পল্লব হালদার

বাস্তুসাপ

অলৌকিক, গল্প, ছোটগল্প, ভৌতিক, রহস্য-রোমাঞ্চ
লেখাটি শেয়ার করুন

পল্লব হালদার।।

 

সেদিন বিখ্যাত জ্যোতিষ ও তন্ত্রবিশারদ শ্রী বিশ্বনাথ আচার্য নিজের ঘরে চুপ করে বসেছিলেন। নিজের সারাটা জীবন তন্ত্রসাধনা ও জ্যোতিষচর্চার পিছনে দেওয়ার জন্য সংসারধর্ম আর হয় নি। সঙ্গী কেবল ওই সারাক্ষনের কাজের লোক বিনোদ। তখন শ্রাবন মাস। ২ দিন ধরে বাইরে বারিরাশি অঝোরে ক্রন্দন করে চলেছে। থামার যেন নাম গন্ধই নেই।

“না আজ আর কেউ আসবে না।”
নিজের মনে কথাগুলো বলতে বলতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় জ্যোতিষ বিশ্বনাথ আচার্য।
হঠাৎ বাইরে কলিংবেলের শব্দ শুনে চমকে ওঠেন তিনি।
এই অসময়ে আবার কে এলো?
“ওরে বিনোদ দেখতো! কে এলো?”
নিজের কাজের লোকের উদ্দেশ্যে কথাগুলি চেঁচিয়ে বলে ওঠেন তিনি।

 

খানিক বাদে বিনোদ এসে খবর দিয়ে গেলো,
“বাবু আপনার সাথে ২ জন দেখা করতে এসেছে।
বললো খুব দরকার। আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
“ওদের বৈঠকখানাঘরে বসা!আমি আসছি।”
বিনোদকে নির্দেশ দিয়ে তৈরি হতে থাকেন বিশ্বনাথ।

এমন ঝড়- জল মাথায় নিয়ে যখন দেখা করতে এসেছে, তখন নিশ্চয় খুব বিপদ….



তৈরি হয়ে বিশ্বনাথ যখন বৈঠকখানা ঘরে পৌঁছালো, তখন বাইরে বৃষ্টি আরো জোরালো।

বিশ্বনাথ দেখলো বৈঠকখানায় একজন পুরুষ ও একজন মহিলা বসে আছে। বয়স ত্রিশোর্ধ। সম্ভবত স্বামী, স্ত্রী। চোখে, মুখে কেমন যেন ভয়, আতঙ্ক, উৎকন্ঠা একসঙ্গে জাঁকিয়ে আছে। বেশ কয়েকটা বিনিদ্র রাতের ক্লান্তির ছাপ সুস্পষ্ট।
বিশ্বনাথ কে দেখে তারা উঠে দাঁড়ালো।
ইশারায় তাদেরকে বসতে বলে জ্যোতিষ বিশ্বনাথ নিজের আসন গ্রহণ করলেন।

 

“বাবা! আমার ছেলেকে বাঁচান! ছেলে আমার মরে যাবে! আপনি আমাদের শেষ ভরসা। বাঁচান ওকে!”
সামনের নারীমূর্তিটি ডুকরে কেঁদে ওঠে।

 

অভিজ্ঞ বিশ্বনাথ কেমন যেন চমকে উঠলেন।
এই বৈঠকখানা ঘরে ঢোকার পরপরই কেমন যেন একটা বিশ্রী আঁশটে গন্ধ খেলে বেড়াচ্ছে।
তিনি নিজে নিরামিষাশী। বিনোদ ও। বাড়িতে মাছ ঢোকার প্রশ্নই নেই। তবে এমন বিশ্রী আঁশটে গন্ধ কোথা থেকে???
তবে কি???
নিজে খানিক চোখ বুঝে কিছু বোঝার চেষ্টা করে বিখ্যাত জ্যোতিষ বিশ্বনাথ।

“বাবা! আমরা নিরুপায়! আপনি বাঁচান আমার ৫ বছরের ছেলেকে। অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। ”
চোখ খুলে তিনি লক্ষ্য করেন সামনে বসে থাকা সেই পুরুষটি হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে তার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
বিশ্বনাথ তাদেরকে চুপ করতে বলে নিজে আবারও চোখ বন্ধ করে। ওই আঁশটে গন্ধর মানে বোঝাটা খুব দরকার। বিপদের সঙ্কেত যে ওই গন্ধের মধ্যেই রয়েছে।
না!কিছুই উদ্ধার করতে পারেন না তিনি।
সত্যি সারাজীবন তন্ত্রসাধনা করেও তন্ত্রবিদ্যার কতো কিছুই তিনি জানেন না।

 

চোখ খুলে সামনে বসে থাকা দম্পতির দিকে তাকিয়ে বিশ্বনাথ বলে ওঠেন,
“বাবা, মা! আমি অতি ক্ষুদ্র মানব! আমার ক্ষমতা আর কতটুকু? আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো। তোমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখো। মনপ্রাণ দিয়ে তাকে ডাকো। দেখবে সেই পরমপিতা তোমাদের ঠিক বিপদ মুক্ত করবেন।”
খানিক চুপ করে তিনি আবার বলে ওঠেন,
“এবার তোমরা বলোতো তোমাদের ছেলের কি হয়েছে?”
এবার মুখ খুললো পুরুষটি।



“বাবা! আমি হলাম অনীল মুখার্জি, এই আমার স্ত্রী সুতপা। আপনি হয়তো আমার বাবাকে চিনে থাকবেন, আমার বাবা ছিলেন বিখ্যাত পুরোহিত ও তন্ত্রবিশারদ স্বর্গীয় বিমল মুখার্জি।”
অবাক হয় বিশ্বনাথ। বিখ্যাত তন্ত্রসম্রাট বিমল মুখার্জির ছেলে এসেছে তার কাছে সাহায্য চাইতে?
এই বিমল মুখার্জি শুধু ভুত-প্রেত পিশাচ তন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিখ্যাত সর্পতন্ত্র বিশারদ।
মৃত্যুর আগে তিনি কতশত সাপে কাটা মৃতপ্রায়, বা মৃত রোগীকে বাঁচিয়েছেন তা গুনে শেষ করা যাবে না।
সেই বিমল মুখার্জির ছেলে এসেছে এই বিশ্বনাথ আচার্যর কাছে সাহায্য চাইতে?
ওদিকে অনিল বলে চলে,

“বাবা! ১৩ দিন আগে হঠাৎ আমার ছেলের প্রচন্ড জ্বর আসে। আমরা তৎক্ষণাৎ ডাক্তার দেখাই। তিনি বলেন ভাইরাল ফিভার। কয়েকটা ওষুধ দিয়ে বলেন এগুলো খেতে দিন ও ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা ওই ওষুধগুলো খাওয়ার পরও ছেলের জ্বর নামে না। এরপর বাড়িতে বিভিন্ন ডাক্তারের যাতায়াত প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। ছেলের শরীরে হাজারো ওষুধ পড়লেও জ্বর কমার কোন লক্ষণই দেখা যায় না। ছেলে এখন খাওয়া দাওয়া ছেড়েই দিয়েছে।
কোন কিছুই মুখে কাটে না। যদিও জোর করে কিছু খাওয়ানো হয় তখনই সেটা বমি করে বের করে দেয়। এই কদিনে ছেলেটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখন শরীরের প্রতিটি হার গোনা যায়। দেখলে মনে হয় বিছানায় একটা কঙ্কাল শুয়ে আছে।”

কথাগুলো শেষ হয় না অনিলের তার আগেই ছেলের অজানা ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কান্নায় ফেটে পড়ে সে।
কি বলে সান্তনা দেবে জ্যোতিষ বিশ্বনাথ আচার্য?
নিজে সংসার না করলেও তিনি জানেন একজন পিতার কাছে তার নিজের সন্তানকে এমন তিলে তিলে মরতে দেখা যে নরকযন্ত্রণার থেকেও বেশী কষ্টকর।
চুপ করে থাকেন তিনি। ওই দম্পতিকে একটু ধাতস্থ হতে দেওয়াটা খুব দরকার।

 

একটু ধাতস্থ হতেই এবার সুতপা শুরু করে,
“বাবা! এখন দেখছি ছেলের গোটা গায়ে ছোপ ছোপ কিসব বেরিয়েছে। অনেকটা সাপের খোলসের মতো। কালো কি বিশ্রী। দেখলে ভয় লাগে।”
ভুরু কুঁচকে যায় অভিজ্ঞ জ্যোতিষ ও তন্ত্রবিশারদ বিশ্বনাথ আচার্যর। এবার তিনি কিছুটা ঠাওর করতে পারছেন। বুঝতে পারছেন ওই আঁশটে গন্ধের কারণ। তবে কি এই মুখার্জি পরিবার সর্প অভিশাপে আক্রান্ত???



মুখার্জি দম্পতিকে বিদায় দিয়ে নিজের আলমারি থেকে কয়েকটি তন্ত্রসাধনার বই বের করেন তিনি। একটু বিশদে জানা দরকার।
ওই মুখার্জি দম্পতিকে তিনি বলেছেন,
“বাবা-মা তোমরা আজ বাড়ি যাও! আমি কাল তোমাদের বাড়িতে যাব! নিজে না দেখলে কিছুই যে বুঝতে পারছিনা!”
আসলে তিনি একটু সময় নিয়েছেন। বিষয়টি বিশদে না জেনে কিছু প্রতিকার করতে যাওয়া যে চরম বোকামির কাজ।

 

পরের দিন বিশ্বনাথ আচার্য যখন মুখার্জি বাড়িতে পৌঁছায় তখন সবেমাত্র সকাল হয়েছে। সুতপা বাইরে উঠানে ঝাঁট দিচ্ছিল। তাকে দেখে সুতপা একমাথা ঘোমটা টেনে প্রণাম করে। ভক্তিভরে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশ্বনাথ আচার্যকে ঘরে নিয়ে যায়।

 

মুখার্জি বাড়িতে ঢুকতেই সেই আঁশটে গন্ধটা আবারো নাকে লাগে বিশ্বনাথ আচার্যর। এবার গন্ধটা আরো তীব্র,আরো প্রবল।
ঘরে ঢুকে বিশ্বনাথ দেখে বিছানায় শুয়ে আছে অনিল আর সুতপার একমাত্র ছেলে। মাথার কাছে অনিল বসে। শরীরে সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি। বিছানায় শুয়ে থাকা ছেলের মাথায় সে জলপটি দিচ্ছে তখন। ছেলেটির শরীর কঙ্কালসার। চোখমুখ রোগ যন্ত্রণাক্লিষ্ট। ছেলেটার গোটা গায়ে সেই সাপের খোলসের মত ছোপছোপ দাগ তার চোখ এড়ায় না।

বাচ্চাটি যে মৃত্যুপথযাত্রী সেটা অভিজ্ঞ জ্যোতিষ ও তন্ত্রবিশারদ বিশ্বনাথ আচার্যর বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না।
তার অভিজ্ঞ চোখ বলে দেয় এই ছেলে, এই মুখার্জি পরিবার ভয়ানক অভিশাপগ্রস্ত, ভয়ানক সর্প অভিশাপ।
এখনই কিছু করা দরকার! না হলে অনিল, সুতপার সন্তানহারা হওয়াটা যে অবশ্যম্ভাবী।

 

দ্রুতপায়ে বাইরে বেরিয়ে আসে বিশ্বনাথ। বাড়ির চারিদিকটা একবার খুঁটিয়ে দেখে নেয় সে।
দেখে মুখার্জি বাড়িতে নতুন ইমারত তৈরীর ভিত কাটা শেষে রাজমিস্ত্রী ইটের গাঁথুনি দিচ্ছে। সেই ভিত কাটা মাটি, বাড়ির বেড়ার বাইরে একটা ঢিবির উপর স্তুপকৃত করা আছে।

 

বিশ্বনাথ আচার্যর মনে হল সেই আঁশটে গন্ধটা ওই ঢিবির উপর থেকেই আসছে। তবে কি ওই ঢিবির মধ্যেই রয়েছে সে? সেই ভয়ানক অভিশাপ??
ঢিবিটা একবার ভালো করে দেখে বিশ্বনাথ অনিলদের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
দেখে সুতপা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সুতপা বলে ওঠে,
“বাবা একটু লুচি করেছি। দয়া করে একটু অন্ন গ্রহণ করুন।
অবাক হয় বিশ্বনাথ। সত্যি মেয়েটা করিৎকর্মা। এটুকু সময়ের মধ্যে তার জলযোগেরও আয়োজন করে ফেলেছে।



“মা খাবার সময় আমি অনেক পাবো! তোমাদের যে ঘোর বিপদ! আগে তোমার ছেলেকে সুস্থ করি! তারপর না হয় একদিন জমিয়ে তোমার বাড়িতে অন্নভোগ গ্রহণ করব! তুমি মা আমাকে তোমার ছেলের কাছে নিয়ে চলো। তুমি আর অনিল দুজনে এসো। কিছু কথা আছে। এখনই বলা দরকার। নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”
সুতপা জ্যোতিষ বিশ্বনাথকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ছেলের ঘরে ঢোকে। অনিল তখনও তার ছেলের মাথায় জলপটি দিচ্ছিল। বিশ্বনাথকে দেখে সে জলপটি দেওয়া থামিয়ে উঠে দাড়ায়। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি এনে জিজ্ঞাসা করে,
“বাবা কিছু বুঝলেন? বুঝলেন আমার ছেলের কেন এমন অবস্থা?”
একটা চেয়ারে বসে বিশ্বনাথ অনিলের ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে ওঠেন,
“বুঝেছি! বলছি! কিন্তু তার আগে তোমার ছেলের সাথে একটু কথা বলা দরকার”
সুতপা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“বাবা! কার সাথে কথা বলবেন? আমার ছেলে যে আজ তিনদিন হল মুখে কোনও রা কাটছে না। ও যে বেঁচে আছে সেটা ওই হাপরের মত হৃদপিন্ডের ওঠানামা না দেখলে বোঝা যায় না। বাঁচান বাবা আমাদের একমাত্র ছেলেকে বাঁচান।”

 

হমম!
বিশ্বনাথের মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
খানিক চুপ থেকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন,
“আচ্ছা অনিল, এই কয়েকদিনে তুমি তোমার বাড়ির আশেপাশে কোন সাপের হিসহিস শব্দ শুনতে পেয়েছো বা কোনো বিষধর সাপকে দেখেছো?”

 

“হ্যাঁ বাবা! দেখিনি, তবে শুনেছি! এই তো প্রায় ১৪ দিন আগে! সেদিন আবার পূর্ণিমা ছিলো। ঐদিন বাড়িতে ভিত কাটা চলছিল।
ভিত কাটার মাটি ওই বেড়ার পাশের ঢিবির উপর ফেলা হচ্ছিল। সারাদিন কাজের লোক, রাজমিস্ত্রি চলে যাওয়ার পরে সন্ধ্যায় ওই ঢিবির পাশ থেকে হিসহিস শব্দ আসছিল। শব্দটা সারারাত শুনেছিলাম। বর্ষাকাল  হয়তো কোন বিষাক্ত সাপ এসেছে। ভেবেছিলাম চারিদিকে ঝোপঝাড় আর নতুন মাটি কাটার ফলে হয়তো কোন গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে । পরের দিন সকালে উঠে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। পরেরদিন থেকে আর শুনিনি।”

অনিল বলে ওঠে।
এবার বিশ্বনাথ গম্ভীর গলায় বলে ওঠেন,
“আচ্ছা অনিল! তুমি বাস্তু সাপের কথা শুনেছ?”
জ্যোতিষ বিশ্বনাথ অবাক হয়ে লক্ষ্য করে বাস্তু সাপের কথাটা শুনতেই অনিলের চোখমুখ কেমন যেন রাগে লাল হয়ে গেল। তবে সেটা ক্ষণিকের। মুহূর্তের ভগ্নাংশে সেই মুখ আবারও স্বাভাবিক।

 

“শুনেছি”
একটু রাগত কন্ঠে অনিল বলতে থাকে,
“বাবা বলতেন আমাদের বাড়িতে নাকি বাস্তুসাপ আছে। সেই সাপ নাকি আমাদের ভালোবাসেন। আমাদের আশীর্বাদ করেন। তার আশীর্বাদে ফলে নাকি আমাদের সংসারে এতো সুখ। আমি বিশ্বাস করতাম না। কলেজ পাশ করা বিজ্ঞানের ছাত্র আমি। দেখতাম সাপে কাটা রোগী নিয়ে লোকেরা হসপিটাল যাওয়ার বদলে বাবার কাছে আসতো।
ভন্ডামি দেখে আমার রাগ হতো। এই নিয়ে তো বাবার সাথে প্রায়ই অশান্তি হতো।
পরে আমার মা মারা যেতে বাবা ওই ঢিবিটার পাশে সারাদিন বসে থাকতেন। শুধু খাওয়া আর রাতে শোয়ার সময় বাড়িতে আসতেন। মাঝে মাঝে দেখতাম বাবা একটা দুধের বাটি নিয়ে ওই ঢিবিটার উপর বসে কার সাথে যেন গল্প করছেন। খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না ব্যাপারটাকে। বয়সের ভিমরতি ভেবেই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতাম।”

 

“এখন আর ব্যাপারটাকে ভন্ডামি বলে মনে হয় অনিল?”



গম্ভীর অথচ ধীর-স্থির গলায় বলে ওঠেন জ্যোতিষ বিশ্বনাথ আচার্য।
“না বাবা! এখন বিশ্বাস হয়! এখন মানি বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায় না? পৃথিবীতে আজও অনেক রহস্য রয়েছে যার সমাধান করার সাধ্য বিজ্ঞানের নেই! যদি না বিশ্বাস করতাম,আপনার কাছে কি যেতাম?”
অস্ফুট স্বরে কথাগুলো শেষ করে অনিল।
রোগাক্রান্ত নিজের ছেলের কথা ভেবে কবে  অনিলের সেই অবিশ্বাসের বেড়াজাল ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
“শোনো তবে”

বিশ্বনাথ শুরু করেন,
“তোমাদের পুত্র, এই মুখার্জি পরিবার তোমাদের বাস্তুসাপের অভিশাপগ্রস্থ। এখনই এর একটা বিহিত করা দরকার। না হলে তোমাদের পুত্রকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। কাল আমাবস্যা। বাড়িতে একটা যজ্ঞের আয়োজন করব। আমি কিছু ফর্দ দিয়ে যাচ্ছি সেগুলো বাজার থেকে নিয়ে আসবে। কিছু জিনিস আমি নিজে নিয়ে আসবো। তুমি সেগুলো পাবে না। ২ সের খাঁটি দুধ জোগাড় করে রাখবে। খাঁটি মানে একদমই খাঁটি। একফোঁটাও জল যেন মেশানো না থাকে। আর হ্যাঁ! পাড়ার কয়েকজনকে থাকতে বলে দেবে! কয়েকটা কোদালও জোগাড় করে রাখবে। যা বললাম সব কটা কথা মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে নাও। একটুও যেন ভুলচুক না হয়। সামান্য ভুলে অনর্থ হয়ে যেতে পারে কিন্ত।”

কথাগুলো বলে বিশ্বনাথ বাইরে বেরিয়ে আসেন।
পিছন পিছন অনিলও।
বাইরে বেরিয়ে অনিল খুব নিচু স্বরে বিশ্বনাথকে জিজ্ঞাসা করে,
“বাবা! যদি অঘটন ঘটেই, তাহলে আর কতদিন?”

 

“আর একদিন! মাত্র একদিন রয়েছে তোমার ছেলের পরমায়ু! সর্প অভিশাপের চূড়ান্ত ফল ফলতে ১৫ দিন সময় লাগে। গত পূর্ণিমা আর কালকের অমাবস্যা, এই হলো ১৫ দিনের কালচক্র।”
বিশ্বনাথ গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে মুখার্জি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।

 

পরেরদিন সন্ধায় মুখার্জি বাড়িতে সাজোসাজো রব। পাড়ার ছোট-বড় সবাই হাজির। ওদিকে জ্যোতিষ ও তান্ত্রিক বিশ্বনাথ আচার্য যজ্ঞে বসেছেন। সেই ঢিবিটা থেকে একটু দূরে। যজ্ঞকুণ্ড এর চারিদিকে বিশ্বনাথ কিছু মন্ত্রপূতঃ সাদা সরষে ছড়িয়ে একটি অভেদ্য বলয় সৃষ্টি করেছেন। বলয়ের  চারটি কোনে চারটি নরকরোটি রাখা। কয়েকটি শুকুন, আর কাকের কাটামুন্ডু হোমকুন্ড এর সামনে সাজিয়ে রাখা আছে। হলুদ আর লালসিঁদুর গোটা বলয়টা ভরে রয়েছে। বলয়ের মধ্যে দুটি আসনে বসে আছে অনিল আর তার স্ত্রী সুতপা। সামনে তাদের পুত্রকে শুইয়ে রাখা আছে। একটু দূরে ওই বলয়ের বাইরে কয়েকজন লোক কোদাল হাতে তান্ত্রিক বিশ্বনাথ আচার্যের আদেশ পালনের জন্য তৈরি।

প্রায় দু’ঘণ্টা বিশ্বনাথ এক দুর্বোধ্য কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন। মন্ত্রপাঠের ভাষা অজানা হলেও অনিল সুতপার বুঝতে অসুবিধা হয় না ওটা কোন এক আহ্বানী মন্ত্র। মন্ত্রপাঠের মাঝেমাঝে কিছু বেলপাতা ঘীতে ডুবিয়ে আহুতি দিচ্ছেন তান্ত্রিক বিশ্বনাথ।
এরপর কতক্ষণ এই যজ্ঞ আর মন্ত্রপাঠ চলেছিল তা কারোর খেয়াল ছিলো না।
হঠাৎ একটা ভয়ানক হিসহিস শব্দ শুনে সবাই পিছন ফেরে।



যজ্ঞের চুইয়ে পড়া আলোতে সবাই সভয়ে দেখে একটা বিশাল কালো কুচকুচে গোখরো সাপ সেই ঢিবিটার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার বিশাল  ফণা যজ্ঞের আলোতে চকচক করছে। সাপটি লম্বায় প্রায় দশ-বারো হাত হবে।

হিসহিস শব্দের সাথে এখন একটা ক্রুর গর্জন শোনা যাচ্ছে। সেই সাপের চোখে তখন প্রতিহিংসার ছাপ সুস্পষ্ট। ততক্ষনে যজ্ঞ দেখতে আসা মানুষদের মধ্যে ভয়ে আতঙ্কে হট্টগোল বেঁধে গেছে। প্রাণভয়ে তারা পালাতে গেলে বিশ্বনাথ গর্জন করে ওঠে,
“তোরা পালাস না! ওই সাপ তোদের কিছু করবে না। ওর রাগ শুধুমাত্র এই মুখার্জি বাড়ির উপর।”
কথায় কাজ হয়।
উন্মত্ত জনতা এখন পালানো থেকে নিরস্ত।

 

অনিল আর সুতপা এতক্ষণ অবাক হয়ে দেখছিল তাদের বাস্তুসাপটিকে।
“উফফ কি ভয়ানক”
নিজের মনে কথাটা বলে নিজের পুত্রের দিকে তাকায় সুতপা। আর ঠিক তখনই দুঃখে, কষ্টে হতাশায়, ভয়ে সে চিৎকার করে ওঠে,
“খোকা দম ফেলছে না কেন?বুকের সেই হৃদপিন্ডের ওঠানামাটা যে বন্ধ। হে ঈশ্বর পারলাম না ছেলেকে বাঁচাতে। পারলাম না।”
রাগে অনিল উঠে পড়ে! হাতের সামনে থাকা একটা বাঁশ নিয়ে সাপটিকে মারতে উদ্যত হতেই, বিশ্বনাথ তান্ত্রিক চিৎকার করে ওঠেন,

“এই বলয়ের বাইরে একদমই বেরোবে না!এখান থেকে বেরোলে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারবো না। ওই সাপ এখন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে। ওর কাছে যাওয়া মানেই কিন্তু সাক্ষাৎ মৃত্যুকে বুকে টেনে আনা। এই বলয়ের মধ্যে যতক্ষণ তোমরা আছো ততক্ষণ তোমরা নিরাপদ।ওই সাপের ক্ষমতা নেই এই বলয় ভেদ করে ভেতরে আসার। একটু সময় দাও আমার উপর বিশ্বাস রাখো, কথা দিচ্ছি তোমাদের পুত্র সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।”



এরপর আরও কিছু মন্ত্রপাঠ করে তান্ত্রিক বিশ্বনাথ উঠে পড়েন। সবাইকে অবাক করে তিনি এগিয়ে যান সেই ভয়ানক বাস্তুসাপ গোখরোটির দিকে।
অবাক হয়ে সমস্ত মানুষ দেখে সেই সাপটি এখন চুপ। সেই হিসহিস্ শব্দ আর নেই। নেই ক্রুরতার কোনো ছাপ। যেন সে বাধ্য। ওই বিশ্বনাথ তান্ত্রিকের আজ্ঞাবাহী।
সাপটির কাছে গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন বিশ্বনাথ।
তারপর বলতে থাকেন,
“হে নাগ দেবী! এই অনিল, আর তার স্ত্রী এখনও যে অবুঝ। ওদের মনের শিশুত্ব এখনও ঘোচেনি যে। মা তুমি ওদের ক্ষমা করে দাও। তোমার সন্তানদের ওরা মারতে চায় নি। ওরা জানত না তুমি আর তোমার সন্তানরা ওই ঢিবির মধ্যে থাকো। জানলে কোনদিনই ওরা ওই ঢিবিটা মাটি চাপা দিতো না।

তাছাড়া ওদের বাবা বিমল মুখার্জি তোমার খুব কাছের ছিল। তোমার সুখ দুঃখের সঙ্গী ছিল। জানি সন্তানশোক বড়ই কঠিন, বড়ই নির্মম। সে মানুষ হোক বা সাপ! মা ফিরিয়ে নাও তোমার ওই ভয়ানক অভিশাপ। বাঁচতে দাও মা! তোমার বন্ধুর নাতিকে। মহাকাল তোমার মঙ্গল করবেন।”
কথাগুলো বলে চুপ করেন বিশ্বনাথ, দেখেন গোখরোর সেই উদ্ধত ফণা এখন মাটিতে নেমে গেছে। ইঙ্গিতটা বোঝেন বিশ্বনাথ।
চিৎকার করে ওঠেন তিনি
“মা…..

তুমি জগৎ জননী! তুমি মহান! ও অনিল ও সুতপা তোমরা ছুটে এসো। ক্ষমা চেয়ে নাও। মা তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছে। এবার তোমাদের ছেলে সেরে যাবে। সুস্থ হয়ে যাবে। আসলে মা যে রেগে ছিলেন,
সেদিন যখন তোমরা ওই ঢিবিটা মাটি ঢাকা দাও তখন তোমাদের বাস্তুসাপ এই “মা” তার বাচ্চাদের জন্য খাবার আনতে বাইরে বেরিয়েছিল। সন্ধ্যায় যখন ফিরেছিল তখন দেখে তার বাসস্থান এই ঢিবিটা মাটিচাপা। ওর বাচ্চারা অভুক্ত অবস্থায় মাটির তলায় বন্দী। তাইতো ওই দিন রাত্রে এই মায়ের হিসহিস গর্জন শুনেছিলে। ওটা আসলে গর্জন ছিলনা! ওটা ছিল এক অসহায় মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ।সেদিন তোমাদের বাস্তুসাপ মুখার্জি বাড়িকে অভিশাপ দিয়ে এখান থেকে বিদায় নিয়েছিল। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল নিজের সন্তান হারানোর শোক। যার ফল ভুগছে তোমাদের ৫ বছরের নিষ্পাপ সন্তান।

ক্ষমা চাও অনিল, ক্ষমা চাও সুতপা। ক্ষমা চাও।

মা আবারও সব ঠিক করে দেবে।”



অনিল সুতপা কাঁদতে কাঁদতে সেই গোখরোর সামনে করজোড়ে নতজানু হয়ে বসে পড়ে। ক্ষমা প্রত্যাশায় কাকুতি-মিনতি করতে থাকে….

 

ওদিকে ততক্ষণে বিশ্বনাথ আচার্যর নির্দেশে কয়েকজন কোদাল দিয়ে সেই ঢিবির উপর মাটি সরাতে শুরু করেছে। বেশ খানিকটা মাটি সরানোর পর সবাই লক্ষ্য করে একটা বিশাল গর্ত। একটু উঁকি মারতেই কয়েকটা ছোট গোখরোর বাচ্চা চোখে পড়ে। সংখ্যায় পনেরো-কুড়িটা হবে। তবে ততক্ষনে তারা নির্জীব। না খেতে পেয়ে মৃতপ্রায়। প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে।
বিশ্বনাথ অনিলকে নির্দেশ দেয়,

“অনিল! ওই সরায় রাখা ২ সের দুধ এখনই গর্তের মুখে রেখে এসো। জলদি করো। সময় খুব কম।”
ছুটে যায় অনিল। দুধের পাত্রটি সেই গর্তের সামনে রেখে আসে। সবাই অবাক চোখে দেখে সেই নির্জীব অভুক্ত গোখরোর বাচ্চাগুলো এখন সরা থেকে দুধ পান করছে। একটু একটু করে নড়ছে। ঘুরছে। একটু একটু করে ফিরে আসছে তাদের জীবনীশক্তি।
যখন দুধ প্রায় শেষ ঠিক তখনই সেই বড় বাস্তুসাপ গোখরোটি এক ছুটে সেই গর্তের মধ্যে গিয়ে ঢোকে।
কোন এক মায়াবী জাদুর স্পর্শে সেই মৃতপ্রায় গোখরো বাচ্চাগুলো আবারো খিলখিলিয়ে নিজের মায়ের সাথে খেলতে শুরু করে। হয়তো এটাকেই বলে মাতৃস্পর্শ।

 

“মা আমাকে খেতে দেবে না। খুব খিদে পেয়েছে যে।”

অবাক হয়ে সবাই হোমকুণ্ডের দিকে ফিরে দেখে অনিল সুতপার ৫ বছরের ছেলে এখন উঠে দাঁড়িয়েছে। মা সুতপার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তার গায়ের সেই ছোপছোপ কালো সাপের খোলসের মতো দাগ এখন আর নেই…….



এতক্ষনে সেই বিশ্রী আঁশটে গন্ধটা ধীরেধীরে বিলীন হতে শুরু করেছে।
বিজয়ের আনন্দে চোখে জল চলে আসে বিখ্যাত জ্যোতিষ ও তান্ত্রিক বিশ্বনাথ আচার্যর।
সে পেরেছে যে……

 

[গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোন মিল নেই। দয়া করে গল্পটিকে বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করতে যাবেন না প্লিজ। আর হ্যাঁ! সাপ কিন্তু দুধ খায় না! এটা প্রমাণিত]


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply