হাফেজ শিরাজী

বাংলা সাহিত্যে হাফিজ: যে মানুষ চিরকালের জানা লোক

জীবনী, প্রবন্ধ
লেখাটি শেয়ার করুন

মো: ফেরদৌস আলম
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

বিশ্বনন্দিত রহস্যপ্রেমী মহান সূফী কবি হাফিজ ফার্সি ভাষী বিশেষ করে ইরানীদের ঘরে ঘরে আজও চর্চিত হন গভীর ভালোবাসায়। পারস্যের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের প্রায় সব প্রধান ভাষায় অনুদিত হয়েছে হাফিজের সৃষ্টিকর্ম। মহাকবি গ্যেটে সহ বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিকেরা হাফিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। কিন্তু জীবদ্দশায়ই হাফিজ জয় করেছিলেন বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের মন। শাসনকালের প্রাথমিক পর্যায়েই হাফিজকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান গুণমুগ্ধ সুলতান। দুঃখজনকভাবে ইচ্ছা থাকলেও কবি আসতে পারেননি সোনারগাঁওয়ে। বৃদ্ধ কবি বাংলাদেশে আসতে না পারলেও বাংলার রাজদূতকে তার বাদশার জন্য কবিতা লিখে পাঠান। সৈয়দ মুজতবা আলী তার আফগানিস্তান পর্বের বিখ্যাত উপন্যাস ‘শব্নম্’-এ হাফিজের বারংবার উল্লেখের এক পর্যায়ে এ কবিতাটিও উল্লেখ করেছেন।

‘’হেরো, হেরো, বিস্ময়।
দেশ কাল হয় লয়!
সবে কাল রাতে জনম লইয়া এই শিশু কবিতাটি
রওয়ানা হইল পাড়ি দেবে বলে এক বছরের ঘাটি।’’

হাফিজের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে অল্পই জানা যায়। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায়, বর্তমান মধ্য ইরানের ইস্পাহান শহরের কোনো এক জায়গায় ১৩১৭ থেকে ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে জন্মগ্রহণ করেন হাফিজ। হাফিজের বাল্যকালে কয়লা ব্যবসায়ী পিতা পরিবার নিয়ে শিরাজ শহরে যান এবং এর কিছুকাল পরেই মারা যান। বিপন্ন পরিবারটি হাফিজের কোনো এক চাচার আশ্রয় লাভ করে। এক পর্যায়ে হাফিজের শিক্ষালাভ বাধাগ্রস্ত হলেও উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেন তিনি। আরবি ও ফার্সিতে সমান পারদর্শিতা অর্জন করেন মহান এ কবি। অল্প বয়সে পবিত্র কুরআন মুখস্থ করে হাফিজ-ই-কুরআন থেকে হাফিজ নাম প্রসিদ্ধ হয় বলে সুবিদিত আছে। তার মূল নাম শামস-উদ্-দ্বীন মোহাম্মদ। শিরাজ শহরে বেড়ে ওঠায় হাফিজ শিরাজী নামেও তিনি পরিচিতি পান। তাকে কখনো ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ নামে ডাকা হয়। তাকে ‘লিসান-উল-গায়েব’ বা অদৃশ্যের জবান নামেও ডাকা হয়।

তিনি বিভিন্ন সময়ে লিপিকার হিসেবে, বস্ত্রের দোকানে এবং বেকারিতে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। শহরের সম্ভ্রান্ত অংশে রুটি সরবরাহের সময় তিনি ‘শাখ-ই-নবাত’ নামে এক নারীতে মুগ্ধ হন যাকে তার অনেক কবিতায় সম্বোধন করা হয়েছে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। শাখ-ই-নবাত অর্থ আঁখের শাখা এবং এটি ছদ্মনাম বলে ধারণা করা হয় যার পরিচয় আজও ধোয়াশার মধ্যেই রয়ে গেছে। হাফিজ শিরাজের আত্তার (শেখ ফরিদ-উদ-দ্বীন আত্তার নয়) নামে এক সূফীর শিষ্যত্ব লাভ করেন। তিনি যেমন বিভিন্ন শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন তেমনি বিরাগভাজনও হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। শিরাজের কোনো শিক্ষালয়ে তিনি কুরআন শিক্ষার অধ্যাপক ছিলেন। বছরে গড়ে মাত্র ১০টির মতো গজল লিখেছেন হাফিজ। বলা হয়, ঐশী প্রেরণা পেলেই কেবল তিনি লিখতেন। হাফিজ রচিত পাঁচ শতাধিক গজল ও ৪২টি রুবাই সহ যেসব লেখার প্রমাণ পাওয়া যায় সেসব তার জীবদ্দশায় গ্রন্থবদ্ধ হয়নি। হাফিজের মৃত্যুর পর তার বন্ধুস্থানীয় গুলান্দাম তার দীওয়ান সংকলন করেন। প্রায় অর্ধশত বছরাধিক কালে লেখা উদাসীন হাফিজের অনেক লেখা হারিয়ে গেছে বলে অনুমান করা হয়। মসজিদ থেকে শরাইখানা, সব জায়গায়ই হাফিজের গজল মানুষের মুখে মুখে ছিল। মোঙ্গল জয়যাত্রার সময় হাফিজ লিখলেন,

“যদিই কান্তা শিরাজ সজ্নি ফেরত দেয় মোর চোরাই দিল্ ফের,
সমরখন্দ আর বোখারায় দিই বদল তার লাল গালের তিল্‌টের!” (কাজী নজরুল ইসলাম, নির্ঝর)

কষ্টার্জিত রাজধানী সমরখন্দ ও বোখারা শহরের এহেন বিনিময় শুনে তৈমুর লঙ রেগে গিয়ে হাফিজকে তলব করেন। হাফিজ বলেন, “সম্রাট, এহেন অমিতব্যয়ীতার জন্যই আমার এই দুর্দশা!” জবাবে খুশি হয়ে তৈমুর কবিকে বরং পুরস্কৃত করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় বলা হয়, তৈমুরের রোষ থেকে বাঁচতে সম্রাট ভুল শুনেছেন দাবি করে সমরখন্দ ও বোখারার পরিবর্তে দুই মণ চিনি ও তিন মণ খেজুর বিলিয়ে দেবার কথা বলেন হাফিজ।

 

এবার আসা যাক বাংলার সাথে হাফিজের আবহমান আধ্যাত্মিক সম্পর্কের ধারায়। কবিকে সোনারগাঁওয়ে আমন্ত্রণ জানানো সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ ফার্সি সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বিকাশেও অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রাচীনতম বাঙালি মুসলিম কবি হিসেবে পরিচিত শাহ মুহাম্মদ সগীর সুলতানের সভাকবি ছিলেন। মহাকবি কৃত্তিবাস ওঝা বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের শাসনামলেই। মহান কবি হাফিজ বাংলাদেশে আসতে না পারলেও যুগে যুগে এ অঞ্চলে সমাদৃত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের প্রধান দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম প্রভাবিত ছিলেন হাফিজের ভাবধারায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ সালে তৎকালীন পারস্যরাজের নিমন্ত্রণে পারস্যে গিয়ে হাফিজের সমাধিসৌধ দর্শন করেন। অবশ্য সমাধি দেখে কবিগুরু খুশি হতে পারেননি। দুঃখ করে বলেছেন,

”হাফেজের কাব্যের সঙ্গে এটা একেবারেই খাপ খায় না। লোহার বেড়ায় ঘেরা কবি-আত্মাকে মনে হল যেন আমাদের পুলিস-রাজত্বের অর্ডিনান্সের কয়েদী।”

রবিন্দ্রনাথ ভিতরে গিয়ে বসলেন। হাফিজের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাধারণের যে বিশ্বাস (কোনো একটি বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বুজে এই গ্রন্থ খুলে যে কবিতাটি পাওয়া যাবে তার থেকে ইচ্ছার সফলতা নির্ণয় হবে) কবিগুরু সেই বিশ্বাসেরও পরীক্ষা করলেন।  তিনি মনে মনে ইচ্ছা করলেন ধর্মনামধারী অন্ধতার প্রাণান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়। যে কবিতা পাওয়া গেল তার দ্বিতীয় ভাগ এরকম-

”স্বর্গদ্বার যাবে খুলে, আর সেইসঙ্গে খুলবে আমাদের সমস্ত জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি, এও কি হবে সম্ভব। অহংকৃত ধার্মিকনামধারীদের জন্যে যদি তা বন্ধই থাকে তবে ভরসা রেখো মনে ঈশ্বরের নিমিত্তে তা যাবে খুলে।”

প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের সংগতি দেখে বিস্মিত হলেন সবাই। কবিগুরুর উপলব্ধি হলো এই-

”আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারে নি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক” (পারস্যে, ১৯৩২)।

 

কাজী নজরুল ইসলামকে হাফিজের ভাবশিষ্য বলা হয়। হাফিজের চেতনায় কবি শাণিত করেছেন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি। উপক্ষো করেছেন অন্যায়ের তীব্র ভ্রূকুটি। হাফিজের কবিতায় মুগ্ধ হয়েই ফার্সি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন নজরুল। তার অনুদিত ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’ ও ‘রুবাইয়াত-ই-হাফিজ’ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। কবির লেখা গল্প ‘সালেক’ হাফিজকে তুলে ধরে মিথ্যা অহং থেকে মুক্ত হওয়ার আপোষহীন সাধনগুরু হিসেবে। একজন কাজী দরবেশরূপী হাফিজের পরামর্শে জায়নামাজের ওপর মদের বোতল ভেঙ্গে দেন যখন বাদশা তার পিছনে নামাজ পড়ছিলেন। শাস্তি স্বরূপ তার পদ আর পদবি কেড়ে নেওয়া হয়, আর যা কিছু সম্পত্তি তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। মৃত্যদণ্ড হলে তো সব ল্যাঠা চুকেই গেল। তাকে জীবনব্যাপী লাঞ্ছনা আর গঞ্জনায় তিলে তিলে দগ্ধ করার শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু হাফিজের দৃষ্টিতে

“জায়েনামাজে শারাব-রঙিন কর, মুর্শেদ বলেন যদি। পথ দেখায় যে, জানে সে যে, পথের কোথায় অন্ত আদি।” (রিক্তের বেদন, ১৯২৪)।

কাজি সাহেব প্রাণের বাকি সমস্ত শক্তিটুকু একত্র করে জানতে পারলেন দরবেশের আসল পরিচয়। কবির ভাষায় তিনি ‘মাতাল হাফিজ!’ এ গল্পের মতো হাফিজ তার কাব্যে শরাব-সাকীর উপমা টেনেছেন বারবার। তবে অধিকাংশ মতেই এগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অন্যান্য সূফী কবিদের মতো। বাংলা ভাষায় নজরুল ব্যতীত অন্যান্য যাঁরা হাফিজের কাব্যের অনূবাদ করেছেন তাদের মধ্যে কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৪-১৯০৭), কান্তিচন্দ্র ঘোষ (১৮৮৬-১৯৪৮), অজয় কুমার ভট্টাচার্য্য (১৯০৬-১৯৪৩), নরেন্দ্র দেব (১৮৮৮-১৯৭১), সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯–২০০৩) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

 

আনুমানিক ১৩৮৯ অথবা ১৩৯০ সালে ৬৯ বছর বয়সে হাফিজ ইন্তেকাল করেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। আজীবন কট্টোরপন্থীদের রোষের শিকার হাফিজ মৃত্যুর পরও রেহাই পাননি। হাফিজের ধর্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার জানাজা পড়তে অস্বীকৃতি জানানোর কথা বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। এ সমস্যা দূর করতে কয়েকজন পরামর্শ দিলেন হাফিজেরই দ্বারস্থ হতে। হাফিজের কবিতাসমগ্র চোখ বুজে খুলে যেকোনো পৃষ্ঠার প্রথম দুই লাইন পড়ে হাফিজের ধর্মসিদ্ধি বিচার করা হবে। আশ্চর্যজনকভাবে পাওয়া গেল সমাধান। যার ভাবার্থ এরকম- ”হাফিজের রূহ যখন নিল বিদায়, শ্রদ্ধার দীর্ঘশ্বাসে তার খাটিয়া তুলে নাও। পাপের সমুদ্র শান্ত হয়েছে তার, আল্লাহর বেহেশতে হতে পারে জায়গা এবার।” জানাজা শেষে হাফিজকে আঙ্গুর বাগানে সমাহিত করা হয়। তার সমাধিসৌধ হয়ে ওঠে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অনন্ত রহস্যপ্রেমীদের তীর্থভূমি।



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply