মনির হোসেন

রাঙ্গা

অনুগল্প, গল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

মনির হোসেন।।

 

চার মেয়ের জনক দরিদ্র বর্গা চাষী রফিক মিয়া। দুই বিঘা জমি আর রাঙ্গাই তার অভাবের সংসারের ভরসা। চার মেয়ের মধ্যে রহিমা সবার বড়, সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া মেয়েটিকে ঘিরেই রফিক মিয়া ও তার স্ত্রীর সকল চিন্তা। আঠারোতে পা দেওয়া মানেই মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিতে হবে, নাহয় পাড়া প্রতিবেশী, আত্নীয়স্বজনেরা বিভিন্ন রকম অপমানজনক কথা শুনিয়ে দিবে। রহিমা দেখতে মন্দ নয়, গায়ের রং একটু চাপা হলেও শারিরীক গঠন আর মুখমন্ডলের আকৃতি মানানসই, দারিদ্র্যের সংসারে মেয়েকে রফিক মিয়া খুব বেশি পড়াশোনা করাতে পারেনি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানোর পড়ে তার যখন আরেকটা মেয়ে নানান রকম সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করলো তখন রহিমার পড়াশোনার ব্যয় বহন করা আর সম্ভব ছিলো না।

ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা জায়গা থেকে সমন্ধ এসেছে কিন্তু কারও সাথে রফিক মিয়ার বনিবনা হয়নি। কেউ চায় ভুড়ি ভুড়ি টাকা আর গয়নাগাটি আবার কারও ক্ষেত্রে ছেলে একাধিকবার বিবাহিত। ছেলে সন্তানহীন দরিদ্র কৃষক হলেও রফিক মিয়া তার কন্যা সন্তানদের যথেষ্ট ভালোবাসেন। তিনি জেনে শুনে কোন খারাপ পাত্রে কন্যা দান করবেন না। অবশেষে দীর্ঘ চেষ্টার পরে এক প্রবাসী ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন রফিক মিয়া। ছেলে দুবাই প্রবাসী, মোটা টাকা বেতন পায়, বাড়ি ঘরের অবস্থাও ভালো। কিন্তু তারপরও ছেলে পক্ষের কিছু আবদার আছে। অবশ্য এগুলোকে যৌতুক বলা যায় না কারণ যা কিছু চাওয়া হয়েছে সবই তার মেয়ের গহনা, এক জোড়া চুরি, এক জোড়া কানের দুল, গলার চেইন আর পায়ের নুপুর এবং সব মিলিয়ে হতে হবে কমপক্ষে তিন ভড়ি স্বর্নের।



সে দরিদ্র কৃষক, চাষাবাদ করে যা উৎপাদন হয় তা দিয়ে সে সারা বছর সংসার চালায়, বছর শেষ পুঁজির পরিবর্তে জমা হয় হাজার হাজার টাকার ঋণ।ফসলের উৎপাদন ভালো হলে তার কিঞ্চিত পরিমান শোধ করতে পারে কিন্তু একেবারেই কখনও শোধ হয় না। এমন অবস্থায় মেয়ের বিয়ের জন্য তার একমাত্র ভরসা রাঙ্গা। দুই বছর আগে যখন রাঙ্গা প্রথম এই পরিবারের আসে তখন তার মেয়েরা আদর করে নাম দিয়েছিলো রাঙ্গা। তখনকার সেই ছোট রাঙ্গা আজ বেশ লম্বা, মোটাসোটা। গায়ের উজ্জ্বল লাল রঙ, পিঠের ওপরের বড় আকারের চোষ, বড় বড় দুইটা শিং আর ভরাট নিতম্ব তাকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

এক সপ্তাহ পরে কুরবানীর হাট। এই হাটে রাঙ্গাকে বেশ উচ্চমূল্যে বিক্রি করা যাবে আর সে অর্থ দিয়ে মেয়ের বিয়ের গহনা কিনবেন রফিক মিয়া। রাঙ্গাকে ঘিরেই এখন তার স্বপ্ন, সকল আশা। ছেলেহীন রফিক মিয়া রাঙ্গাকেই যেন তার ছেলে মনে করেন। কারণ রাঙ্গাইতো নিজেকে উৎসর্গ করে তার বড় মেয়ের বিয়ের টাকার ব্যবস্থা করবেন। মাঝেমধ্যে রফিক মিয়ার মনটা হুহু করে উঠে, বুকে এক করুণ ব্যাথা অনুভব করে, সেই দুইমাস বয়স থেকে কত যত্নে, কত আদরে কত ভালোবাস দিয়ে রাঙ্গাকে তিনি বড় করে তুলছেন, খেত থেকে রোদে পুড়ে কচি কচি ঘাস তুলে এনেছেন,অভাবের মধ্যেও রাঙ্গার কুড়া, ভুষির কোন অভাব হয়নি, ভাতের মাড়, আলু সিদ্ধ, আটা সিদ্ধ কিছুই যেন তাকে খাওয়ানো বাদ দেননি রফিক মিয়া। কিন্ত রফিক মিয়ার সকল কষ্ট দূর হয়ে যায় যখন তিনি ভাবেন রাঙ্গার প্রতিদানেই তার কন্যার বিয়ে হবে, তার মেয়ের সুন্দর একটা সংসার হবে।

তিনদিন পরে প্রথম কুরবানীর হাট বসবে। এখন রাঙ্গাকে নিয়ে বাড়ির সবার প্রবল ব্যস্ততা। তিনবেলা কুড়া ভুষি, আলু সিদ্ধ, ভালোমানের খড় দিয়ে রাঙ্গাকে আরও স্বাস্ত্যবান করার চেষ্টা চলছে, প্রতিদিন একবার করে ভালো মতো সাবান দিয়ে গোসল করানোও হচ্ছে। তার জন্য তৈরি হয়েছে এক মুজবুত রশি, তাতে দেওয়া হয়েছে লাল রঙ আরও তৈরি হয়েছে একটা সুদর্শন মালা।



মালাটা তৈরি করেছে তার বড় মেয়ে রহিমা। কোমল হাতে, আবেগ ভালোবাসা মিশিয়ে সে যেন তার ভাইয়ের জন্যই মালাটা তৈরি করেছে। এমনকি মালটা পড়ানোর সময় তার চোখ দিয়ে কিঞ্চিত জলও গড়িয়ে পড়েছিলো।
অবশেষে আসলো সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত দিন। ঘুম থেকে উঠেই রফিক মিয়া তার অতি আদরের রাঙ্গাকে গোসল করালো। তারপর যত্নসহকারে কুড়া ভুষি আর আলু সিদ্ধ খাওয়ালো। কন্যারা রাঙ্গাকে ঘিরে রেখেছে, একজনের পর একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাঙ্গাও চোখ বন্ধ করে, ঘাড় উচু করে হাত বুলানো অনুভব করছে।
সকাল আটটায় রফিক মিয়া রাঙ্কাকে নিয়ে হাটের উদ্দেশ্য রওনা হলো, সে একা মানুষ তাই তিনি সঙ্গে নিলেন তার শালা আব্বাসকে।
তার চার কন্যা ও স্ত্রী ছল ছল চোখে রাঙ্কাকে দেখছে, কিছুদূর সাথে আসার পরে কান্না চেপে রাখতে না পেরে মুখে আঁচল চেপে ধরে বাড়ির দিকে ছুটলো রফিক মিয়ার স্ত্রী তার পিছন পিছন ছুটল তার চার কন্যা।
বর্ষাকালে কয়েকদিন বৃষ্টির পরে যে গুমোট গরম আর প্রখর রোদ উঠে তার মধ্যে দিয়েই রাঙ্গাকে নিয়ে হেটে যাচ্ছে রফিক মিয়া। স্বভাবে রাঙ্গা খুব শান্ত শিষ্ট তাই তাকে নিয়ে হাঁটতে রফিক মিয়ার কোন কষ্টই হচ্ছে না।

গত কয়েকমাস নিয়ম মাফিক খাওয়া আর যত্নের ফলে রাঙ্গা বেশ মোটা তাজা হয়ে উঠেছে, তার শরীরের পুরু মেদ আর বিশাল ভুড়ির কারণে সে কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই হাঁপিয়ে উঠছে, কিছুদূর যাওয়ার পরে বসে পড়ছে, রফিক মিয়ার হাক ডাকে আবার উঠে কিছুদূর হাটে আবার আগের অবস্থা। নানান বিষয়ে চিন্তিত আর স্বপ্নে বিভোর রফিক মিয়া তার সন্তানতুল্য রাঙ্গার কষ্টের কথা যেন অনুভব করতে পারছে না।
এভাবে রোদ আর গরমে টানা দুই ঘন্টা হাঁটার পরে রাঙ্গা যখন কুরবানীর হাটে পৌঁছালো তখন সে খুবই ক্লান্ত, একটু পানির জন্য তার মুখ দিয়ে বুদবুদ মিশ্রত লালা বের হচ্ছে কিন্তু তার দিকে রফিক মিয়ার একটুও খেয়াল নেই। রাস্তা দিয়ে আসার সময় গরম ছিলো তবে বাতাসও ছিলো কিন্তু এই বিশাল কুরবানীর হাটের মধ্যে যেন একটুখানি বাতাস নেই, মাথার ওপরে নেই এক তিল ছায়া, মানুষ আর কুরবানীর পশুর গরম নিঃশ্বাসে যেন মাঠ উত্তপ্ত কড়াইয়ের রূপ ধারণ করেছে।



রাঙ্গার মতো বড় আর স্বাস্থ্যবান গরু কুরবানির হাটে কমই আছে। তাই ধনী ক্রেতারা রাঙ্গাকে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে, অনেকে আবার দামদরও করছে কিন্তু কারও সাথেই বনিবনা হচ্ছে না। সকাল গড়িয়ে দুপুর এলো, রোদ আরও বাড়লো সাথে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়লো। একজন ধনী ক্রেতা এসেছে রফিক মিয়ার কাছে, রাঙ্গাকে তার খুব পছন্দ হয়েছে। দামাদামির সময় রফিক মিয়ার আবদার করা টাকার প্রায় সবটাই দিতে তিনি রাজি হলেন। রফিক মিয়া বেজায় খুশি, এ তো তার প্রত্যাশার থেকেও বেশি। ধনী ভদ্রলোক দেড় লক্ষ টাকা রফিক মিয়ার হাতে দিয়েছে, রফিক মিয়া গভীর মনোযোগে টাকাগুলো গুনছে হঠাৎ ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দে তার চেতনা ফিরলো। এ তো রাঙ্গা মাটিতে পড়ে আছে, তার চোখ দুটো উল্টানো, মুখ দিয়ে অনবরত লালা পড়ছে,পা দুটি দুদিকে ছোড়াছুড়ি করছে এ যেন মৃত্যুর আগের মুহূর্তের যন্ত্রণা। রফিক মিয়ার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে, চোখ দিয়ে অশ্রু বন্যা বয়ে যাচ্ছে তবুও তিনি যেন রাঙ্গার কাছে যেতে পারছেন না, পা দুটি তার যেন অসাড় হয়ে গেছে, কথা বলতে তিনি যেন ভুলে গেছেন। তাও মুখ ফুটে ওষ্ঠদ্বয় কাঁপিয়ে তিনি ক্ষৃন কন্ঠে বলে উঠলেন প্রতিদান, প্রতিদান। হয়তো সে কথা রাঙ্গার কান পর্যন্ত পৌছায়নি তাইতো সে অকৃতজ্ঞের মতো শ্বাস প্রশ্বাসহীনভাবে পড়ে রইলো উত্তপ্ত বালুকনা মাঝে।



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply