা গল্প।

 

রবীন্দ্রনাথ যে রকম ছোটোগল্পের ব্যাপারে কিছু গূরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছিলেন, উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় – ছোটো ছোটো কথার মাধ্যমে মাধ্যমে বড় কিছুর ইঙ্গিত দেয়া, শেষ হওয়ার পরেও শেষ না হওয়া, কনক্লুশনটাকে পাঠকের উপর ছেড়ে দেয়া –

শাহাদুজ্জামান এই নিয়মের বিরোধীতা না করেও গতানুগতিক ধারার বাইরের  মাত্রায় নিয়ে গেছেন গল্পগুলো – সীমানার ভেতরে অসীমকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কিংবা নিয়মের ভেতরে থেকে সেটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে নতুন কোনো আকৃতি দেয়া।

কি সুন্দর এক্সপেরিমেন্টাল ওয়েটে গল্পগুলো প্রেজেন্ট করলেন!   তিনি যে গতানুগতিক ধারার বাইরে যেয়ে নতুন কিছু করতে দক্ষ – “কয়েকটি বিহ্বল গল্প” সেটার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।



এবারে আসি, গল্প গুলোর ব্যাপারে কথা বলতে। ১৪ টি গল্পের ভেতরে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, ‘এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প’,  ‘ক্যালাইডোস্কোপ’,  ‘মৌলিক’,  ‘ডোডো পাখির জন্য নস্টালজিয়া’,  আর ‘কতিপয় ভাবুক’।

যে প্রসঙ্গ ধরে শুরু করেছিলাম, “মানুষ যখন ভাবে,  তখন তাকে সুন্দর লাগে” – কথাটা পাওয়া যাবে, ‘কতিপয় ভাবুক’ গল্পে। এই গল্পে  – গল্পকথক একটা ছোটো কাহিনী উপস্থাপন করেন এবং তারপর কয়েকজনের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করে, “কাহিনীর কোন চরিত্রটিকে সবচেয়ে ভালো লেগেছে?” সবাই আলাদা আলাদা চরিত্রের নাম বলেন এবং কেনো পছন্দ করেন, সেটার ব্যাখ্যা জানতে চান তিনি।  একই ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ও দেখতে শেখার যে চর্চা – সেটা শাহাদুজ্জামান যেরকম মুন্সিয়ানার সাথে তুলে ধরেছেন, সেটা অতুলনীয়।

কয়েকটি বিহ্বল গল্প

ভিন্ন পারস্পেকটিভ থেকে একই ঘটনাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার ব্যাপারটা ‘ডোডো পাখির জন্য নস্টালজিয়া’ গল্পেও উঠে এসেছে।

সবচেয়ে  হাসি পেয়েছে, ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ পড়ে। হাস্যকর হলেও এটার একটা গূঢ় অর্থ আছে, পাঠক সেটা নিজ দ্বায়িত্বে বুঝে নিক- লেখক সেটাই চেয়েছেন। তাই আমিও আমার ধারণা, ব্যাখ্যা নিজের কাছে রেখে দেই। আপনারা নিজেই পড়ে নিজের মত একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন।

‘মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়া’ নামে একটি গল্প আছে। এই গল্পে সময়ের সাথে সামাজিক,  পারিবারিক চাহিদা ও ব্যক্তিগত স্বপ্নের সংঘর্ষ এবং পরিশেষে মানিয়ে নেয়া – সব উঠে এসেছে।

 

‘কারা যেনো বলছে’ গল্পে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার জন্য পরীক্ষা না দেয়ার যে পরিকল্পনা করে কলেজ পড়ুয়া কয়েকজন – সেটা কোনো রুপক গল্প কিনা, এটাও পাঠকদের ভেবে দেখার আহ্বান।

আসলে, পুরো বইটাই অধিকাংশ জায়গাতেই রুপকার্থে গল্পগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। আর লেখক চেয়েছেন, পাঠকরা যেনো গল্প গুলো পড়ে ভাবতে শুরু করে আর ভাবনার মধ্যমে লেখকের মনের কথাগুলো খুঁজে পাক। ভাবতে শুরু করলেই পাঠকরা লেখকের চোখে সুন্দর,  সেটাও তিনি গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন।



মাত্র ৬৫ পেজের কয়েকটা ছোটো গল্পের একটা চিকন বইতে-   সমাজিক,  রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত জীবন রুপকার্থে তুলে ধরে পাঠককে ভাবতে শেখানো – এইটা হয়তো শাহাদুজ্জামান এর মত লেখক বলেই সম্ভব।

 

‘মারাত্মক নিরুপম আনন্দ’ গল্পটা সংলাপধর্মী গল্প। এক্সপেরিমেন্টাল দিক দিয়ে লেখকের অন্যতম সেরা। আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।

ঋত্বিক ঘটকের কথা মতো,’ ভাবা প্রাকটিস’ করা দরকার। তার আগে অবশ্যই পড়া প্রাকটিস করা দরকার।  পড়ার পর ভাবতে বসলে আমরা সুন্দর হবো।  এটা বিশ্বাস করেন?

লেখকের কথা ফেলে দেয়া যায় না, যদি সে লেখকটা ‘শাহাদুজ্জামান’ হন।

“There will be time, There will be time
To prepare a face to meet the faces that you meet” – T. S. Eliot




লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply