মায়াবন বিহারিণী

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

আরিফুর রহমান
গোলাপবাগ, জামালপুর।

 

শহরের উপকণ্ঠে যেখানে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল মনা। ওর সাথে ছিল পলি ও ঝুমা নামের আরও দুজন বন্ধু।
একপাশে নানান ধরনের ফসলের বিশাল মাঠ আর অন্যপাশে ফলদ ও বনজ গাছের সমারোহ দেখতে দেখতে মাঝখানের পথটা ধরে ওরা হেঁটে হেঁটে চলে গেছিল বহুদূর অব্দি। মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছিল অবিরত। ইটের রাস্তাটা শেষ হলে একসময় ওরা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে গেছে আরও সামনে।

পলিকে খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। বহুদিন পর সে এমন অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে। আসলে ওর চলাফেরা একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর সীমাবদ্ধ। এসএসসির পরপরই একটা রক্ষণশীল পরিবারে ওর বিয়ে হয়ে যায়। ফলে ম্যাচিউরড্ লাইফের স্বাধীনতার স্বাদ সে আজই প্রথম পেল!

ঝুমা অবশ্য বরাবরই পাখির ডানা পাওয়া মেয়ে। ওর গানের গলাও খুব ভালো। সে গলা ছেড়ে গাইছে, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে, মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা, মনে মনে।
আর মনা-ও বেশকিছু দিন ধরে শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে চলতে চলতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাইতো ঝুমা বেড়াতে বেরোনোর প্রস্তাব দিতেই ও রাজি হয়ে গেছিল। পলি-টা সিদ্ধান্ত নিতে পাচ্ছিল না, কারণ কোনোভাবে ওর বাসায় খবরটা পৌঁছালে সর্বনাশ! ঝুমা ওকে সাহস দিয়েছে, দেখ, আমরা খুব বেশিদূর যাচ্ছি না। সন্ধ্যার আগেই ফিরেও আসব। আর ওদিকটায় তোদের বাড়ির বা তোর শ্বশুর বাড়ির কেউ যাবে এমনটা কেবল দুঃস্বপ্নেই সম্ভব। তাছাড়া তুই তো বোরকা পরেছিস, দেখলেও কেউ তোকে চিনতে পারবে না। সো, লেট’স গো।
সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ঝুমা-র বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে পলি বলেছিল, চল, আল্লাহ ভরসা। মনা যোগ দিয়েছিল পথে। ওর শুধু ছবি আঁকবার নয় ছবি তোলবার হাতও চমৎকার! সেদিনের প্রায় সব ছবিই ওর তোলা।

সেদিন ঝুমা-কে গাইতে শুনে মনা-ও গেয়েছিল, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো?
ওর গান শুনে পলি খলবলিয়ে বলে উঠেছিল, থাক সে আর কিছু না বলুক! দেখ, মেঠোপথটা তোর গান শুনে সত্যি সত্যিই শেষ হয়ে গেল!

ওরা তিনজন একসাথে প্রাণখুলে হেসে উঠলে চমকে উঠেছিল ফসলহীন ন্যাড়া মাঠে ক্রিকেট খেলায় মেতে থাকা একদল ছেলে! হাসতে হাসতে ঝুমা মনা-র বাহু চেপে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, এই সে-টা কে রে? বল বল বল না!
পলিও বলেছিল, বল বল বল না!
ওদের ভেঙচিয়ে একজন খেলোয়াড় বলেছিল, বল বল এই বল দে! চল চল খেলি, চল খেলি।
বাকিরা হেসে উঠেছিল কলকলিয়ে!
মনা ও পলি খুব লজ্জা পেয়েছিল, কিন্তু রেগে গেছিল ঝুমা। ও আগুন চোখে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। মনা ও পলি শান্ত করেছিল ওকে। ফিসফিস করে বলেছিল, চল, আমরা চলে যাই। মনে হচ্ছে না এরা সবাই ভালো ছেলে।
ঠিক বলেছিস। একেকটার চেহারা দেখ না, মনে হয় নেশাটেশা করে। বাদ দে, চল ফিরে যাই।
মনে মনে ছেলেগুলোর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে ফিরতি পথ ধরেছিল ওরা। টের পায়নি, আলপথে বসে খেলা দেখাদের তিনজন সন্তর্পণে তাদের পিছু নিয়েছে।

ওরা বড়োরাস্তায় পৌঁছে দেখল পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া সূর্যটা লাল হতে শুরু করেছে। রাস্তার উল্টোদিকে হর্টিকালচার সেন্টার। ভেতরে ফুলের বাগান, বড়ো বড়ো পুকুর, পুকুরের পাড়ে নারকেল ও সুপারি গাছের সারি, বিশাল আমবাগান। সবগুলো গাছের গোড়া থেকে কাণ্ডের দিকে আড়াই ফুট পর্যন্ত রং করা। পাঁচিলের বাইরে রেললাইন। সবমিলিয়ে শুটিং স্পটের মতো ব্যাপার স্যাপার। পলি আর ঝুমা অনেকবার ট্রেন থেকে ভেতরের কিছু অংশ দেখেছে, কিন্তু সরাসরি ভেতরে যায়নি কোনোদিন। আর মনা একেবারেই দেখেনি। ফলে তিনজনেরই ইচ্ছে হলো ভেতরটা ঘুরে দেখবার। ঝুমা জানে ওখানে ঢুকতে হলে কর্মকর্তাদের কারোর অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু ওরা তো কাউকে চেনে না। চাইলেই অনুমতি পাওয়া যাবে?

মনা বলল, থাক, আজ আর গিয়ে কাজ নেই। বিকেলটাও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
ঝুমা ওকে ভেঙাল, বিকেলটা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে! তোমাকে আর কাব্যিক বক্তব্য দিতে হবে না সোনা, পলি প্রতিদিন এভাবে আসতে পারবে না। আজই একচক্কর দিয়ে যাব। চল।

ঝুমা এই শহরেরই মেয়ে আর বেশ চটপটে। ও গিয়ে গেটের নিরাপত্তা প্রহরীকে অনুরোধ করল। কিন্তু সে কিছুতেই অনুমতি ছাড়া ভেতরে যেতে দেবে না। তাছাড়া এই সময়টায় তো নয়-ই, যখন বিকেল শেষের পথে।

ঝুমাও নাছোড়বান্দা, নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগল। পলি-কে দেখিয়ে বলল, আমার এই বান্ধবী অনেক দূর থেকে এসেছে। হয়ত আর কোনোদিন আসতে পারবে না। কিছুক্ষণের জন্য ঢুকতে দিন না!
তবু প্রহরীর মন গলছে না দেখে ও শেষ তীরটা ছুঁড়ল, আপনি আমাকে চেনেন না? আমি কণ্ঠশিল্পী ঝুমা।
নিরাপত্তা প্রহরী ঝুমা-র এই তীরে ঠিক ঘায়েল হলো। বলল, হ্যাঁ, তাইতো মনে মনে চিন্তা করছি আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। আপনিই তো গতবছর বিজিবি-র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। আহা, আগে পরিচয় দিবেন না! যান, তাড়াতাড়ি একবার ঘুরে আসেন। ভিতরে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আমার নাম বলবেন। বলবেন, আপনারা সাজু মিয়ার আত্মীয়, টাঙ্গাইল থেকে বেড়াতে এসেছেন। ঠিকাছে আপা? বেশি ভিতরের দিকে যাবেন না, সময় বেশি নাই।

ওরা ততক্ষণে ফুলের বাগানের কাছে চলে এসেছে। বাগানটা এত সাজানো গোছানো আর এত রকমের ফুল যে, ওরা মুগ্ধ হয়ে গেল। অবশ্য যে কেউ-ই মুগ্ধ হবে।

মনা বহুদিন পর কাঁটা মেহেদীর ঝাঁড় দেখল। ফুলবাগানের বাইরের দিকটা সমান করে কাটা কাঁটা মেহেদীর গাছ দিয়ে ঘেরা। ওর ছোটোবেলায় ওদের বাড়ির বাইরের উঠোনও এমন করেই কাঁটা মেহেদীগাছ দিয়ে ঘেরা ছিল। পরে ওগুলো সরিয়ে ইটের পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়েছে।
ওরা পুকুরপাড় ধরে আমবাগানের দিকে এগোচ্ছে। পাশাপাশি তিনটি বড়ো বড়ো পুকুর। পূর্বদিকে আরও কয়েকটি দেখা যাচ্ছে। সবগুলো পুকুরের পারে দুসারি সুপারি গাছ, কেবল ফুলবাগানের দিকের পারটাতে একসারি নারকেল গাছ।
আমবাগানটি পুকুরের পার থেকে বেশ নিচুতে। সারি সারি শত শত গাছ আর গাছ ভর্তি আম। কোন অংশে কোন জাতের আমগাছ সেটা ছোটো ছোটো পিলারের সাথে লাগানো শ্বেতপাথরে লেখা রয়েছে।
ওরা যখন আমবাগানের সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছিল তখন উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসছিল কালবৈশাখী ঝড় আর বাগানের দক্ষিণ দিকের পাঁচিলের নিচের চোরাপথে একে একে ঢুকছিল তিনটি ছেলে! এই পথ ওরা বরাবর বাগানের আম চুরির কাজে ব্যবহার করে, কিন্তু আজ ওদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ওরা দেখেছে বাগানের মালি হেলে দুলে বাজারের দিকে যাচ্ছে। আহা হা! এটাই উপযুক্ত সময়; নির্জন বাগান, সন্ধ্যা হতে চলেছে, ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। ছেলে তিনটি সন্তর্পণে এগোচ্ছে আদিম নেশার টানে!
কিশোরী সুলভ উচ্ছলতার কারণেই হোক কিংবা অশনিসংকেত হিসেবে, ঝুমা-র বাম কানের দুল হঠাৎ খুলে পড়ে গেছে কোথাও! ওরা তিন বান্ধবী মিলে সেটাই খুঁজছে উদ্বিগ্ন চিত্তে! কারণ ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে, এদিকে ঝুমা-র খুব শখের কানের দুল, তা-ও আবার সোনার!

তিনজনই স্মার্টফোনের টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়ে গেল দুলটা। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে! কালবৈশাখী যেমন শুরু হয়ে গেছে তেমনই ছেলেগুলোও ওদের খুব কাছে চলে এসেছে।
হঠাৎ এমন যৌথ বিপদের মুখে পড়ে ওরা বেশ ঘাবড়ে গেল। কিন্তু চটপটে ঝুমা চটপট নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোরা মোবাইল ব্যাগে ঢোকা।
ওই মুহূর্তে ওর প্রথম এটাই মনে হলো যে, ছেলেগুলো ছিনতাইকারী। ওরা মোবাইলগুলো ব্যাগে ভরে যখনই ঘুরে দৌড় দেবে ভাবছিল তখনই একটা ছেলে চাকু দেখিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, দাঁড়া, পালানের চেষ্টা কইরলে বা চিক্কুর দিলে একবারে খুন কইরা ফালামু।

বিদ্যুৎ চমকালে ওর হাতের চাকুটা চকচক করে উঠল। প্রচণ্ড ভয়ে মনা ও পলি-র গলা শুকিয়ে গেছে, ওরা কোনো কথাই বলতে পারল না। ধমকে উঠল ঝুমা, অ্যাই খবরদার, এক পা আগাবি না। বদমাশ ছেলেপেলে, আমাদের চিনিস? তোদের জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।

বিকৃত ভঙ্গিতে হেসে উঠল ছেলেগুলো। একজন বলল, জেলের ভাত পরে খামুনে, আগে একটু…।
তক্ষুনি কাছেই কোথাও বজ্রপাত হলে প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। আর এই সুযোগে ওরা দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু ঝুমা ও পলি উত্তরদিকে দৌড়ালেও মনা বোকার মতো দৌড়াল পূর্বদিকে!
ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে যাওয়ায় ছেলেগুলো প্রথমে বুঝতে পারেনি কে কাকে ধাওয়া করবে। কিন্তু মুহূর্তেই পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে তিনজন ওদের তিনজনকে ধাওয়া করতে গিয়ে পলি-র পেছনের ছেলেটা পা পিছলে চিৎপটাং হয়ে গেল। আবছা অন্ধকারে সে দেখতে পায়নি ঘাসের নিচে ফিচফিচে কাদা আছে।

ঝুমা কিছুটা কোণাকুণি দৌড়াচ্ছিল বলে ওর পেছনের ছেলেটা ওকে ধরতে গিয়ে একটা গাছের নিচু ডালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল।

পলি ও ঝুমা পুকুরের পার ধরে দৌড়ে দ্বিতীয় পুকুরটা অতিক্রম করে হাঁপাতে হাঁপাতে থেমে গেল এবং পেছন ফিরে বুঝল ছেলেগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছে। কিন্তু মনা! মনা কোথায়? বোকাটা পূর্বদিকে দৌড় দিল কেন? ছেলেগুলো ওকে ধরে ফেলেনি তো? এমন অনেক প্রশ্ন ওদের অস্থির করে তুলল। কিন্তু কী করবে, সহসা কেউই বুঝে উঠতে পারল না। আতংকে ওদের মুখ মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

তখনই গেটের নিরাপত্তা প্রহরী সাজু মিয়া পেছন থেকে ওদের ডাকল, আপারা আসছেন? ঝড় শুরু হওয়ার আগেই বের হয়ে আসবেন না?
পলি ও ঝুমা প্রহরী সাজু মিয়াকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল। ওরা হাউমাউ করে ওকে বলল, তিনটা বাজে ছেলে…. ওখানে আমাদের….!
আমরা দৌড়ে…. চলে এসেছি…..।
আমাদের আরেকজন আছে…. মনা…. ওকে ওরা হয়ত….ধরে….!

ঝোড়ো বাতাস আর মেঘেদের গর্জনের ভেতর ওদের দুজনের ভাঙা ভাঙা বাক্যগুলো শুনে যা বুঝবার বুঝে গেল সাজু মিয়া। চোয়াল শক্ত করে বলল, চলেন তো দেখি, তাড়াতাড়ি।

কী ভেবে মনা পূর্বদিকে দৌড়াতে শুরু করেছিল ও জানে না। কিছুটা দৌড়ে যখন বুঝল যে, সে ভুল দিকে দৌড়াচ্ছে, তখন ঘুরে আবার সঠিক দিকে দৌড়াতে গিয়ে পড়ল চাকুঅলা ছেলেটার সামনে! মুহূর্তে যেন ওর শরীরের সমস্ত রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ও হাতব্যাগটা বুকের সাথে চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল, ঝুমা, পলি! কিন্তু ঝোড়ো বাতাস সেই শব্দ উল্টোদিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।

ছেলেটা আবার দাঁত খিঁচিয়ে ধমকে উঠল, চুপ চুপ, শ্যাষ কইরা ফালামু! মনা-র গলা শুকিয়ে গেছে। ওর হাত পা ভীষণ কাঁপছে। বুঝল ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। তক্ষুনি কোথা থেকে একজন মানুষ এসে মনা ও চাকুঅলা ছেলেটার মাঝখানে দাঁড়াল! মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় মনা কেবল তার পেছনদিকটা দেখতে পেল, লম্বা ও সুঠাম দেহের মানুষটার গায়ে ফুলহাতা চেক শার্ট।

চাকুুঅলা ছেলেটা মানুষটাকে ওর সামনে দাঁড়াতে দেখে আবারও দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কে? কে বে তুই? ভাগ! মানুষটা কোনো কথা না বলে শার্টের হাতা গোটাচ্ছে দেখে ছেলেটা চাকু উঁচিয়ে তাকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এল। চোখের পলকে মনা-র সামনের মানুষটা ছেলেটাকে ধাক্কা দিলে সে অনেকটা উড়ে যাবার মতো করে ছিটকে গিয়ে সাত-আট হাত দূরের একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল! সেটা দেখে পলি ও ঝুমা-কে ধরতে না পেরে মনা-র পিছু নেওয়া ছেলে দুটো ভয় পেয়ে থমকে গেল। মানুষটা ওদের দিকে দৃষ্টি রেখেই হাত দিয়ে ইশারা করে মনা-কে পুকুরপারের দিকে যেতে বলল। সাথে সাথে মনা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল সেদিকে। কিন্তু পারে উঠতে গিয়ে বুনো কাঁটার গাছের সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। তক্ষুনি আবার উঠে দৌড়াতে লাগল। ও পুকুরের পারে উঠতেই শুরু হলো বৃষ্টি। তবে ও থামল না, পার ধরে পশ্চিমদিকে এগিয়ে চলল। তখনই ও শুনল ওর বান্ধবীরা ওকে ডাকছে, ম-না, মনা।
ও যেন কিছুটা সাহস পেল। কোনোমতে বলল, এই দিকে।

পুকুরের পারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় ওরা আবার মিলিত হলো। পলি ও ঝুমা দুজনই মনা-কে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করতে লাগল।
তুই ঠিকাছিস তো?
তোর কিছু হয়নি তো?
মনা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ ঠিকাছি।
তুই ঐদিকে দৌড়লি কেন?
ওরা তোকে ধরতে পারেনি, তাই না?
মনা কোনো কথা বলবার আগেই ওদের পেছন থেকে সাজু মিয়া বলল, ওসব পরে শোনা যাবে। আগে চলেন, ভিজে গেলাম সবাই।
ওরা আবার দৌড়াতে লাগল।
ফুলবাগানের কাছে এসে সাজু মিয়া বলল, আপনারা আমাদের অফিসে চলেন। বৃষ্টি কমলে যাবেন।
ওরা তিনজন একসাথে কলকলিয়ে উঠল!
না না, আমরা চলে যাই।
আমাদের এখন যেতে হবে।
ভাই, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভিজতে ভিজতে হলেও চলে যেতেই হবে।

সাজু মিয়া বলল, কিন্তু এখন এই বৃষ্টির মধ্যে তো কোনো গাড়ি পাবেন না!
ঝুমা বলল, কিচ্ছু করার নেই। হেঁটেই চলে যাব। অ্যাই, চল তোরা।

অগত্যা সাজু মিয়া ওদের পিছু পিছু গেট পর্যন্ত এল। তারপর ওদের অনুরোধ করে বলল, এই ঘটনা যেন কেউ না জানে আপারা। মালি ব্যাটা থাকলে এমন অঘটন ঘটত না। কিন্তু ও বাজারে গেছে, আর আমিও আপনাদের ঢুকতে দিছি। এসব জানাজানি হলে আমাদের দুজনেরই চাকরি চলে যাবে!
ওরা সাজু মিয়া-কে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে পড়ল। বাতাসের বেগ কমে গিয়ে এখন বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে। তার মধ্যেই তিনটি মেয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে এগোচ্ছে শহরের দিকে।

আউটার স্টেডিয়ামের কাছে এসে সৌভাগ্যক্রমে ওরা একটা অটো পেয়ে গেল এবং তাতে উঠে পড়ল।
অটোতে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তিনজনই। আর তখন মনা টের পেল ওর বাম পায়ের গোড়ালির একটু ওপরের অনেকটা অংশের পায়জামা ছিঁড়ে গেছে এবং পা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে!

যে মোড় থেকে যাত্রা শুরু করেছিল পলি ও ঝুমা, সেই মোড়েই এসে নামল দুজন। তারপর দুটো রিকশা নিয়ে দুজন দুদিকে চলে গেল। মনা নেমে গেছে আগের মোড়টায়। ওখান থেকে দক্ষিণদিকের গলিতে একটু এগোলেই ওর খুশির নীড়।
বৃষ্টি থেমে গেছে আগেই। সন্ধ্যাও গাঢ় অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে চলেছে। বিদ্যুৎ নেই, বেশ ঝড় হয়েছে বলে আসতে দেরি হতে পারে।

ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ভিজে জবজবে মনা ধীর পায়ে এসে গেট ঠেলে খুশির নীড়-এ ঢুকল এবং তক্ষুনি ওকে চমকে দিয়ে বিদ্যুৎ চলে এল!

নিজের রুমের সামনে এসে মনা দেখল দরজা খোলা, ভেতরে ওর বাবা মকবুল হোসেন খান বসে আছেন! সারা শরীর কেঁপে উঠল মনা-র। ও জানে, এটা যতটা না বাবার ভয়ে তার চেয়ে বেশি হঠাৎ অমন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এবং বৃষ্টিতে ভিজে! নিশ্চয়ই জ্বর-টর এসে যাবে!

বাবার কাছে গিয়ে মনা জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি, কখন এলে? তিনি একটা বইয়ে ডুবে ছিলেন। মুখ তুলে মেয়েকে দেখে বললেন, এ-এই তো। তোর একি অবস্থা!
মনা কিছু বলবার আগেই ওর পেছন থেকে বুয়া বলল, তুমি ঝড়-বিষ্টির মইধ্যে কই আটকা পরছিলা খালা? অমা, ভিজে চুপ চুইপা হয়া আইছ! তোমার আব্বা সেই বিকালে আইছে। তোমারে এই যে কল দিতাছে তুমি ত’ ধরোই না! অমা, তোমার শরীল সুদ্ধা দেহি কাদা!

বুয়াকে থামাতে মনা চট করে বলল, আরে আপনি অতো অস্থির হবেন না খালা। বৃষ্টি নামলে দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছিলাম। ….তুমি একটু বস বাবা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
মকবুল হোসেন খানের মনে একটু খটকা লাগল, হোঁচট খেয়ে পড়ল বলেই এতটা বিধ্বস্ত দেখাবে মেয়েটাকে! আগে থেকেই ও কোনো সমস্যায় পড়েনি তো? মনা কোথায় ছিল বিকেল থেকে এই পর্যন্ত? ও কেন ফোন রিসিভ করছিল না?

তাকে এতক্ষণ ততটা চিন্তিত না দেখালেও, মেয়ের অমন চেহারা দেখবার পর এসব প্রশ্ন তার মনে ঘোরপাক খেতে থাকল।
বইটা বন্ধ করে মকবুল হোসেন খান তার মেয়ের রুমটায় আবারও চোখ বুলাতে লাগলেন। রুম জুড়ে নানান জিনিসপত্র; ক্যানভাস, রং, তুলি, কাপড় রাখবার আলনা, টেবিল-চেয়ার, টেবিল ভর্তি বই, সিঙ্গেল খাটের বিছানা, রান্নার হাঁড়ি-পাতিল, থালাবাসন ইত্যাদি ইত্যাদি! ছোট্ট একটা রুম আর তাতে এত জিনিসপত্র! এর মাঝে তার মেয়েটা স্বস্তিতে থাকতে পারে? ওর আঁকার নেশা, তার জন্য খোলামেলা জায়গা দরকার, এর মাঝে ও আঁকার কাজ করতে পারে? পরীক্ষার আগের রাতে ও সারা ঘরময় ঘুরে ঘুরে পড়ে, এখানে সেটা সম্ভব হয়? একেই মনে হয় বলে মেসবাড়ির জীবন! তিনি বিএ পাস করেছেন বাড়ির কাছের কলেজ থেকেই। জন্মাবধি গ্রামেই থাকেন। কোনো কাজ ছাড়া শহরে এসেছেন বলে তার মনে পড়ে না। আবার কাজে এলেও খুব চেষ্টা করেন যেন রাত্রিযাপন করতে না হয়। ফলে শহুরে জীবন-যাপনে তিনি মোটেই অভ্যস্ত নন। নিজ এলাকার যেমন বড়ো ব্যবসায়ী তারা তেমনই তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি। কিন্তু শহরে এলে এখনো তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করেন। মনে করেন এদের যে কারোর তুলনায় তিনি কিছুই না!
বসে বসে এমনই এলোমেলো ভাবনায় ভেতরে ভেতরে অস্থির হচ্ছেন মকবুল হোসেন খান। অবশ্য এমন নয় যে, আজই প্রথম তিনি মেয়ের এই রুমটায় এসেছেন, কিন্তু আগামীকাল বিকেলের বিশেষ একটা কাজের জন্য তার মনটা খুবই উতলা হয়ে আছে! সে কারণেই আজ মনা সংক্রান্ত সব কিছুতেই তার অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় সবগুলোই তাকে অস্থির করে তুলছে!

মনা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই তিনি বললেন, তৈরি হয়ে নাও মা, বাড়িতে যেতে হবে।
মনা হেসে ফেলল, হঠাৎ! তুমি মজা করছ?
ওকে এখন বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে। মকবুল হোসেন খান স্বস্তি পেলেন। বললেন, আমি তোমাকে নিয়ে যেতেই এসেছি।
কেন বাবা? কোনোকিছু হয়েছে? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো? মা, মেহেদী, আর সবাই?
আহা, এত ব্যস্ত হয়ো না। বাড়ির সবাই ভালো আছে। আসলে কাল বাড়িতে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি।
কিসের অনুষ্ঠান বাবা? আমি সকালেই মা-র সাথে কথা বলেছি, মা তো আমাকে কিছু বলল না!
সব ফাইনাল হয়েছে দুপুরের দিকে। তাড়াতাড়ি করো মা, রাত বেড়ে যাচ্ছে।
আগে বল কিসের অনুষ্ঠান।
ওটা আপাতত গোপনই থাক। তুমি তৈরি হয়ে নাও মা।

সেদিন সন্ধ্যার অনেক পরে বাবা মকবুল হোসেন খান-এর সাথে খুশির নীড় থেকে বেরিয়ে গেছিল মনা। ও তখনও জানত না পরদিন পাত্রপক্ষ ওকে দেখতে আসবার কথা ছিল। পছন্দ হলে বিয়েও হবে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু মাঝরাত থেকে ওর প্রচণ্ড জ্বর উঠে গেছিল!

অনেককেই বলতে শোনা গেছিল মনা-র এতটা জ্বর কোনোদিনও হয়নি। খান বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটা অসুস্থ বলে পুরো বাড়ি জেগে ছিল সারারাত। ফজরের নামাজের আগে আগে মকবুল হোসেন খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সকালেই ছেলের বাবাকে জানিয়ে দেবেন দুদিন পরে আসতে।
আর ফজরের নামাজের পরপরই ঘাম দিয়ে জ্বর নেমে গেছিল মনা-র। তার একটু পরে ও চোখ মেলে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, মা, পানি খাব।
মনা-র মা রাহেলা খানম দ্রুত হাতে এক গ্লাস পানি এনে দিলে ও সেটা ঢকঢক করে গিলে বলেছিল, খুব ঘুম পাচ্ছে মা। বাবা কোথায়?
তোর বাবা নামাজ পড়তে মসজিদে গেছে। কোন নামাজ?

ওমা, ফজরের নামাজ মা। তুই ঘুমিয়ে পড়।
হুম, লাইটটা অফ করে দাও।
রাহেলা খানম দেখেছিলেন সারারাত ছটফট করতে করতে প্রলাপ বকতে থাকা তার মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। জ্বরের ঘোরে মনা একটা নাম বারবার বলছিল, পূরণ! কে এই পূরণ? ওর নামটাই মনা বারবার কেন বলছিল? একটা অজানা শঙ্কায় তার শরীর শিউরে উঠল।
পরদিন পাত্রপক্ষকে আসতে বারণ করে দেওয়ায় তারা আর কোনোদিনই আসেনি!

সেদিন ফজরের পরে ঘুমিয়ে মনা প্রথমবার পূরণকে স্বপ্নে দেখেছিল। অবশ্য কেবলমাত্র ওর পেছনদিকটা! দেখে স্বপ্নেই চমকে উঠেছিল, সেই লম্বা ও সুঠাম দেহ এবং ফুলহাতা চেক শার্ট!
সেই শুরু। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই সে স্বপ্নে মানুষটাকে দেখে। কিন্তু কোনোদিনই পরিপূর্ণ মুখখানা মনা দেখতে পায় না। আর বাস্তবে তো সে দেখা দিতেই রাজি নয়। কেন? এই প্রশ্নের সদুত্তর আজও মনা পায়নি।



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply