সৌমিত্র চৌধুরী

বুড়োর প্রতীক্ষা

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

সৌমিত্র চৌধুরী,
কলকাতা, ভারত।

 

তোমার কাজ কি? দিন মানে কী কর তুমি?

কী আর করি! সারাদিন অপেক্ষা করি।

ওমা, আমারও তো তাই কাম! তোমার মত বেঞ্চিতে হাঁ-করি বসি থাকি। জারুল গাছের মগডালে ঐ ফিঙা পাখিটার মত। সময় আর ফুরায় না।

কার জন্য অপেক্ষা করিস?

সবার জন্য। এখন দুপুর রোদে গাছের ছায়ায় বসি যেমন দাদাবাবুর মেয়ের লগে অপেক্ষা করতেছি। সকাল বেলাতেও করি। দরজার ঘণ্টি বাজায়ে বুড়ির লগে দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে পায়ে খিল ধরি যায়। দরজা খোলেই না। ভাবি চলে যাই। তখনই আওয়াজ – খুট।

তারপর কাজ শুরু করিস?

না, আবার পতিক্ষা। কী রান্না হবে জানতি চেয়ে ঠাকুমার চুপসানো মুখের পানে তাকায়ে থাকা।

তারপর?

ঠাকুমার ভাত আর নিরামিষ তরকারি ঝটপট রাঁধাবারি করি। ততক্ষণে বৌদি মেয়েরে খাওয়ায়ে ইসকুলে পৌঁছি দেয়।

আরপর কী করিস?

তুমি যা কর! কারুর লগে বসি থাকা। পতিক্ষা গো, পতিক্ষা।

বুঝলাম। বৌদির মেয়ের জন্য অপেক্ষা করা। কখন যে স্কুলের ছুটি হয়! তারপর?

বাচ্চারে বাড়ি এনে খাওয়াই। ঠাকুমার ভাত বেরে থুই। পতিক্ষা করি, কখন খায়।

তারপর কী কাজ করিস?

চারটি ভাত মুখে তুলে আবার পতিক্ষা। বৌদি এলেই তো দরজা খুলতি হবে।

তোর আর আমার জীবন তো তাহলে একই রে! প্রতিক্ষা আর অপেক্ষায় কেটে যায়।

এখন কার তরে পতিক্ষা করতিছ?

নাতীর জন্য। আমার মেয়ের ছেলে। ফাইভে পড়ে। ওর বাবা-মা গাড়ি করে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই ফুস করে নিজের অফিস। আর আমি বসে থাকি। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। প্রহর গুনতে থাকি। কখন স্কুলে ছুটির ঘণ্টি বাজবে।

পতিক্ষা করতি ভালো লাগে তোমার?

কার ভালো লাগে? তবু অপেক্ষা করতে হয়। এতেই জীবনটা কেটে গেল রে!

কাটল কৈ গো? এখনও ঢের বাকী। তেমন বুড্ডা তো হও নি।

রিটায়ার তো করেছি। অবসর নিলেই লোকে বলে বুড়ো, জানিস! শরীরে তাকত থাকলেও।

আহারে! তোমার কষ্টটা বুঝি। চুপ করে আমসি মুখে এই বিঞ্চিতে বসি থাকতে দেখি তো।

আমি দেখতে কেমন রে?



ভালো তো! এককালে রুপ জৈবন ছিল বুঝা যায়! আচ্ছা, বাড়িতে তোমার লোকজন নাই? তোমার লগে বসি থাকে না কেউ?

কেউ বসে থাকেনা। বৌ বেঁচে থাকতে আমার জন্য অপেক্ষা করত। অফিসের কাজ মিটিয়ে কখন  ফিরব। ঘরবার করত শুধু। সে এক যুগ আগের কথা। তারপর থেকে শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা।

আহারে! আমার লগেও কেউ পতিক্ষা করেনা গো। স্বামীটা কোমর ভেঙে যে-বার বিছানা নিল, আমার লগে বসি থাকতো। অন্যের বাড়ি কাম করি খাবার নি যেতাম তো! তখন নিজের একটা দাম ছিল, পেস্টিজ গো! তারপর সে লোকটা পুট করি মরি গেল। আমিও ফালতু বনি গেলাম।

খুব কষ্ট তো! তোর ছেলে মেয়ে নেই।

আছে তো। একটাই ছেলে, আট বছর। গুরুর আশ্রমে থাকি লিখা পড়া করে। আমার কাছে আসতি চায় না। ঝুপড়ি ঘর তো! মন টিকে না ওর।

তোর তো খুব কষ্ট! একা একা জীবন। শুধু অন্যের অপেক্ষায় বসে থাকা!

আমার নহে কষ্ট! নিকাপড়া জানি না, বাড়ি ঘর নাই। ঝুপড়িতে থাকি। কিন্তু তোমার কেন এই হাল? অন্যের লগে পতিক্ষা করতিছ?

তুই বুঝবি না।

বুঝবো গো। মানসের মুখ দেখেই ভিতরের কষ্ট মনের যন্তনা বুঝে নিই। আমারও বুকটা টনটন করতি থাকে।

আমার কষ্ট কী বুঝিস তুই?

তুমি আপিসে কাজ করা লোক। পড়া নিকা জানা। দালান বাড়িতে থাকো। তোমার নাতি গাড়িতে চেপে ইসকুলে যায়। সেই তোমারও কষ্ট। ভিতরের সাদ আহ্লাদ চাপি অন্যের লগে দিনমান বসি থাকা। পতিক্ষা আর পতিক্ষা।

তুই ঠিকই বলছিস রে! অপক্ষা করলে নিজেকে মনে হয় একটা ফালতু লোক। একটা দামী মানুষ আসবে বলে বসে আছি। কখন সে আসবে তার জন্য হাপিত্যেশ। এই বুঝি এল!

আমারও তেমনি লাগে। নিজের কাজ কাম নাই। ওদের কামের লগে শুধু দাঁড়ায়ে থাকা।

বড় কষ্ট রে! একটা পাতা নড়ল। খুট শব্দ। মনে হোল সে আসছে। সময় ঢলে ঢলে পড়ছে। রোদের রং বদল। তার মধ্যে চেয়ে থাকা। এই বুঝি বাবু এল।

বুঝতে পারি তোমার দুঃখ গো! সব শুনি বুকটা আমার হু হু করতিছে।

তুই খুব ভালো রে…।

কেউ তো বলেনা গো। তোমার পাশে বসি পিঠে একটু হাত বুলায়ে দিবো?

বলিস কি রে? স্কুলের গেটে ভিড় জমছে। লোকে দেখলে বলবে ঢ্যামনা বুড়ো। তারপর রাম ক্যালানি। তার চেয়ে বরং…

কী বলতি চাও তুমি?

আমার বাড়িতে আয়। সাতচল্লিশ নম্বর। বাঁদিকে একটু হেঁটে একটা মোড় ঘুরলেই।

ওঃ, হলুদ বাড়িটা!

হ্যাঁ রে! একতলাটা ফাঁকা। আমি অপেক্ষা করব।

উঃ, মরণ! বেঞ্চিতে বসি ঢুলছ গো দাদু। উঠ। ইস্কুলের ঘণ্টি বাজল যে!



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply