আহনাফ তাহমিদ

মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য চাই সাহিত্যলব্ধ জ্ঞানের চর্চা: আহনাফ

সাক্ষাৎকার
লেখাটি শেয়ার করুন

দূর্বাঘাস আয়োজিত সাক্ষাৎকারের ২য় পর্বে আমাদের অতিথি ছিলেন অনুবাদক আহনাফ তাহমিদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দূর্বাঘাসের সহ-সম্পাদক লিজা। প্রিয় পাঠক, তাহলে আর দেরি কেন? চলুন পড়ে নিই।

 

প্রশ্ন: প্রথমেই সেই একই গৎবাঁধা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করছি, কেমন আছেন?
উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

প্রশ্ন: আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা কোথায় এবং কিভাবে এ সম্পর্কে আমাদের পাঠকদেরকে যদি জানাতেন।
উত্তর: আমার জন্ম ঢাকাতেই, বেড়ে ওঠাও এখানে। মায়ের দিকের পরিবারে আমিই সবার বড়। তাই আদর কিংবা যত্নআত্তির কোনো কমতি কখনও হয়নি। আদরের নাতি কিংবা ভাগনে হিসেবে নানা-নানীর, মামা-খালাদের আদর পুরোটাই আদায় করে নিয়েছি। প্রয়োজনবোধে শাসনও করেছেন তারা। আজকের আমার “আমি” হয়ে ওঠার পেছনে নানাবাড়ির মানুষগুলোর অবদান অনেক।

প্রশ্ন: এই যে অনুবাদ করছেন, এই অনুবাদের জগতে আসা কিভাবে? ঠিক কী কী বিষয় আপনার অনুবাদক সত্ত্বাকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করেছে কিংবা বলা যায় প্রভাব ফেলেছে?
উত্তর: অনুবাদের জগতে আসা বলতে পারেন একদম হুট করেই। আমি পড়াশোনা করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বিভাগের সৃজনশীল কাজের সাথে জড়িত থাকার কারণে লেখালেখির প্রতি আগ্রহ আসে। তাছাড়া বিভিন্ন খবর সম্পর্কে ধারণা রাখা, কীভাবে লিখতে হয় সেগুলো নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে একটা সময় মনে হলো আমার নিজেরও বলার মতো অনেক গল্প আছে, যা পাঠককে শোনাতে চাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টুকটাক লেখা শুরু করলাম, ফিচার অনুবাদ করতে শুরু করলাম। বন্ধুতালিকার অনেকে খুব প্রশংসা করতো, প্রেরণা পেতাম। তখন মনে হলো লেখালেখি বিষয়টাকে বোধহয় এবার সিরিয়াসলিই আমার নেয়া উচিত। খোঁজ করতে শুরু করলাম বিভিন্ন গল্প লেখাভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম। যুক্ত হয়ে গল্প লিখতে শুরু করলাম, ছোট গল্প অনুবাদ করতে থাকলাম। এরপর রোদেলা প্রকাশনীতে আয়োজিত “শুধুই গল্প” প্রতিযোগিতায় আমার একটা গল্প নির্বাচিত হয়। বইমেলায় প্রকাশিত হবার পর যে আনন্দটা হয়েছিল, তা একদমই ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এরপর একদিন আদী প্রকাশনীর কর্ণধার সাজিদ রহমান ভাই জানালেন তিনি আমার সাথে অনুবাদকর্মে আগ্রহী। শুরু করলাম আগাথা ক্রিস্টির একটা রহস্য গল্প অনুবাদের কাজ। সেখান থেকেই মূলত শুরু বলতে পারেন।

প্রশ্ন: আপনার প্রথম অনুবাদ গ্রন্থটি সম্পর্কে আমাদের পাঠকদেরকে একটু জানাতেন যদি।
উত্তর: আমার প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ আগাথা ক্রিস্টির জনপ্রিয় একটি রহস্যোপন্যাস, নাম “এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেম্বার”। পাঠকেরা হয়ত আগাথা ক্রিস্টির চরিত্র দুঁদে গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো সম্পর্কে অবগত আছেন। বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন পোয়ারো। সাহিত্যিকদের নিয়ে আয়োজিত ভোজসভায় জনপ্রিয় এক ঔপন্যাসিকা কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সামনে পড়েন। সাহায্যের জন্য তাকে দ্বারস্থ হতে হয় পোয়ারোর। একের পর এক ছিন্ন সুতো জোড়া লাগিয়ে গোয়েন্দা সে রহস্যের সমাধান করেন। বইটির নামকরণের পেছনে হাতিদের চমৎকার একটি স্বভাবের কথা লেখা আছে। বলতে পারেন, মূল গল্পে হাতিদের এই স্বভাবটিই গোয়েন্দাকে রহস্য সমাধান করতে অনেকাংশে সাহায্য করে।



প্রশ্ন: আচ্ছা, লিখতে যেয়ে মজার কেনো ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন কিংবা এমন কোনো প্রেক্ষাপট থাকলে তা যদি পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চান?
উত্তর: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা গ্রুপে পোস্ট করা গল্প একবার একজন সুন্দর করে চুরি করলেন। এরপর আমার এক জুনিয়র বিষয়টি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। আমি চোর মহাশয়কে নক দেবার পর তিনি একদম আমূল বদলে যান। দাবি করতে থাকেন এটা নাকি তারই গল্প, আমিই তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে প্রকাশ করেছি। এরপর খুব রাগ হলেও পরে হেসে ফেলি। কারণ ওই গল্পটার কমেন্টবক্সে তার প্রেয়সী খুব প্রশংসা করেছিলেন। মনে হলো, থাক, একটা গল্পই তো। এতে যদি দুজনার মধ্যে সম্পর্ক একটু ভালো থাকে, আমার তো ক্ষতি নেই। বাকবিতণ্ডায় আর জড়াইনি। জানি না এখন তারা একসাথে আছেন কিনা বা উনি আগের মতোই অন্যের গল্প চুরি করে যাচ্ছেন কিনা।

প্রশ্ন: ঘটনাটা মজার, তবে দুঃখজনকও। আচ্ছা, পাঠকরা সামনে কোনো অনুবাদ গ্রন্থ পাচ্ছে কি?
উত্তর: গত মাসেই নয়া উদ্যোগ প্রকাশনী আমার অনুবাদে “হু ইজ মড ডিক্সন” বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আলেকজ্যান্ড্রা অ্যান্ড্রুজের এই বইটি মূলত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ঘরানার। আর আগামী ২১ মে বুকস্ট্রিট প্রকাশনী থেকে আমার অনুবাদে প্রকাশিত হবে স্বনামধন্য লেখিকা এলিফ শাফাকের “দ্য আইল্যান্ড অফ মিসিং ট্রিজ” বইটি। বর্তমানে আমার একক মৌলিক গল্পসংকলনের ওপর কাজ করছি।

প্রশ্ন: বাহ্!!! লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দেয়?
উত্তর: প্রশংসা। আমার পাঠকেরা যত বেশি লেখা কিংবা অনুবাদের প্রশংসা করে, ভেতর থেকে আরও বেশি তাগিদ পাই তাদেরকে ভালো কিছু দেয়ার, আরও ভালো কাজ করবার। মানুষ স্বভাবতই প্রশংসার কাঙাল। আমিও এর ভিন্ন কিছু নই। পাঠকের প্রশংসা আর ভালোবাসাই আমাকে কাজ করার অনুপ্রেরণা যোগায় প্রতিনিয়ত।

প্রশ্ন: আপনার প্রিয় লেখক কে কিংবা কার লেখা ভালো লাগে?
উত্তর: প্রিয় লেখকের তালিকা তো বিশাল! কাকে ছেড়ে কাকে বলবো? তবে ছোটবেলা কেটেছে হুমায়ূন আহমেদ আর সত্যজিৎ রায়ের গল্প পড়ে। পড়ার ভিতটা যেহেতু তারাই গড়ে দিয়েছিলেন, সেহেতু মনের একটা বিশাল জায়গা জুড়ে তারাই থাকবেন। এছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহিরের লেখাও বেশ ভালো লাগে। হাল আমলের আবদুল্লাহ আল ইমরান ভাইয়ার লেখা আমার খুব পছন্দের। দেশের বাইরে বলতে গেলে এলিফ শাফাকের লেখা খুব ভালো লাগে।



প্রশ্ন: পাঁচ বছর পর নিজেকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
উত্তর: পাঁচ বছর পর? ২০২৭ সালে নিজের নামটা বাংলাদেশের দশজন সেরা লেখক, অনুবাদকের তালিকায় দেখতে চাই। জানি না কতদূর যেতে পারবো, তবে আমি থামতে চাই না। দেখা যাক স্রষ্টা কতটা সাহায্য করেন।

প্রশ্ন: আচ্ছা, যারা আপনার মতো অনুবাদক হতে চায়, তাদেরকে কিভাবে প্রস্তুত করতে হবে নিজেদেরকে?
উত্তর: প্রচুর পড়তে হবে। পড়ার কোনো বিকল্প নেই। দেশ বিদেশের লেখকদের লেখা পড়ে তাদের লেখার ধাঁচের সাথে পরিচিত হতে হবে। নিজেকে গল্পের একজন চরিত্র হিসেবে কল্পনা করতে হবে অনুবাদ কিংবা লেখার সময়। পরিস্থিতিতে ডুবে যেতে হবে। অভিধানের সাহায্য নিয়ে বানান রীতি সম্পর্কে জানাটা অতি আবশ্যক। লেখার সময় যত্ন নিয়ে বানান, বাক্য তৈরি করতে হবে। কেমন লিখছি, আরও ভালো কীভাবে করা যায়, সেজন্য নিয়মিত অনুবাদ কিংবা লেখার চর্চা করতে হবে। বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিত যারা পড়তে পছন্দ করে, তাদেরকে নিজের লেখাটা পড়িয়ে কীভাবে আরও ভালো করা যায়, বিভিন্ন টিপস নেয়া যেতে পারে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, লেখকের জন্য প্রশংসা অনুপ্রেরণার অবশ্যই। এগিয়ে যেতে অনেক সাহায্য করে। তবে প্রশংসায় একেবারেই গা ভাসানো যাবে না।

প্রশ্ন: মনুষ্যত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্য কতটুকু ভূমিকা পালন করে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: প্রশ্নটা একটু কঠিন। সাহিত্য আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেমন আচরণ করতে হবে, মানুষের প্রতি কতটা সহনশীল হতে হবে, নিজের মধ্যে জমে থাকা নেতিবাচক দিকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সাহায্য করে। আমি অনেক সাহিত্য পড়লাম, অনেক কিছু জানলাম, শিখলাম কিন্তু শিক্ষণীয় বিষয়গুলো বাস্তব জীবনে চর্চা করলাম না, তাতে তো কোনো লাভ হলো না। কাগজে ছাপা অক্ষরগুলো আমাকে একটা মেসেজ দিতে চাইছে। সে মেসেজটা আমাকে নিতে হবে, চর্চা করতে হবে প্রায়োগিকভাবে। নইলে বইয়ের পাতায় ছাপা অক্ষরগুলো বইতেই থেকে যাবে, মনুষ্যত্বের বিকাশ আর হবে না। তাই সাহিত্য সবসময়ই প্রভাবক। মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য চাই সাহিত্যলব্ধ জ্ঞানের চর্চা।

প্রশ্ন: অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনি নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেন নাকি পাঠক চাহিদাকে?
উত্তর: নিজের লেখা নিয়ে আমি একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। যা ভালো লাগে না, তা অনুবাদ করি না। অনেক সময় দেখা যায়, পাঠক চাইছে জমজমাট থ্রিলার, কিন্তু আমার পছন্দ হিস্টোরিক্যাল ফিকশন ধাঁচের বই। সেক্ষেত্রে পাঠক চাহিদাকে প্রাধান্য দিই না, নিজের ইচ্ছাকেই দিই। আমাকে সৌভাগ্যবান বলতে পারেন এই বিষয়ে। যেসব প্রকাশকের সাথে কাজ করেছি, করছি, তারা সবসময়েই আমার ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিছু চাপিয়ে দেননি।

প্রশ্ন: আচ্ছা,বই প্রকাশ করতে যেয়ে আপনাকে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে কি?
উত্তর: না। আমি এক্ষেত্রেও অনেক সৌভাগ্যবান। অনেকেই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন, অনেক কিছুই কানে আসে। তবে আমাকে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।

প্রশ্ন: আমরা আড্ডার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ করার আগে আমরা আপনার মুখ থেকে দূর্বাঘাস এবং দূর্বাঘাসের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দু-একটা কথা শুনতে চাইবো।
উত্তর: আপনাদের এই উদ্যোগটা বেশ প্রশংসনীয়। বর্তমানে আমরা কিছুটা বইবিমুখ জাতি হিসেবে পরিণত হয়েছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা দেশের লেখক-অনুবাদকদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন মানুষের সামনে, তাদের পরিচয়টাকে আরও জ্বলজ্বলে করে তুলছেন। আমি আশা করবো এই উদ্যোগটা কখনও বন্ধ হবে না। দূর্বাঘাসের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

লিজা: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার মূল্যবান সময় থেকে আমাদেরকে কিছুটা সময় ধার দেওয়ার জন্য।ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আবার হয়তো দেখা হবে অন্য কোনো আড্ডায়..ততদিন পর্যন্ত বিদায়।

আহনাফ: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইলো।

 

ভীষণ রকমের কম পড়ুয়া মানুষ আমি: অন্তর


লেখাটি শেয়ার করুন

Leave a Reply