সোনিয়া আক্তার

বিজয় কোনো কুড়িয়ে পাওয়া পুষ্প নয়, ২৪ বছরের সংগ্রামের ফসল

প্রবন্ধ, মতামত, সম্পাদকীয়
লেখাটি শেয়ার করুন

সোনিয়া আক্তার
ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।

বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এ স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া একটি ভূখণ্ড বা কারো বদন্যতার উপহার নয়। ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা -বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মহামূল্যবান এই বিজয়। ১৯৭১সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছি কিন্তু এর পেছনে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক সুদীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণ, অত্যাচার আর নিপীড়নের ইতিহাস।

ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মের ভিত্তিতে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরত্বে থাকা দুটি অঞ্চল নিয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তানী অভিজাত শাসকগোষ্ঠী নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য প্রথমেই আঘাত হানে বাংলা ভাষার উপর। মানুষ তখনই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে, যখন তার সত্তায় আঘাত আসে। যদিও পাকিস্তানের মাত্র ৩.২৭℅ লোকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু তথাপি উর্দুকেই পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছিল। ডাকটিকিট, রেলের টিকিট, মুদ্রা, মানি অর্ডার ফরম এমনকি পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস কমিশনের কেবল ইংরেজি ও উর্দুকে ব্যবহার করে সমস্ত নিয়োগ পরীক্ষা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়া হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, তারই চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, শফিউর, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকের ভাষার জন্য শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে।

তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ধারা শুধুমাত্র ভাষা নয় বরং তার সাথে জড়িত ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটি। ভাষা আন্দোলন ছিলো বাঙালী জাতিসত্তা বিকাশের প্রথম পর্যায়। মুসলীম লীগ সরকার ও দলের নিপীড়ন, ধর্মকে রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করার মানসিকতার বিপরীতে অসম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক কিছু ব্যক্তির নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব বাংলায় সর্বপ্রথম আওয়ামী মুসলিম লীগ নামক বিরোধী রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে এবং এটি প্রতিষ্ঠার পর পর খুব দ্রুতই গণমানুষের দলে পরিণত হয়।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগকে জনগণ আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে। এরই অন্যতম উদাহরণ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন যুক্তফ্রন্টের তরুণ নেতা খালেক নেওয়াজ খানের নিকট ৭ হাজার ভোট এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুল মান্নান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনাব তাজউদ্দিন আহমেদের নিকট প্রায় ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। সামগ্রিকভাবে ১৯৫৪ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। মুসলীম ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর থেকেই একটি গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমুখী সংবিধান প্রণয়ন তাগিদ দেয়া হলেও দীর্ঘ ৯ বছর সময় অতিবাহিত হয়।

অবশেষে বিভিন্ন পরিস্থিতি অতিক্রম করে ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর হয়। এই সংবিধান ছিল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল করে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারী করে এবং সেনা প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করে। মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সামরিক শাসন চালু করে। এর মাধ্যমে শুরু হয় পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিকায়নের প্রক্রিয়া।

আইয়ুব খান জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে একনায়কতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সমস্ত রাজনৈতিক দল ও তাদের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে। এসময় যেহেতু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল, সেহেতু পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। ১৯৬২-১৯৬৪ সাল নাগাদ ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম ছিল সংবিধান বিরোধী, শরীফ কমিশন বিরোধী আন্দোলন, সমাবর্তন বিরোধী আন্দোলন। বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ নিয়ে আবির্ভূত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৬দফার দাবি উত্থাপন পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। শুরু থেকেই পূর্বাঞ্চলের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের ঔপনিবেশিক মনোভাব, এ অঞ্চলের জণগণ ও রাজনীতিবিদদের অবমূল্যায়ন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ, সামরিক দিক থেকে অবহেলা এসকল কারণ ৬ দফাকে যুক্তিযুক্ত করে তুলেছিল।

আইয়ুব খান ছেষট্টির ৬ দফাকে রাষ্ট্রদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্বশূন্য করে, এ অঞ্চলে আইয়ুব খানের ক্ষমতা ও প্রভাব সুদৃঢ় করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনারই ফল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এসময় একদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ অপরদিকে অন্যান্য দলের নিষ্ক্রিয়তায় পূর্ব বাংলায় সরকার বিরোধী আন্দোলন অনেকটা স্থিমিত হয়ে পড়ে। বাঙালির এমন সংকটময় মুহূর্তে নেতৃত্ব গ্রহণ করে এদেশের ছাত্র সমাজ বিশেষত ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দু’টি অংশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। তারা ১১ দফা দাবিনামার ভিত্তিতে গণ-আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত মামলা তুলে নেয়া হয় এবং আইয়ুব খানের পতনের মাধ্যমে মামলার অসারতা প্রমাণিত হয়।

69-gono-ovbuthhan
চিত্রঃ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান

উনসত্তরের গণঅভ্যুথান যে কেবল ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল তা-ই নয়, এর মাধ্যমে তথাকথিত “উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ” যথার্থ রূপটি উন্মোচিত হয়ে যায়। এ অভ্যুথানের পরিণতিতে শুধু আইয়ুব খানেরই পতন ঘটেনি বরং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথও সুগম হয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করা সত্বেও পূর্ব বাংলার নেতৃত্ববৃন্দদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে শুরু করে তালবাহানা।

দীর্ঘ ২৪ বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ঐতিহাসিক ভাষণে আন্দোলিত হয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি একসময় রূপ নেয় স্বাধীনতা ও মুক্তির দাবিতে। বাঙ্গালী জাতির আপোষহীন মনোভাব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য নেতৃত্বের ফলে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় পৃথিবীর বুকে লাল সবুজের পতাকা।


লেখাটি শেয়ার করুন

২ comments

Leave a Reply