শেখ ফরিদ-উদ্-দ্বীন আত্তার

সূফী শেখ ফরিদ-উদ্-দ্বীন আত্তারের দেশকালোত্তীর্ণ সাহিত্য সুধা

জীবনী, প্রবন্ধ
লেখাটি শেয়ার করুন

মো: ফেরদৌস আলম
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

প্রখ্যাত সূফী শেখ ফরিদ-উদ্-দ্বীন আত্তার সূফী সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা। ফার্সি সাহিত্যের স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রাণপুরুষ তিনি। আজও বিশ্বব্যাপী জ্ঞানপিপাসু রহস্যানুসন্ধ্যানী চিন্তাশীলদের নিকট বরণীয় এ মহাপুরুষ।

আত্তারের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ নিয়ে অনেক মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। প্রায় হাজার বছর আগে জন্ম নেয়া এ মহাপুরুষ জীবনকালে হয়তো সেই অর্থে জনপ্রিয়তা লাভ করেননি। উল্লেখযোগ্য মতে তিনি ১০০ বছর বেঁচে ছিলেন (১১৪৫-১২৪৬ খ্রিস্টাব্দ)। তার জীবন সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে খুব অল্পই জানা যায়। তার পূর্ণ নাম ফরিদ-উদ্-দ্বীন আবু হামিদ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহীম বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি ‘আত্তার’ নামেই বেশি পরিচিত যার অর্থ ‘সুগন্ধিওয়ালা’।

নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, একদিন আত্তার তার দোকানের দরজায় এক বন্ধুর সাথে বসেছিলেন। এমন সময় একজন দরবেশ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দোকানের ভিতরে দেখলেন এবং সুঘ্রাণ অনুভব করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান্না জুড়ে দিলেন। সে হয়তো করুণা জাগাতে চেষ্টা করছে এই ভেবে আত্তার তাকে চলে যেতে বললেন। দরবেশ বললেন, অবশ্যই, তোমার দরজা থেকে ফিরে যেতে এবং এই পৃথিবীকে বিদায় বলতে আমার কোনো বাধা নেই। আমার শুধু আছে ছিঁড়ে যাওয়া পরিধানের খিড়কা। কিন্তু আমি তোমার জন্য দুঃখিত, আত্তার! তুমি কীভাবে এতো নশ্বর সম্পদ ছেড়ে তোমার মনকে মৃত্যুমুখী করবে? জবাবে আত্তার দরিদ্র দরবেশের পরিতুষ্ট জীবন বেছে নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। ‘আমাদের দেখা হবে’ বলে দরবেশ তখনই ইন্তেকাল করনে। এর প্রভাবে আত্তার তার পিতার ওষুধের দোকান ত্যাগ করে একজন বিখ্যাত আলেমের ছাত্রত্ব গ্রহণ করেন এবং সূফী মতাদর্শে দীক্ষা নেন।



আত্তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: মানতিকুত তয়ির, তাযকিরাতুল আউলিয়া, ইলাহি নামা, মুক্তার নামা, দিওয়ান-ই আত্তার ইত্যাদি। বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে আত্তারের এসব অমূল্য গ্রন্থ। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থের নাম মানতিকুত তয়ির যা ‘The Conference of the Birds’ নামে ইংরেজিতে অনুদিত ও সমাদৃত হয়েছে। তার একমাত্র গদ্যগ্রন্থ তাযকিরাতুল আউলিয়া যার উল্লেখযোগ্য বাংলা অনুবাদ করেন গিরীশচন্দ্র সেন। ‘তাপসমালা’ নামে মূল ফার্সি থেকে এ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেন গিরীশচন্দ্র যিনি আরবি থেকে পবিত্র কোরআনের প্রথম সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ করে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন হিসেবে পরিচিতি পান মুসলমান সমাজে। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত গিরীশচন্দ্র তার গুরু কেশবচন্দ্র সেনের নির্দেশনায় এসব অনুবাদ করেন বলে সুবিদিত আছে।

‘তাপসমালা’ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বাংলা গদ্যের বিকাশ পর্বে রচিত বাহুল্যবর্জিত অমূল্য এক গ্রন্থ হিসেবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। নিষ্ঠার সাথে মূল গ্রন্থের অবয়বে ২৬ জন তাপস বা আউলিয়ার জীবনী সন্নিবিষ্ট হয়েছে এতে। দুঃখের বিষয়, বাজারে শেখ ফরিদ-উদ্-দ্বীন আত্তারের তাজকেরাতুল আউলিয়া নামে কিছু অনুদিত গ্রন্থ সংকলন ও সংযোজনে মূল গ্রন্থের কলেবর অস্বাভাবিক ভাবে ছাড়িয়ে গেছে। যাহোক, তাপসমালা থেকে আবিস্ করণী (ওয়েছ করনী)’র উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য। ”যদি তুমি বিশ্বাসশূন্য হইয়া স্বর্গস্থ ও পৃথিবীস্থ সাধক লোকের উপাসনা-প্রণালীর অনুরূপ উপাসনা কর, ঈশ্বর তাহা গ্রাহ্য করিবেন না।”

আত্তারের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থ মানতিকুত তয়ির (The Conference of the Birds) রহস্যপূর্ণ অভিনব এক সাহিত্য সম্পদ। পাখিদের পরামর্শ সভার রূপক গল্পে আত্মার অনন্তে যাত্রাপথ এঁকেছেন আত্তার। আধ্যাত্মিক উপদেশ গাঁথায় পাখিরা পরামর্শ করে কীভাবে পাখিদের রাজার (রূপকথার পাখি) কাছে পৌঁছানো যায়। ঝুঁটিওয়ালা হুদহুদ এ সভায় সভাপতিত্ব করে। বিভিন্ন পাখি এ যাত্রায় তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে। অভিজ্ঞ হুদহুদ তাদের উদ্বেগ দূর করতে যাত্রাপথের নকশা বলে যায়। সাতটি উপত্যাকা পেরিয়ে সে যাত্রায় কী বিপদে কী উপায়ে উদ্ধার পাওয়া যাবে তা বর্ণনা করে হুদহুদ। সাতটি উপত্যাকা হলো যথাক্রমে: অনুসন্ধিৎসা, ভালোবাসা, অনুধাবন, স্বাধীনতা ও অনাসক্তি, একতা, বিস্ময় ও বিভ্রান্তি, এবং বঞ্চনা ও মৃত্যু। আত্তারের মানতিকুত তয়ির আধ্যাত্মিক জগতের অমূল্য সম্পদ। গল্পে গল্পে অনন্তে যাত্রার বিভিন্ন উপত্যাকা আমাদের আত্মা ও এর গন্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হোসেন মনসুরের পরিণতির আভাস পাওয়া যায় এতে ”মহাত্মায় লয় পেয়ে অমরত্ব লাভ।”



পরবর্তী সূফী কবিগণ আত্তারের পথ অনুসরণ করেছেন। বিশেষ করে, মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি তার কবিতায় আত্তারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জনশ্রুতি আছে, শেখ ফরিদ-উদ-দ্বীন আত্তার উত্তর-পশ্চিম পারস্যের নিশাপুরের নিকট মোঙ্গলদের হাতে নিহত হন। এতদসংক্রান্ত ঘটনা এরকম, মোঙ্গলদের নিকট বন্দী হওয়ার পর রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কেউ একজন একশত স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে আত্তারকে ক্রয় করতে চান। কিন্তু আত্তার ওই দামে নিজেকে বিক্রি না করতে পরামর্শ দেন। মোঙ্গলরা তার কথা মেনে নিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলে অন্য একজন এসে একটি খড়ের ঝুলির বিনিময়ে তাকে কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এবার আত্তার নিজেকে বিক্রি করতে পরামর্শ দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে মোঙ্গলরা তাকে হত্যা করে। মোঙ্গলরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে কিন্তু শেখ ফরিদ-উদ্-দ্বীন আত্তারের মহিমা আজও অমলিন। যুগ যুগ ধরে তিনি মানুষের হৃদয় আকাশে পাখিদের (আত্মা) পরামর্শ সভায় পথ দেখিয়ে চলেছেন যা অনন্তের পথে আমাদের আলোকিত করে।



লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply