রোহিঙ্গা সংকট: আমাদের পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন।
লেখাটি শেয়ার করুন
মোজাম্মেল হোছাইন।।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে ১৬ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। গেল ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করেছে। এই ৫০ বছরে দেশটির অনেক অগ্রগতি ও অর্জন রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান, খাদ্যাভ্যাস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মাথাপিছু আয়, শিক্ষার অগ্রগতি, আইনের স্বচ্ছতা, নাগরিক অধিকার সহ অন্যান্য সকল বিষয়ে লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী ট্যানেল ইত্যাদি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়ার মাধ্যমে এবং প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব অঙ্গনে তার সক্ষমতা ও অগ্রগতির জানান দেবে। নিজেকে উন্নত দেশগুলোর কাতারে নিয়ে দাঁড় করাবে। এগুলো বাংলাদেশের অর্জন। এই অর্জন গৌরবের এবং আনন্দের।
এ সকল উপাদানের অগ্রগতি একটি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু যে উপাদানটি একটি দেশের অগ্রগতিকে পেছনের দিকে টেনে ধরে তা হলো অতিরিক্ত জনসংখ্যা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০ কোটি। এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত শরণার্থী। যারা মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মিয়ানমার নামক দেশটি অবস্থিত। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত মাত্র ২৮০ কিলোমিটার। তবুও প্রতিবেশী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে শুধুমাত্র রোহিঙ্গা সমস্যা ছাড়া। এই রোহিঙ্গা সমস্যার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে।
মিয়ানমারে প্রায় ১৩৬ টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তারমধ্যে ১৩৫ জাতিগোষ্ঠী সরকারিভাবে স্বীকৃত। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার সরকার স্বীকৃতি দেয় নি। কেননা তারা জাতিতে মুসলমান। এ থেকে বোঝা যায় মিয়ানমারের দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি সাম্প্রদায়িক সমস্যা। তবে বর্তমানে এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নয় বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা-পূর্ব মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বৃটেনের পক্ষে ছিল। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার নেমে আসে।
১৯৭৭ সালে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার দেশে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে বার্মাইন বৌদ্ধ ও বার্মার সেনাবাহিনী একত্রে রোহিঙ্গাদের উপর অন্যায় ভাবে নির্যাতন শুরু করে এবং তাদেরকে “সন্ত্রাসবাদি জনগোষ্ঠী” বলে আখ্যায়িত করে।
১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপারেশন “নাগামিন ড্রাগন” পরিচালিত হয়। এর ফলে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।
১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় “Operation Peezzay”। ফলে এ সময় প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
২০১২ সালে মিয়ানমারের উপনির্বাচনে অংসান সুচীর নেতৃত্বাধীন এনএলডি পার্টি ৪৫ টি আসনের মধ্যে ৪৩ টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সুচীর ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গা নিধনের লক্ষ্যে “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” পরিচালিত হয়। প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এর মাধ্যমে দেখা যায় যে, ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (UNHCR) এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা (HRW) এসময় বাংলাদেশকে আহ্বান জানায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে। তাদের আহবানে বাংলাদেশ সাড়া দেয়।
২০১৬ সাল পরবর্তী সময় থেকে রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক অত্যাচার ও নির্যাতন নেমে আসে।
‘২০১৭ সালের ২৫ শে আগস্ট “নিধন কার্যক্রম” শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা ২৪ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল। ১৮ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারী ও মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। ১ লক্ষ ১৬ হাজার রোহিঙ্গাকে মারধর করা হয়েছিল। ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিককে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।’ (তথ্যঃ উইকিপিডিয়া)
এরূপ দমন-পীড়ন সহ্য করতে না পেরে রোহিঙ্গারা আবারও বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আসতে শুরু করে। ফলে ২০১৮ সাল নাগাদ প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।(তথ্যঃ বাসস)
এই বিপুল পরিমান রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশের কক্সবাজার ও ভাসানচরে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অবস্থানের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার বিস্তার ঘটছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে অপকর্মে জড়িয়ে তারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। উপকূলীয় অঞ্চলের বনভূমি উজাড় করার ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয়দের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। সামাজিক ন্যায় বিচার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সর্বোপরি এই বিপুল পরিমান রোহিঙ্গা নাগরিকদের কর্মের যোগান দিতে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে। কিন্তু রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে যেতে রাজি না হওয়ায় কাউকেই প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হয়নি। এরপর থেকে দফায় দফায় মিয়ানমার সরকারের সাথে আলোচনা করেও কোন আশানুরূপ ফলাফল আসেনি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বরাবরই আন্তর্জাতিক সমর্থনের ও হস্তক্ষেপে উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪ তম অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রলম্বিত রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬ তম অধিবেশনে গত ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এর ষষ্ঠ দফায় রোহিঙ্গা সংকটের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে তারা নিরাপদ। টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এই সংকটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে।। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।”(তথ্যঃ VOABANGLA)
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থনের বিষয়ে আশাবাদী। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রয়োজন। প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমর্থন। বৃহৎ শক্তিগুলোর কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গারা আবারো তাদের স্বভূমিতে ফিরে যেতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশে যে মানবতার পরিচয় দিয়েছে তা তখনই সার্থক হবে যখন রোহিঙ্গারা বিনাশর্তে তাদের স্বভূমিতে ফিরে যেতে পারবে।
লেখাটি শেয়ার করুন