সায়ন্তন সৈকত রায়

উপহার

গল্প, ছোটগল্প
লেখাটি শেয়ার করুন

সায়ন্তন সৈকত রায়।।

 

মনে পড়ে তোমার জন্মদিনে অনেক খুঁজে-পেতে একটি সুগন্ধী কিনে এনে উপহার দিয়েছিলাম। আচ্ছা, ওটি এমনিতেই কম দামী ছিলো, তেমন বেশি খোঁজ লাগাতেও হয়নি। তারউপর সুগন্ধী বলাতে আরো হালকা শোনাচ্ছে। যদিও বানানটি “সুগন্ধি” হয়তো, মিছেমিছি ওজন বাড়াতেই ঈ- কার ব্যবহার করা। আসলে, তোমাকে বোধহয় বলিনি, শব্দ নিয়ে ভাবতে আমার ভালই লাগে। এই যে দুটো শব্দ “কম দামী”, আবার একটি শব্দ দেখো, “সস্তা”, পড়ার ফারাকটি দেখেছো। আচ্ছা, সুগন্ধী না বলে কি শব্দটি সৌগন্ধী বলা যায় না!

বলতে পারো এত হ্যাপা কীসের, দুম করে লিখে দিলেই তো হয় পারফিউম। কিন্তু বঙ্গভূমে এহেন ইংরেজ নিমন্ত্রণে আমার ভারী আপত্তি। সেদিন শীর্ষেন্দুর এক উপন্যাস পড়তে নিলাম, পূজাবার্ষিকীর। তার হাতে-পায়ে এত ইংরেজি শব্দ মিশে গেছে, মনে হচ্ছিল বাংলা হরফেই চৌধুরী এন্ড হুসেনের ইংরেজি ব্যাকরণ বইয়ের গল্প লিখনের অংশটি পড়ছি।

যাকগে, কী যেন বলছিলাম, ও হ্যাঁ। তোমার জন্মদিনে আমার উপহার দেয়া.. সৌগন্ধীই লিখি। ভারী চমৎকার দেখাচ্ছে। তো সেদিন আমার ঘুম বড় দেরিতে ভেঙেছিলো। সকালে পরীক্ষা ছিলো তাই ভোরেই উঠেছিলাম তখন পর্যন্ত বাকি থাকা পড়াগুলো সামলে নিতে। তারপর দে ছুট পরীক্ষায়। কোনকিছু খেলামই না। আসলে তুমি তো জানোই, পরীক্ষার আগমূহুর্তে আমার পানি খেলেও বমির ভাব হয়। আবার একমাত্র ঐ সময়টাতেই আমি বিশটি টাকা খরচ করে রিকশায় চেপে কলাভবন যাই। হাতে থাকে ক্লাসের পড়া তোলার খাতা, চোখ গিলে সব মগজে পাঠায়। অন্যকিছু গেলার অবকাশ কই! তাও দেখো, পরীক্ষার খাতায় সবাই কমবেশিতো বমিই করে। তো পরীক্ষা দিয়ে ফিরে খেয়েই এমন ঘুম দিলাম, এমনিতেই সকালের ব্যস্ততাতে তোমার জন্মদিন খেয়াল ছিলো না, ঘুমের তোড়ে বিকেল পেরিয়েও মাথায় খেলতো না যদি, যদি না সন্ধ্যাবেলায় সেই স্বপ্নটি দেখতাম।



কী স্বপ্ন? আন্দাজ করো তো। তুমি আছো ওতে। ভয় নেই, ঘনিষ্ঠতার কিছু না, আচ্ছা তুমি এই এদ্দিন বাদেও আদর দেয়া নেয়ার কথায় এত লজ্জা পাও কেন? আমাকে ভালবাসোতো নাকি, আমিও তোমাকে ভালবাসিতো, নাকি? তাহলে? কেন তোমার দুটো পায়রার মতো বুক নিয়ে একটু ভাবলেই অমন লাল হও! বাদ দিই, আন্দাজ করতে পারলে? চেষ্টাই করো নি!

আমি কি স্বপ্ন দেখলাম জানো, আমরা আবার পোস্ট অফিস হাই স্কুলের ছাত্র ছাত্রী হয়ে গেছি। তুমি প্রভাতী বালিকা শাখায় নবম শ্রেণী বাণিজ্য বিভাগ, আমি দিবা বালক শাখায় নবম শ্রেণী মানবিক বিভাগ। আর বাবা সকালে রুটি চিবোতে চিবোতে বলছেন, ছেলে মেয়েদের আলাদা পড়ালেখাই ভাল। একত্রে পড়লেই শুরু হয় প্রেম পিরীতি, চিঠি চালাচালি যতোসব। – এ’কথা শুনে যেন সুতপা তর্ক করেছিল। বলেছিল, তুমি আর মা যে এক ক্লাসে পড়তে।

বাবা আর মা হয়তো এক ক্লাসে পড়তেন না। কিন্তু বাবা দুই ক্লাস ফেল করে মায়ের সাথেই আর্টসে ঢুকে মেট্রিকটা পাশ করেই ঠাকুর্দার গদিতে বসে ব্যবসায় লেগে গিয়েছিল আর দাদু মায়ের গড়পড়তা মেধা নিয়ে কলেজে আইএ পড়ার চেয়ে বিয়েতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। মায়ের সাথে একই ক্লাসে পড়ায় তাকে বাবার অনেক মনে ধরেছিল। ভালবাসার মতো ব্যাপার বাবার সাথে যায় না। আর ওদিকে ঠাকুর্দার টাকার কারণে বাবার মনে ধরা সিদ্ধিতেও কোন সমস্যা হলো না।

কিন্তু তুমি আমি যে একই সময়ে বাস করি, একই পড়া পড়ি, একই নোট সাজাই খাতায় একইসাথে, তাতে বড় ভয় আমাকে পেয়ে বসতো। একটু আগুপিছু হলে কী হতো, এই ধরো মানব’দা- দোলার মতো। মানব’দা যখন হামাগুড়ি দিচ্ছে তখন দোলা মায়ের পেটে। তেমনি তুমিও থাকতে আমার আধো বোলের বেলায়। মা’র পেটে লাথি মারতে কী? আমি নাকি খুব নড়তাম- চড়তাম।



ওহহো, সেই স্বপ্নের কথা। তো আমাদের দেখা হবার উপায় তো সেই সকাল আটটায় টিউশনে যাবার সময় তোমার স্কুলগামী রিকশায় ওঠার আগের দুই মিনিট, স্কুল ছুটি আর আমাদের ক্লাস শুরুর আগে চার মিনিট, একটু দেরি হলেই সালেহ স্যার আর ঢুকতে দিতেন না। বিকালে তোমার টিউশনি যাবার আগে স্কুলের গেট থেকে জলদি প্যাডেল চেপে আবার সেই কিছু সময়। তুমি তোমার স্কুল ছুটির সময় বলতে, “তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা…”। আমি আলতো করে গালে টোকা দিয়ে ঢুকে যেতাম। স্বপ্নে দেখলাম সেরকমই একটি সময়। দেখি, আমি টিউশন থেকে ফিরে, হ্যাঁ, একদম স্পষ্ট স্পষ্ট, আমি টিউশন থেকে ফিরে জলদি খাবার খেয়ে মায়ের বকুনি পাত্তা না দিয়ে দ্রুত ছুটছি সাইকেলে। তোমাদের ছুটির ঘন্টা বাজলো বলে। ক্রমে মোড়ের পর মোড় পেরিয়ে চোখের সামনে গজিয়ে উঠে পোস্ট অফিস ভবন। স্কুলের পাশে পোস্ট অফিসটি কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগতো। আমার মনে হয়, ওতে তো এখন যুবক কেউ আসে না। সব টাকা জমানো বুড়ো বুড়ির দল। তাই হয়তো। ওটিকে সাইকেলে দ্রুত পেরিয়ে যাবার মুহুর্তে হঠাৎ দেখলাম তুমি বসে আছো ওরই বারান্দায়। আমি থমকালাম। এত জলদি তো আজিজা ম্যাডাম ছাড়েন না কখনো। তুমিই কতবার অনুযোগ করেছো। আজ হলোটা কী!

আমি সাইকেল ঢুকাচ্ছি পোস্ট অফিসে, ওমা, হঠাৎ দেখি কে এক টিঙটিঙে লম্বা ছেলে এসে বসলো তোমার পাশে। তারপর তোমরা বেশ গল্প জুড়ে দিলে। আমি সামনে গিয়ে হাত নাড়লাম। তুমি দেখলে না। ছেলেটা একবার ভ্রু কুঁচকালো। আমি ছাড়া অন্য কাউকে তুমি যদি বিয়ে করো, তাহলে সে যেমন কুচ্ছিত হবে, তেমনই বিশ্রী সেই ছেলেটির চাহনি। আমি ভড়কে গিয়ে বললাম, কয়টা বাজে?..তুমি শুনে আমার পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে রইলে। ছেলেটি বলল, এগারোটা চুচুললিশ!

এত বড় একটি ছেলে চুয়াল্লিশকে চুচুললিশ বলে উচ্চারণ করে আর তুমি তার পাশে বসে। তুমি তার সাথে গল্প জুড়েছো। তুমি, আমি হাত নাড়ছি দেখেও ফিরে তাকালে না। তারপরও এই পৃথিবীর কোথাও সমুদ্র শুকিয়ে যায়নি, কোথায় পর্বত ফেটে অগ্নুৎপাত হয়নি- এটিই তো আশ্চর্য। আরো আশ্চর্য দেখতে আমি তোমাদের পাশেই একটু দূরে, যেখানে তোমার ছায়া আমারই কোলে পড়ে, এমন করে বসলাম। মুখ করে রইলাম অন্যদিকে, কিন্তু চোখের মণি একদম পাশ ঘেষে কোণায় বসে তোমাকেই দেখছিলো। কিন্তু কী অদ্ভুত, তোমরা গলার স্বর নিচুতে নামিয়ে আনলে। আমি একটি বাজারচলতি গানের শিস ভাজছিলাম, তা বন্ধ করেও তোমাদের কোন কথাই শুনতে পেলাম না।



কষ্ট লাগলো খুব। কেন তুমি এমন করছো। এদিকে বারান্দা পেরিয়ে হেড পোস্ট মাস্টারের ঘরের খোলা দরজায় ঘড়ি দেখা যায়। ঘড়িতে ক্রমে এগারোটা পঞ্চাশ, বায়ান্ন, পঞ্চান্ন, ছাপ্পান্ন, সাতান্ন, আটান্ন বেজে চলে। আমার মনে হয় আজ যেন সালেহ স্যার ক্লাস টেস্ট নিবেন। সেটির উপরই যেন এসবিএ নম্বর দিয়ে দেবেন। যারা অনুপস্থিত, মানে দশ সেকেন্ডও দেরি করবে ক্লাসরুমে ঢুকতে, যেন তাদের পুরো নম্বরই বাদ। আর বাদ দিলেই পরীক্ষা খারাপ আর আমার দু’বার ফেল করা বাবা আমার মাঝে নিজেকে দেখতে পেয়ে সবসময়ের মতো ক্ষেপে যাবেন। তারপর “প্রহারেন ধনঞ্জয়ঃ”।

আমি আবার তাকালাম তোমার দিকে। তুমি ওই হারামজাদার দিকেই তাকিয়ে আছো। আমি উঠলাম। স্পষ্ট মনে আছে, তোমার পায়ের কাছে একটি কুকুর বসে ছিলো। সেও আমার ওঠার শব্দে চমকে ফিরে চেয়েছিলো। কিন্তু তোমার কোন বিকার নেই। অনেক কষ্ট লাগলো। অনেক!

তারপর আমি চলে গেলাম। আমাদের দিবা- প্রভাতী বিভাজনের পরও এই আসা যাওয়ার মাঝে খানিকটা সময়, সেটিও তুমি আমাকে দিলো না। আমার বুক এত ভারী হয়ে গেল যে আমি ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম। দেখি মোবাইলে সময় সাড়ে পাঁচটা পেরিয়ে গেছে আর তারিখটা ২৪ ডিসেম্বর!

তোমার জন্মদিন!

তাড়াতাড়ি বাথরুমে ছুটে মুখ ধুয়ে শীতে বেরুবার জামা পড়তে পড়তে ভাবতে লাগলাম কী উপহার দেয়া যায়। বই, সে তুমি আমার চেয়ে অন্তত সাতগুণ বেশি পড়েছো। ঘড়ি, দুটো আছে। চাদর, অনেক দাম!

ভাবতে ভাবতেই নিচে নামা। চত্বরে সৌমিক, জুবলি, শোভনরা গান ধরেছে – তোমার ফরাসী সৌরভ আনায় আনায়, অভিমান অপর্না সেন… আরে বাহ্, সে.. থুড়ি সৌগন্ধী দেবার ভাবনাটি তখনই মাথায় এলো। হেঁটেই চলে গেলাম পলাশী। নিচের মাছ, তরকারি বাজার খানিক আমাদের সংসারের স্বপ্ন দেখালো। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই শেভিং ক্রিম, ত্বকের ক্রিম, কোল্ড ক্রিম, শুধুই পুরুষের জন্য, নারীর বয়স দশ বছর কমানোর ক্রিম সহ হরেক রূপচর্চার পসরা। নিশ্চয়ই সৌগন্ধী থাকবে ওসব দোকানে। পেলামও, কিন্তু প্রচুর দাম। ও’টাকায় একটি কাতল মাছ কিনে, কেটে কুটে তোমাকে দিয়ে “রেঁধো তো, কাল ক্লাসের পর ক্যাফটেরিয়ায় বসে খাবো” বলে পেট টেপা আঙুলের আঁশটে গন্ধে তৃপ্তি পাওয়া যায়, সৌরভে নয়।



দোকানদার সদ্য পরিচিত। তবুও আমাকে দ্বিধায় সাঁতরাতে দেখে বললো, নরমাল দেশি আতর নেন। সোন্দর বোতলে রাখবেন আরি। – শুনে আমি যেন সেই অষ্টম শ্রেণীর মার্চ মাসের আট তারিখ বিকেলে তোমার প্রথম হাসিটিই পেলাম। হাতের মুঠোয় চমৎকার চোখবাহারি বোতল। তাতে দিশি আতর। সৌরভটিও ভালো। একটু আমার দু’পায়ের পাতায়, আঙুলগুলোর ফাঁকে ছড়িয়ে নিলাম। জুতো খুললে বড়ই বাজে গন্ধ করে। তারপর দাম দিতে গিয়েই দেখি, মানিব্যাগ নেই। শীতের মোটা কাপড় পেরিয়ে শার্টটির বুক পকেটেও হাতড়ালাম। ওখানেও কোন টাকা ভুলে রাখা নেই। একটু হেসে বললাম, পাঁচ মিনিট রাখুন। আমি টাকা ক্যাশ আউট করে আনছি। – একটু সরে বিক্যাশের হিসাব দেখলাম। তাতে সাতাশ সংখ্যাটি আমায় ব্যঙ্গ করলো। উপায় তো আছে। রিপনকে কল দিলাম। পৃথিবীর একমাত্র একঘেয়ে নারীকন্ঠ জানালো যে সিমে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তখন ভেবে দেখো আমার অবস্থা। একে তো সেই কুচ্ছিত, কদাকার স্বপ্ন, তার উপর এসব! দশ টাকা রিচার্জ করলাম ঘাম ভেজা আঙুলে, বিক্যাশে ভুল সংখ্যাও চলে যাচ্ছিল তাই। তারপর রিপনকে কল। ধরলো না। শ্যামলকে দিলাম। রতন, বাপ্পী, চয়ন, তৌহিদ, আরাফ, রজত, অপূর্ব, সুপ্রভা, সাহানা, অনিমা, সাদিয়া, মুনিয়া, সোমা — কেউ ধরলো না। কী অদ্ভুত!

বাবার ভাষায়, আমার “ডাল গলে গেলো!”।

নেমে গুটি পায়ে তোমার হলের দিকে যাচ্ছি। এমনিই শুভেচ্ছাবো। পথচলতি দেয়ালের ধারে পরিচিত কেউ যদি প্রেম করে তাহলে বিশটি টাকা ধার পেতে পারি, দুটো গোলাপ হয় তাতে। বা, যদি শিক্ষকদের বাসার শিকঘেরা প্রাচীরে হাত ঢুকিয়ে বাগানের কিছু চমৎকার ফুল ছেড়া যায়, আসল সৌরভ তো ওতেই। এসব অসহায় প্রায় অসম্ভব ভাবার বেলায় তৌহিদ ফিরতি কল দিলো। না নেই। ওর বিক্যাশ ফাঁকা। সোমাও ফিরতি কল দিলো আর জানালো সে টাকা দিচ্ছে এখুনি। কী আনন্দ, চাপ থেকে মুক্তি, হচ্ছে তাহলে সৌগন্ধ!

খানিক বাদেই আমার হাতের মুঠোয় আবার সেই সৌগন্ধী। আনায় আনায় যা কেনা!

তারপর দে ছুট তোমার হলের দিকে। মোবাইলের ডিজিট রূপান্তরিত সাতটা তিনে। যখন আর একটা মোড় বাকি তখন সাতটা সাতাশ। আটটায় তো হল বন্ধ, এই তুমি জানো, এখন যে দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে হল, আন্দোলনের পর? তখন থাকলে কী সুবিধা হতো! আমি তখন ভাবছি কখন তোমায় ফোন দেবো, কখন কী কথা বলবো। গতরাতের পর কত কথা জমে আছে। স্বপ্নটা বলবো নাকি সৌগন্ধী কেনার আগে টানটান উত্তেজনাটি নাকি আজ পরীক্ষার হলে আমাকে বারবার পেছনে সাহানার খাতার দিকে তাকাতে দেখে জায়গা বদল করে দেবার পরও পুরো উত্তর করে আসতে পারার সাফল্যটি। ভাবার ক্রমেই চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো তোমার হল।



হল ভবনটি বড় ম্যাড়মেড়ে। ওর সামনে তো প্রেমিকরা কেউ আসে না। প্রক্টর আর প্রভোস্টের কড়া হুশিয়ারি। যাদের ভালবাসবার তারা ঐ কড়ই গাছ পেরিয়ে রঞ্জুর চা নাস্তার টং দোকানের চারপাশে ভালবাসে। সেদিকে চোখ না ফেলতে গিয়ে ফেলার মুহুর্তে হঠাৎ দেখলাম তুমি বসে আছো ওই টঙেরই একটি চৌকিতে। আমি থমকালাম। এই রাত এগুনো সন্ধ্যায় তুমি তো আমি ছাড়া বাইরে থাকোনা কখনো। হাত পা মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে শ্রীকৃষ্ণের ছোট্ট ছবিতে প্রণাম করেই তুমি চলে যাও রিডিংরুমে। নইলে নাকি জায়গা পাওনা। তুমিই কতবার অনুযোগ করেছো। আজ হলোটা কী!

আমি এগুচ্ছি তোমার দিকে, ওমা, হঠাৎ দেখি কে এক ল্যাদভ্যাদে বেঁটে ছেলে তোমার পাশেই এসে বসলো।  তারপর তোমরা বেশ আন্তরিক গল্প জুড়ে দিলে। আমি একবার তোমাদের পেছনে গিয়ে আড়চোখে চাইলাম, তুমিই তো? হ্যাঁ, তুমিই তো! তাই সামনে গিয়ে হাত নাড়লাম। তুমি তাকালেই না। ছেলেটা তাকালো দুই ভ্রু কুঁচকে। আমি ছাড়া অন্য কাউকে তুমি যদি বিয়ে করতে, তাহলে সে যেমন কুচ্ছিত হতো, তেমনই বিশ্রী সেই ছেলেটির চাহনি। আমি বুক টানটান করে তোমাকেই বললাম, কয়টা বাজে?..তুমি শুনেও আমার কোমর বরাবর তাকিয়ে রইলে। ছেলেটি বলে উঠলো, সাতটা সয়তিরিশ।

এত বড় একটি ছেলে ছত্রিশকে সয়তিরিশ.. মানে ছয় তিরিশও না, ফরাসি ঢঙে কাথো দিজ উইত্ এর ভঙ্গিতে বলছে – তাহলে বলা যেতো, “সয়তিরিশ” বলে উচ্চারণ করে আর তুমি তার পাশে বসে। তুমি তার সাথে গল্প জুড়েছো। তুমি, আমি হাত নাড়ছি দেখেও ফিরে তাকালে না। তারপরও হলের প্রভোস্ট ছুটে এসে তোমায় বকেনি, রাজনৈতিক দলের মেয়েরা এসে চাঁদা না দেয়া আর তোমার সাথে ঐ পাঁঠাটিকে বসতে দেয়ার অপরাধে রঞ্জুর টঙটি ভাঙচুর করেনি- এটিই তো আশ্চর্য! আরো আশ্চর্য দেখতে আমি তোমাদের পাশেই একটু দূরে, যেখানে সড়ক বাতির আলোয় তোমার ছায়া আমারই কোলে পড়ে, এমন করে বসলাম। মুখ করে রইলাম সবদিকে, কিন্তু মন আর চোখের মণি একদম পাশ ঘেষে কোণায় বসে তোমাকেই দেখছিলো। কিন্তু কী অদ্ভুত, তোমরা গলার স্বর নামিয়ে আনলে একদম নিচুতে। আমি একটি বাজারচলতি গানের শিস দিচ্ছিলাম, ফিরে দে আগুন না ছিড়ে দে ফাগুন, কী যেন। বাজারচলতি গানের এই সমস্যা, সুরকারগুলোর ধ্রুপদেরই প্রাথমিক জ্ঞান নেই। গিটারে টুংটাং শিখেই সুরকার বনে যায়। এত চমৎকার ঘটনার সাথে জড়িয়ে যে গান তা ঠিকমত মনেই পড়ছেনা। যাকগে, সেই শিস বন্ধ করেও তোমাদের কোন কথাই শুনতে পেলাম না।



কষ্ট লাগলো খুব। কেন তুমি এমন করছো! এদিকে মোবাইলে ক্রমে সাতটার পর সেই চুচুললিশ আর পঞ্চাশ, বায়ান্ন, পঞ্চান্ন, ছাপ্পান্ন, সাতান্ন, আটান্ন বেজে চলে। হলের দারোয়ান বাঁশি বাজালে আমি আবার তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে। তুমি ওই হারামজাদার দিকেই তাকিয়ে আছো। আমি উঠলাম। খেয়াল আছে, তোমার পায়ের কাছে একটি কাগজ পড়ে ছিলো। সেটিও আমার পা ঘুরানোর বাতাসে উড়তে চেয়েছিলো। কিন্তু তোমার কোন বিকার নেই। অনেক কষ্ট লাগলো। অনেক!

তারপর তুমি হলের ভেতর ঢুকে গেলে। আটটা বাজতে মিনিট সাড়ে দুই, আর ছেলেটি আমার দিকে চেয়ে হাসিতে ভেঙে পড়লো। বললো, আমার সাথে কথা পরে হবে, গেটের কাছে গিয়ে ওকে ডাক দিন, আর যা এনেছেন তা জলদি দিন।

আমি “হ্যাঁ?” বলেই ছুটলাম গেটের কাছে। ঐতো তুমি দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছো। তোমার পেছনে পোস্ট অফিস হাই স্কুল। তুমি বলবে, তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা। আমি সৌগন্ধী বাড়িয়ে বললাম, শুভ জন্মদিন উপমা!, তুমি হাত বাড়িয়ে নিলে। দারোয়ান একটু খেঁকালো। তুমি সৌরভ মাখলে, কী যেন বলতে গেলে, হতচ্ছাড়া দারোয়ান হাউমাউকাউ করে উঠলো। চমকে গিয়ে তোমার হাত থেকে পড়তে লাগলো সৌগন্ধীর ছোট্ট বোতল। মেঝেতে পড়ে ভেঙে শিশিরের মত ছড়িয়ে পড়লে শিশিটি। আর পুরো হল মেখে নিলো উপমা রক্ষিতের ঘ্রাণ!

শুভ জন্মদিন উপমা! আজও তোমার জন্মদিনের কথা বিকেল অব্দি মনে ছিলো না। এই লেখায় না চাইতেও কত ইংরেজি শব্দ যেমন লিখতে হয়েছে, তেমনটিই তোমার সাথে আজ সকালের ঝগড়া বা মাঝেসাঝে কুতর্ক, রাগ অভিমান, এসব ভুলে যাওয়া-যাওয়ি। সেসবের জন্য ক্ষমা চাইছি। আর তোমায় কী উপহার দেবো, তাই এই লেখাটুকই থাক।

পড়ো, একটু হেসো, ভালবেসো।


লেখাটি শেয়ার করুন

One thought on “উপহার

Leave a Reply