একটি লেখকসত্তা একটি দেশ বা পৃথিবীর মতোই মহান: রাকিব
দূর্বাঘাস আয়োজিত সাক্ষাৎকারের ৩য় পর্বে আমাদের অতিথি ছিলেন কবি ও লেখক রাকিব হাসান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দূর্বাঘাসের সহ-সম্পাদক লিজা। প্রিয় পাঠক, তাহলে আর দেরি কেন? চলুন পড়ে নিই।
“প্রিয় লেখক। দূর্বাঘাস কর্তৃক আয়োজিত আড্ডায় আপনাকে স্বাগতম। আমি লিজা, দূর্বাঘাসে সহ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। দূর্বাঘাস সবসময়ই অনলাইন ভিত্তিক সাহিত্যচর্চাকে সহজ করে তোলার জন্য যা যা সমর্থন অথবা সহায়তা প্রদান করা সম্ভব তা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে আমাদের আজকের এই আড্ডার আয়োজন, আমরা চাই আড্ডার ছলে আপনার চিন্তা-আদর্শ-দর্শন এসবের সাথে একটু পরিচিত হতে। তো চলুন, সময় নষ্ট না করে শুরু করা যাক।
প্রশ্ন: প্রথমেই আপনি কেমন আছেন জানতে চাইবো।
উত্তর: জি ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
প্রশ্ন: আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা কোথায় এবং কিভাবে এ সম্পর্কে আমাদের পাঠকদেরকে যদি জানাতেন।
উত্তর: আমার জন্ম জামালপুর জেলায় । ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। জীবনের প্রথম অধ্যায়টা সেখানেই কেটেছে। আমার গোটা শৈশব, কৈশোরের প্রারম্ভকাল ব্রহ্মপুত্রের জলবাতাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে পার করেছি। সে এক অবিস্মৃত অনুভূতি। তারপর সময়ের প্রয়োজনে ঢাকায় আসা। এখন পর্যন্ত এই অদ্ভুত শহরেই কেটে যাচ্ছে দিন।
প্রশ্ন: এই যে লেখালেখি করছেন, এই লেখালেখির জগতে আসা হলো কিভাবে? ঠিক কোন বিষয়টি আপনার লেখক সত্ত্বা আবিষ্কারে প্রভাব ফেলেছে?
উত্তর: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কিছুটা মুশকিল। এককভাবে নির্দিষ্ট কোন বিষয় থেকে লেখক সত্তা আবিষ্কৃত হয় না। একটি লেখকসত্তা একটি দেশ বা পৃথিবীর মতোই মহান। তার চিন্তার জগত অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়ে থাকে। যা একক কোন বিষয় থেকে উদ্ভুত না। মূলত একজন লেখক বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে জীবনের প্রতিটি পদে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেইসব অভিজ্ঞতা তার ভেতরে সৃষ্টিশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। যেখান থেকে লেখক সত্তার জন্ম হয়।
আমার ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে বলা যায়। আমি প্রকৃতি ও মানুষ দেখতে পছন্দ করি। মানুষের জীবন আমাকে অসম্ভব আকর্ষিত করে। এছাড়া অল্প বয়স থেকেই বই পড়ার অভ্যাস ছিল। যা চিন্তার প্রকাশ সহজ ও সাবলীল করেছে।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম বইটি সম্পর্কে আমাদের পাঠকদেরকে জানাতেন যদি?
উত্তর: সন্ধ্যাপুরাণ আমার প্রথম উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয় ভাষাচিত্র থেকে ২০২০ সালের বইমেলায়। বইটি লেখা হয়েছে একুশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। এসময় দেশে বেশ কিছু আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে। যেগুলো শহুরে জীবনের পাশাপাশি গ্রাম্য জীবনেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
সন্ধ্যাপুরাণে সেইসব পরিবর্তন ও গ্রামীণ জীবনে এর গভীর রেখাপাত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই উপন্যাসে মূলত একজন অসহায় নারী ও তার দরিদ্র সংসারের গল্প বলা হয়েছে। তিন সন্তান ও নিজের দুবেলা আহার জোটাতে যাকে কঠিন জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়।
প্রশ্ন: আচ্ছা, লিখতে যেয়ে কখনও মজার কোনো ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন কি?
উত্তর: লিখতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই আমার সাথে বেশ অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। একবারের কথা মনে পড়ে। বাইরে তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। চারিদিকে দমকা হাওয়া, মেঘের শব্দ। আমি তখন উপন্যাস লিখছিলাম। কী একটা কারনে হঠাৎ ড্রইংরুমে আসি। দেখি, টিভিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। আমার খটকা লাগল। এখন তো মিরপুরে প্রচণ্ড ঢল হচ্ছে। খেলা হচ্ছে কি করে! কৌতূহল বশত বারান্দায় গেলাম। দেখতে পেলাম, বাইরে প্রচন্ড কুয়াশা। বৃষ্টি বা ঝড়োহাওয়ার অস্তিত্ব নেই। হবেই বা কেন! সময়টা যে ডিসেম্বর মাস। তখন ঘোর কাটল। আমি আসলে উপন্যাসে বৃষ্টির বিবরণ লিখছিলাম। আর এতটাই মগ্ন ছিলাম, প্রচন্ড কুয়াশাতেও মনে হয়েছিল, বাইরে ভীষণ মেঘ হচ্ছে!
প্রশ্ন: বাহ্!! পাঠকরা সামনে নতুন কোনো বই পাচ্ছে কি?
উত্তর: অবশ্যই নতুন বই আসবে। আপাতত ব্যক্তি ও কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। আশা করি, শীঘ্রই পাঠকদের নতুন কিছু উপহার দিব।
প্রশ্ন: লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দেয়?
উত্তর: মানুষ ও মানুষের জীবন। এই দুটি বিষয় আমাকে টানে খুব। প্রতিটি মানুষের জীবনে বৈচিত্র্য থাকে। অসংখ্য ঘটনা ও গল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন বাহিত হয়। এইসব বহুমুখী জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতার মহাকর্ষে আমি বুঁদ হয়ে থাকি।
প্রশ্ন: আপনার প্রিয় লেখক কে কিংবা কার লেখা ভালো লাগে?
উত্তর: বলতে গেলে যাদের সাহিত্য আমাকে আনন্দ দেয়, তারা সবাই আমার প্রিয় লেখক। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য মিলিয়ে এই তালিকাটা বেশ বড়সড়। তবু বেছে বেছে যদি বলতে হয়, বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও আহমদ ছফা, বিশ্বসাহিত্যে ফ্রাঞ্জ কাফকা, আলবেয়ার কামু, গার্সিয়া মার্কেজ, দস্তয়ভস্কি ও ইউভাল হারারির লেখা আমার অসম্ভব ভাল লাগে।
প্রশ্ন: পাঁচ বছর পর নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
উত্তর: আমি কখনোই একক কোন স্বপ্ন বা পরিকল্পনা নিয়ে ভবিষ্যতের মুখোমুখি হওয়ার পক্ষে না। কারন আরবিতে একটি প্রবাদ আছে। যার সোজা বাংলা হচ্ছে, “মানুষ যা চায় তার সবকিছু পায় না, বাতাস সর্বদা নৌকার অনুকূলে বাহিত হয় না। ফলে পাঁচ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখব, এই কথা বলা মুশকিল।
প্রশ্ন: আচ্ছা,যারা আপনার মতো লেখক হতে চায়, তাদেরকে কিভাবে প্রস্তুত করতে হবে নিজেদেরকে?
উত্তর: প্রচুর পড়তে হবে। তার চেয়েও বেশি পৃথিবী, জীবন ও পরিবেশ দেখতে হবে, ভাবতে হবে। একজন মানুষ তার চিন্তার সমান মহান। নিজের চিন্তা ও ভাবনাকে যত বেশি বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্য দিতে পারবে, তার সৃজনশীলতা ততোটাই সমৃদ্ধ হবে।
প্রশ্ন: মনুষ্যত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্য কতটুকু ভূমিকা পালন করে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: মহৎ শিল্প ও সাহিত্য মানুষের ভেতর মানবতাবোধ জাগ্রত করে। চিন্তা ও চৈতন্যে উদারতা, সহনশীলতা, নৈতিকতা এবং এক ধরণের মানবিক দায়িত্ববোধ তৈরি করে। যে সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করলে একজন মানুষ অন্য মানুষের উপকার ব্যতীত ক্ষতি করার কথা ভাবে না। কারো স্বাধীনতা ও শান্তি বিনষ্ট করে না। ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কুর একটি উক্তি আছে, “তুমি যা বলছ, তা হয়তো আমার পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু আমি জীবন দিয়ে হলেও তোমার সেই বলার স্বাধীনতা রক্ষা করব!” এই উদারনৈতিক মনোভাব জাগ্রত করার পেছনে শিল্প ও সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। ইতালির রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মানবতাবাদ।
তবে এটাও সত্য, শুধুমাত্র শিল্প ও সাহিত্য দিয়ে মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এমন অনেক মহান সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন, ব্যক্তিজীবনে যারা হয়তো মহৎ ছিলেন না। আবার অনেক সাধারণ মানুষ ছিলেন, যাদের মনুষ্যত্ব আকাশের উচ্চতাকে ছাপিয়ে গেছে। কাজেই লব্ধ জ্ঞান ও উদারতাকে শুধু চিন্তার মাঝে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। বাস্তব জীবনে সেগুলোর যথাযথ প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
প্রশ্ন: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনি নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেন নাকি পাঠক চাহিদাকে?
উত্তর: সবসময় নিজের ইচ্ছা ও স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেই। যা লিখে ভাল লাগে, আনন্দ পাই, তাই লিখি।
প্রশ্ন: আচ্ছা, বই প্রকাশ করতে যেয়ে আপনাকে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে কি?
উত্তর: প্রথম বই প্রকাশ করতে গিয়ে প্রায় সব লেখককেই কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। আমারও হয়েছে কম বেশি। তবে এক্ষেত্রে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বন্ধু এবং ভাষাচিত্রের প্রকাশক সোহেল ভাইয়ের সহযোগিতার ফলে সন্ধ্যাপুরাণ প্রকাশ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
প্রশ্ন: আমরা আড্ডার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি।শেষ করার আগে আমরা আপনার মুখ থেকে দূর্বাঘাস এবং দূর্বাঘাসের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দু-একটা কথা শুনতে চাইবো
উত্তর: অনলাইন ভিত্তিক সাহিত্যচর্চাকে সমৃদ্ধ করার জন্য দূর্বাঘাসের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। দূর্বাঘাসের জন্য সবসময় শুভকামনা থাকবে। এটি যেন পাঠকের অন্তরে বাংলার খাঁটি দূর্বাঘাসের মতই স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। বনলতা সেন কবিতায় জীবনানন্দ দাশের সেই দিশেহারা নাবিকের “সবুজ ঘাসের দেশ” হয়ে ওঠে।
লিজা: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে,আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমাদেরকে কিছুটা সময় ধার দেওয়ার জন্য।ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আবার হয়তো দেখা হবে অন্য কোনো আড্ডায়..ততদিন পর্যন্ত বিদায়।
রাকিব: আপনাকেও ধন্যবাদ। এমন সুন্দর উদ্যোগে আমাকে আহবান করার জন্য।
One thought on “একটি লেখকসত্তা একটি দেশ বা পৃথিবীর মতোই মহান: রাকিব”